স্টেলথ ফাইটার টেকনোলজিতে পরিবর্তন আনছে যুক্তরাষ্ট্র


  • মেহেদী হাসান
  • ০৬ জুন ২০২১, ১৩:৪৫

যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্য উদ্ভাবন করেছে সিরামিক টেকনোলজি। নতুন উদ্ভাবিত এ সিরামিক টেকনোলজি নাটকীয় উন্নতি ঘটাবে স্টেলথ ফাইটার টেকনোলজির ক্ষেত্রে। ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ ফাইটারের প্রতিপক্ষের রাডার ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা।

বর্তমানে বিশ্বে একমাত্র প্রকৃত স্টেলথ যুদ্ধবিমান বিবেচনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বি-স্পিরিট। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপ্টর, এফ-৩৫, চীনের চেংদু জে-২০ স্টেলথ ফাইটার হিসেবে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে কোনো স্টেলথ ফাইটারই শতভাগ রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম নয়। সবচেয়ে বেশি স্টেলথ ক্ষমতাসম্পন্ন বি-২ রাডার ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ। কিন্তু নতুন উদ্ভাবিত সিরামিক স্টেলথ টেকনোলজির মাধ্যমে এখনই রাডার ফাঁকি দেওয়ার হার ৯০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব।

পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম বি-২ স্পিরিট একটি ভারী বোমারু বিমান। বি-২ স্পিরিট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমান। রহস্যজনক আর দুর্ধর্ষ বোমারু বিমান হিসেবে অ্যাভিয়েশন জগতে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপ্টর, এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার হলেও বি-২ স্পিরিটকে রাডারে শনাক্ত করা প্রতিপক্ষের জন্য সবেচেয়ে কঠিন।

এর অদ্ভুত ডিজাইন আর স্টেলথ টেকনোলজি এর কারণ। স্টেলথ টেকনোলজির কারণে যে কোনো শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে শত্রুরাষ্ট্রের ভেতরে প্রবেশ করে ধ্বংসাত্মক হামলা পরিচালনায় সক্ষম বি-২ স্পিরিট। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কাছে বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমান আতঙ্কের নাম। চীনের এইচ-২০ স্টেলথ বোমারু বিমান সার্ভিসে না আসা পর্যন্ত বি-২ স্পিরিট বিশ্বে একক বিধ্বংসী ওয়ার মেশিন হিসেবে বিরাজ করবে।

বি-২ স্পিরিট যে কারণে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম তা হলো, এর রাডার অ্যাবজরবেন্ট ম্যাটেরিয়ালস বা আর এ এম। বি-২ বম্বারের বাইরের আবরণ তৈরি করা হয়েছে প্রধানত টাইটানিয়ামের সংমিশ্রণে নন-কনডাকটিভ কার্বন-গ্রাফিক কম্পোজিট দিয়ে। বিমানটির অধিকাংশ প্রতিফলিত এরিয়া যেমন ইনটেকস, ফ্লাপস এবং পাখার লিডিং প্রান্তসমূহে অতিরিক্ত আর এ এম দিয়ে স্প্রে করা হয়।

এই যুদ্ধবিমানের বাইরের আবরণে পরানো হয় ইলাস্টমোর নামক এক ধরনের পলিমার রাবার বা ইলাস্টিক যা স্ক্রু এবং বিভিন্ন ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে মসৃন জয়েন্ট তৈরি করে। এর ফলে এর প্রতিফলন হার অনেক কমে যায় এবং রাডার ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

বি-২ এর রাডার ফাঁকি দেয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো এর ব্যতিক্রমী গঠন বৈশিষ্ট্য। অনেক ভারী বোমা বহনে সক্ষম হলেও মূলত এর গঠন খুবই পাতলা আর বিস্তৃত। চাকাসহ এর উচ্চতা মাত্র ১৭ ফিট। প্রচলিত বিমানের মত এতে কোনো লজ নেই। দুই দিকে পাখির মত দুটি পাতলা বিশাল ডানা আর ত্রিভুজ আকৃতির কারণে সামনে, পেছনে, পাশে যে কোনো দিক দিয়ে সমান্তরল লেভেলে এর দিকে তাকালে খালি চোখেও এর আকৃতি খুবই ক্ষুদ্র দেখা যায়।

বি-২ স্পিরিটের দুই ডানার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের ব্যবধান ৫২ দশমিক ৪ মিটার যা একটি ফুটবল মাঠের অর্ধেক। তারপরও সামনে, পেছনে এবং পাশ থেকে তাকালে এটি যে বিমান তা বোঝার উপায় থাকে না অনেক সময়। কাছা কাছি থাকা অবস্থায় খালি চোখেই যেখানে একে অতি ছোট দেখায় সেখানে এর শরীরে থাকা প্রতিফলন বিরোধী আবরনের কারণে রাডারে এটি ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম । শক্তিশালী রাডারের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করলে একে অনেক সময় ক্ষুদ্র পাখির আকৃতিতে দেখা যায়।

