সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৪তম। ইরানের রয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত শক্তিশালী ব্যালিস্টিক মিসাইল, যার আওতা ৫ হাজার মাইল। রয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবিত ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার জেট। ইরানের রয়েছে উন্নত মহাকাশ, সমর প্রযুক্তি আর সমরাস্ত্র শিল্প। সাবমেরিন, ফ্রিগেট, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কসহ নৌ ও স্থলবাহিনীর প্রায় সমস্ত সমরাস্ত্র ইরানের নিজস্ব তৈরি।
ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ও মহাকাশ কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী একটি উত্তপ্ত রাজনৈতিক ইস্যু। বিশ্বে ১১টি দেশ রয়েছে, যারা তাদের নিজস্ব লঞ্চিং সিস্টেমের মাধ্যমে কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম। ইরান তার মধ্যে একটি।
মিসাইল শক্তির দিক দিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। অপর দিকে ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি আর ড্রোন বিমানকে ইসরাইলসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করা হয়। ইরান চলতি বছরের শুরুতে চালিয়েছে বিশাল ড্রোন মহড়া, যেখানে অংশ নেয় শত শত ড্রোন বিমান।
অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচি পারমাণবিক বোমা নির্মাণ কর্মসূচির সাথে যুক্ত। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইরাসইলসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে শঙ্কিত।
দীর্ঘদীন থেকে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরান বিদেশ থেকে শক্তিশালী অস্ত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হয়। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান বাধ্য হয়েছে নিজস্ব অস্ত্র প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং শক্তিশালী সমরাস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। দেশটি উদ্ভাবনের পথে রয়েছে ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ইরানের মোট সৈন্য সংখ্যা ১৯ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার। প্যারামিলিটারি ১০ লাখ ৫০ হাজার। ইরান সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ দেশটির সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। সেকেন্ড ইন কমান্ড দেশটির প্রেসিডেন্ট।
ইরানের ইসলামিক রেভলুশনারি গার্ড কর্পস বিশ্ব মিলিটারিতে আরেকটি নাম। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য ১৯৭৯ সালে ইরান ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী গঠন করেন এ ফোর্স। ইরান আর্মির মত রেভলশুনারী গার্ডের রয়েছে স্থল, নৌ, বিমান, কুদস ফোর্স এবং প্যারামিলিটারি। রেভলুশনারী গার্ডের সৈন্য সংখ্যা আড়াই লাখের ওপর। আসুন জেনে আসি ইরানের স্থল বাহিনীর কিছু তথ্য।
ইরানের মোট ট্যাঙ্ক সংখ্যা ৩ হাজার ৭০৯টি। সাজোয়া যান ৮ হাজার ৫শ। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৭৭০টি। টাউড আর্টিলারি ২ হাজার ১০৮টি। রকেট প্রজেক্টর ২ হাজার ৪৭৫টি। ইরানের কাছে বৃটেনের তৈরি ২৮০টি ট্যাঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়া ইরানের কাছে ইরান যুক্তরাষ্ট্র, ইরান-সোভিয়েত ইউনিয়ন যৌথভাবে তৈরি মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রয়েছে কয়েকশ।
ইরানের আছে নিজস্ব তৈরি তিন ধরনের মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। এগুলোর নাম জুলফিকার, সাফির এবং কারার। ইরানের কাছে ৬ শতাধিক মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রয়েছে।
আছে রাদ নামে সাড়ে চারশ শক্তিশালী সেলফ প্রপেল্ড হাউইজার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং উত্তর কোরিয়ার তৈরি সেলফ প্রপেল্ড হাউইজার রয়েছে বিপুল সংখ্যক।
ইরানের নিজস্ব তৈরি দুই ধরনের টাউড আর্টিলারি রয়েছে। বাকী টাউড আর্টিলারি সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সুইডেন, দক্ষিন আফ্রিকা এবং ইরান-চীন যৌথভাবে নির্মিত।
