বিশ্বের ষষ্ঠ সামরিক শক্তি দক্ষিণ কোরিয়া


  • মেহেদী হাসান
  • ১৭ মে ২০২১, ১১:৫৯

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। সমরাস্ত্র শিল্পে দক্ষিণ কোরিয়া শক্তিশালী একটি দেশ। যুদ্ধবিমান ছাড়া নেভি এবং স্থলবাহিনীর প্রায় যাবতীয় সমরাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়া তৈরি করে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত ব্যালিস্টিক মিসাইল, অ্যান্টি শিপ ও অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল। সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, করভেট থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া তার যাবতীয় রণতরী নিজেরা তৈরি করে।

দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দেশ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জাহাজ শিল্প দক্ষিণ কোরিয়ার। এর নাম হাইউন্দাই। কোনো কোনো সংস্থার মতে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাণ শিল্প। যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে দক্ষিণ কোরিয়া উদ্ভাবন করেছে ফোর প্লাস জেনারেশন ফাইটার জেট। দক্ষিণ কোরিয়া নির্মাণ করছে হেলিকপ্টারসহ শক্তিশালী ড্রোন বিমান।

দক্ষিণ কোরিয়ার মোট সৈন্যসংখ্যা ৬৭ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ৬ লাখ। রিজার্ভ সৈন্য ৩১ লাখ এবং প্যারামিলিটারি ৩০ লাখ ১০ হাজার। দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি সামরিক ঘাঁটি। এসব ঘাঁটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ হাজারের বেশি সৈন্য। ১৯৫৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য অবস্থান করে আসছে দক্ষিণ কোরিয়ায়।

দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বিমানের সংখ্যা ১ হাজার ৫৮১টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ৪০২টি। ডেডিকেটেড এটাক জেট ৭৪টি। সামরিক পরিবহন বিমান ৪১টি। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশিক্ষন বিমান রয়েছে ২৯৬টি। স্পেশাল মিশন ৩০টি এবং ট্যাঙ্কার ফ্লিটে রয়েছে ৪টি বিমান। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৭৩৪টি। এর মধ্যে এটাক হেলিকপ্টর রয়েছে ১১২টি।

দক্ষিণ কোরিয়ার মোট রণতরীর সংখ্যা ২৩৪টি। এর মধ্যে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ১টি, ডেস্ট্রয়ার ১২টি, ফ্রিগেট ১৪টি এবং করভেট ১২টি। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবমেরিন সংখ্যা ২২টি, টহল জাহাজ ২৬টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ১১টি।

দক্ষিণ কোরিয়ার ২২টি সাবমেরিনের একটি জার্মানির তৈরি। বাকি ২১টি দক্ষিণ কোরিয়ার নিজস্ব তৈরি। এসব সামমেরিন তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েউ শিপ বিল্ডিং এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী এবং হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সমস্ত ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, করভেটসহ অন্যান্য যাবতীয় রণতরী মূলত এ দ্ইু প্রতিষ্ঠানের তৈরি। হানজিন হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ, এটিএস অফশোর এন্ড শিপ বিল্ডিং টহল জাহাজ এবং এমফিভিয়াস শিপ বিল্ডিংয়ে নিয়োজিত। কাংনাম যুক্ত মাইন ওয়ারফেয়ার নির্মাণে।

মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে স্থল বাহিনীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র ও সমর যান দক্ষিণ কোরিয়া তৈরি করে। দক্ষিণ কোরিয়ার ট্যাঙ্ক রয়েছে ২ হাজার ৬০০টি। সাঁজোয়া যান ১৪ হাজার ১০০। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৩ হাজার ৪০টি। টাউড আর্টিলারি ৩ হাজার ৮৮৫টি এবং রকেট প্রজেক্টর ৫৭৪টি। আসুন জেনে আসি দক্ষিণ কোরিয়ার সমরাস্ত্র শিল্পের নানা দিক।

সাবমেরিনসহ বিভিন্ন ধরনের রণতরী, ইঞ্জিনিয়ারিং, ইঞ্জিন এন্ড মেশিনারি, ইলেট্রিক এন্ড এনার্জি সিস্টেম, অফশোর এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন ইকুইপমেন্ট, রোবটিকস, গ্রিন এনার্জি, মটর কোম্পানী, গ্লোবাল সার্ভিস প্রভৃতির সাথে যুক্ত হাইউন্দাই। সাবমেরিন, বিভিন্ন ধরনের রণতরীর পাশপাশি দক্ষিণ কোরিয়া আর্মির জন্য হাইউন্দাই নির্মাণ করে কে ১ এবং কে২ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক।

হাইউন্দাই এর আগে নাম ছিল হুন্দাই। ১৯৭২ সালে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন চাং জু ইয়াং। তবে এর প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে।

দক্ষিণ কোরিয়ার আরেক বিখ্যাত জাহাজ নির্মাণ শিল্প স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রি। । স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজ নির্মাতা শিল্প। সারা বিশ্বে ইলেকট্রনিক পন্যের জন্য বিখ্যাত স্যামসাং সমুদ্রগামী দৈত্যাকার বানিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ করে থাকে।