অনেক দেশ এখন চেষ্টা করছে ফাইটার জেটের ক্ষেত্রে স্টেলথ টেকোনলজি ব্যবহার করার। স্টেলথ টেকনোলজিকে ব্যর্থ করতেরাডার টেকনোলজি উন্নত করা হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গবেষণা করছে স্টেলথ টেকনোলজিকে আরো উন্নত করার। বর্তমান আর এ এম ম্যাটেরিয়ালসমূহকে উন্নত করার জন্য নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটি উদ্ভাবন করেছে সিরামিক ভিত্তিক কোটিং। এর ফলে স্টেলথ ফাইটারের রাডার ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে।

নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট রিসার্স টিমের এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন বিমান নির্মাতা কোম্পানী তাদের উদ্ভাবিত স্টেলথি স্কিন ব্যবহার করে স্টেলথ বিমানের নতুন ডিজাইন করতে পারবে । তাদের প্রযুক্তি শুধু স্টেলথ ক্ষমতা বাড়াবে নয় বৃদ্ধি করবে বিমানের গতি এবং অস্ত্র বহন ক্ষমতা।

বর্তমানে বি-২ বা এফ১১৭ স্টেলথ ফাইটারে যে স্টেলথ টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে তারা রাডাকে ৮০ ভাগ ফাঁকি দিতে সক্ষম। স্টেলথ টেকনোলজির ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব ম্যাটেরিয়াল বিমানের আবরনে ব্যবহার করা হয় তাতে বর্তমানে দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমটি হলো এটি টেকসই নয়। লবন, পানি, বালি এবং অতিরিক্ত আদ্রতায় এটি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পলিমারের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। বিমানে দুটি স্থান আছে যেখানে ইঞ্জিনের কারণে এ পরিমাণ তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পারে।

সুপারসনিক গতির বিমানের ডানার লিডিং এজে এ ধরনের তাপ সৃষ্টি হয়। এ কারণে বিমান কোম্পানীগুলো ডানার আকৃতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে স্টেলথ দক্ষতা, অস্ত্র বহন ক্ষমতা এবং অপারেশন রেঞ্জ কমে যায়।

বিমানের পেছনে যেখান থেকে ইঞ্জিনের তাপ বের হয় সেখানে ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপ সৃষ্টি হয়। ফলে বিমানকে তাপ থেকে বাঁচাতে অতিরিক্ত লম্বা নজল ব্যবহার করতে হয়। এতেও বিমানের পারফরম্যান্স কমে যায়।

এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে অফিস অব নেভল রিসার্স, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং স্টেট অব নর্থ ক্যারোলাইনার সহায়তায় এই টিম উদ্ভাবন করেছে সিরামিক টেকনোলজি। যা প্রচন্ড উত্তাপে সহনীয়। আর একই সাথে এ ম্যাটেরিয়ালের রয়েছে রাডার ফাঁকি দেয়ার উচ্চ ক্ষমতা। সিরামিক প্রযুক্তি ব্যবহারে স্টেলথ ক্ষমতা বা রাডার ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা ৯০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

বিমানের বডিতে আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব সিরামিক টেকনোলজি। শীঘ্রই দেখা যেতে পারে মাথার উপর উড়ছে সিরামিকে ঢাকা বা সিরামিক প্রলেপের জেট।

যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত বি-২ স্টেলথ বম্বার প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৯ সালের ১৭ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের গৌরব এ বিমান স্পিরিট অব আমেরিকা নামে পরিচিত। টানা দুই দিনেরও বেশি আকাশে উড়তে সক্ষম বি-২ বম্বার। ফলে পৃথিবীর যে কোনে প্রান্তে বোমা হামলা চালিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে পারে বি-২ স্পিরিট।

বি-২ যুদ্ধ বিমান যে কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ তা হলো প্রচলিত এবং পারমাণবিক উভয় ধরনের বোমা বহনে সক্ষম এ বম্বার। প্রতিটি বিমান ১৬টি বি৮৩ (বি এইটটি থ্রি) পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারে। বি৮৩ একটি পারমাণবিক বোমার ওজন ১১০ কেজি। বি৮৩ পারমাণবিক বোমা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি বি-২ স্পিরিটের মতো অধিকতর স্টেলথ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমারু বিমান নিয়ে আসে তাহলে তা প্রতিপক্ষের জন্য সত্যিই বড় ধরনের আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হবে।