দায়েউ শিপ বিল্ডিং এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষিণ কোরিয়ার আরেক বিখ্যাত জাহাজ নির্মাণ শিল্প। মূলত সাবমেরিন এবং যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণ করে দায়েউ। ২০১৫ সালে ১৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জাহাজ রণরতী বিক্রি করেছে এটি।

সাবমেরিন, বিভিন্ন রণতরীর পাশপাশি দায়েউ স্থল বাহিনীর জন্য মেশিন গান, রাইফেল, এসল্ট রাইফেল, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নির্মাণ করে।

স্থল বাহিনীর সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি, হাউইজার, রকেট আর্টিলারি, আরমারড সাঁজোয়া যান, পারসোনাল ক্যারিয়ার, ইঞ্জিনিয়ারিং ভিহিক্যালসহ যাবতীয় লজিস্টিক ভেহিক্যাল তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়া। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিজস্ব রাডার সিস্টেম।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র নির্মাণ করে দক্ষিণ কোরিয়া । ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করে চুনমা নামক সারফেস টু এয়ার মিসাইল। নিজেরা তৈরি করলেও স্থল বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রিটেন, ইসরাইল এর কাছ থেকে আমদানিও করে।

দক্ষিণ কোরিয়া উদ্ভাবন করেছে হাইউনমো নামক ব্যালিস্টিক মিসাইল। এটি একটি সারফেস টু সারফেস মিসাইল। এর সর্বোচ্চ পাল্লা দেড় হাজার কিলোমিটার। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে রয়েছে নিজস্ব তৈরি মাঝারি পাল্লার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট এবং অ্যান্টি শিপ মিসাইল।

দক্ষিণ কোরিয়ার তৈরি মাঝারি পাল্লার অ্যান্টি শিপ মিসাইলের নাম সি স্টার। দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে অ্যান্টি সাবমেরিন মিসাইল হং সাং ইয়ো। এটি উদ্ভাবন করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার নিজস্ব তৈরি আরো তিন ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টি শিপ মিসাইল রয়েছে।

এর পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে দুই ধরনের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট আর্টিলারি এবং পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। নিজস্ব মিসাইল ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন নির্মিত আটাকামস টেকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম। এটি মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার থেকে ছোড়া যায়।

দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে রয়েছে যুক্তরষ্ট্রের হারপুন ও পেঙ্গুইন অ্যান্টি শিপ মিসাইল। এছাড়া রয়েছে, আমরাম ও এইম এয়ার টু এয়ার মিসাইল, ব্রিটেনের সি কুয়া এয়ার টু সারফেস মিসাইল এবং ফ্রান্সের এক্সোসেট অ্যান্টি শিপ মিসাইল। এ ছাড়া রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শিপ টু এয়ার মিসাইল। দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বাহিনী মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিভিন্ন যুদ্ধবিমান দ্বারা সজ্জিত। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার রয়েছে ২৩টি। যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্থ জেনারেশন বহুমুখী এফ-১৬ জঙ্গি বিমান রয়েছে ১৬৭টি। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৫ ঈগল রয়েছে ৫৯টি। এ ছাড়া ১৯৩টি এফ-৫ টইগার ফাইটার জেটসহ যুক্তরাষ্ট্রের আরো বিভিন্ন ধরনের ফাইটার জেট রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নরথ্রপ গ্রুম্যান তৈরি শক্তিশালী আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক ড্রোন বিমান রয়েছে ২টি। এ ড্রোন বিমান ৬০ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম এবং এক দিনে ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকা পরিদর্শন করতে পারে। এ ছাড়া ইসরাইলের তৈরি সার্চার এবং হেরন নামে শক্তিশালী ড্রোন বিমান রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বাহিনীতে সামরিক পরিবহন বিমান, সার্ভিল্যান্স, আর্লি ওয়ার্নিং ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং ও লকহিড মার্টিনের বিভিন্ন বিমান রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এপাচি, চিনুক, ব্লাক হক, বেলসহ বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী হেলিকপ্টার রয়েছে। রাশিয়ার কামাভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিকরস্কি পরিবারেরও বিভিন্ন হেলিকপ্টার রয়েছে।

বিমান শক্তিতে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে দক্ষিণ কোরিয়া কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা উদ্ভাবন করেছে শক্তিশালী ফোর প্লাস জেনারেশন ফাইটার জেট। এর নাম কে এফ-২১ বোরেমায়ে। ২০২৮ সালে এ বিমান কোরিয়ান সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার কথা।

দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে সামরিক পরিবহন হেলিকপ্টার নির্মাণে সক্ষম। ইউরো কপ্টারের সহায়তায় কোরিয়ান এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ নির্মাণ করে কাই সুরিয়ান নামক হেলিকপ্টার। কোরিয়ান এরোস্পেস ইন্ডাস্টি নির্মিান করছে বিভিন্ন ধরেন শক্তিশালী সামরিক ড্রোন বিমান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাই ডাক হক, কাই কুস-৯।