ইরানের নিজস্ব তৈরি সাজোয়া যানের সংখ্যা ৪৫০টি। নিজস্ব তৈরি আরমারড ফাস্ট এটাক ভেহিক্যাল রয়েছে ১৫০টি। এ ছাড়া সোভিয়তে ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ব্রাজিল, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া এবং স্পেনের তৈরি সাজোয়া যান, পারসোনাল ক্যারিয়ার রয়েছে ইরানের।
ইরান তার স্থল বাহিনীর জন্য কয়েক ধরনের শক্তিশালী এসল্ট রাইফেল তৈরি করে। এছাড়া মেশিন গান, হেভি মেশিন গান, লাইট মেশিন গান এবং অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চারসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্রাস্ত তৈরি করে ইরান। ইরানের স্থল বাহিনীতে রয়েছে নিজস্ব তৈরি কয়েক ধরনের এন্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো তুফান।
ইরান চলতি বছর উৎক্ষেপন করেছে শক্তিশালী জোলজানাহ রকেট। ২০২১ সালের শুরুতে ইরান প্রথমবারের মত জোলজানাহ রকেট প্রকাশ্যে হাজির করে। এ রকেটের কারণে ইরানের ব্যালেস্টিক মিসাইলের আওতা ৫ হাজার মাইল অতিক্রম করতে সক্ষম। নতুন এ জোলজানাহ রকেটভিত্তিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ১ টন বোমা নিয়ে ৫ হাজার মাইল অতিক্রমে সক্ষম হতে পারে। আইসল্যান্ডসহ সমগ্র ইউরোপ এখন ইরানের জোলজানাহ ভিত্তিক মিসাইলের আওতায় আসবে। আসুন জেনে আসি ইরানের মিসাইল ও নৌশক্তি নিয়ে আরো কিছু তথ্য।
ইরানের কাছে নিজস্ব উদ্ভাবিত ব্যাটল ফিল্ড মিসাইল ও ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। এর একটি হলো ফাতেহ ১১০। এ ছাড়া রয়েছে সাহাব-৩, হুত, নাজিয়াত, ওগাব, তন্দার নামক মিসাইল রয়েছে। টেকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল এর আওতা ৩০০ কিলোমিটার। গতি ম্যাক ৩ দশমিক ৫।
ইরানের রয়েছে কায়েম নামে নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল। ইরানের নিজস্ব উদ্ভাবিত এন্টি শিপ মিসাইলের মধ্যে রয়েছে জাফর, খালিজ, কাদের, রাদ, নূর এবং নাসর।
ইরান বিশ্বের নবম দেশ হিসেবে ২০০৯ সালে কক্ষ পথে স্যাটেলাইট পাঠায় । সাফির নামক রকেটের সাহায্যে নিজস্ব তৈরি স্যাটেলাইট পাঠায় ইরান।
ইরান মহাকাশ গবেষনা সংস্থার নাম ইরান স্পেস এজেন্সি। ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল ইরান কক্ষপথে সফলভাবে পাঠাতে সক্ষম হয় নূর নামক মিলিটারি স্যাটেলাইট। এর আগে একই বছর ৯ ফেব্রুয়ারি তারা কক্ষ পথে পাঠায় জাফর নামক কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। সমর বিশ্লেষকদের মতে ইরানের স্পেস মিশন ইরানকে বিশ্ব মিলিটারি পাওয়ার হিসেবে আবির্র্ভূত হতে সহায়তা করছে।
ইরানের মোট রণতরীর সংখ্যা ৩৯৮টি। এর মধ্যে ফ্রিগেটস ৬ টি, করভেট ৩টি, সাবমেরিন ২৯টি। ইরানের কাছে রাশিয়ার কিলো ক্লাস এটাক সাবমেরিন রয়েছে ৩টি। ইরানের রয়েছে নিজস্ব তৈরি সাবমেরিন। এগুলো হলো ফাতাহ ক্লাস এবং গাদির ক্লাস। ইরানের এসব সাবমেরিনের নির্মাতা ইরানের মেরিন ইন্ডাস্ট্রিজ অর্গানাইজেশন। আসুন জেনে নেই ইরানের নৌশক্তি ও বিমান শক্তির কিছু তথ্য।
ইরানের কাছে নিজস্ব তৈরি মৌজ ক্লাস ফ্রিগেট রয়েছে ৩টি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আলভান্ড ক্লাস ফ্রিগেট রয়েছে ৩টি। ইরানের তিনটি করভেট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডের তৈরি।
ইরানের কাছে তাদের নিজস্ব তৈরি ৫টি সিনা ক্লাস ফাস্ট এটাক রনতরী রয়েছে। এছাড়া ফ্রান্সের তৈরি কামান ক্লাস ফাস্ট এটাক রনতরী রয়েছে ১০টি। ইরানের রয়েছে নিজস্ব তৈরি কারবালা ক্লাস ৪টি এমফিভিয়াস রণতরী। এছাড়া যুক্তরাজ্যের তৈরি হেঙ্গাম ক্লাস এমফিভিয়াস রণতরী রয়েছে ৪টি।
ইরান উদ্ভাবন করেছে ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার জেট। এর নাম হেসা কাওসার। এতে রয়েছে এডভান্সড এভয়নিক্স, রাডার এবং উইপন সিস্টেম। ২০১৮ সালে এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত হয়। ইরান এখন পর্যন্ত চারটি এ বিমান নির্মাণ করেছে। আসুন জেনে আসি ইরানের বিমান শক্তি নিয়ে আরো কিছু তথ্য।
ইরান নিজস্ব তৈরি ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট অর্জনের পথে রয়েছে। এর নাম কাহার-৩১৩। ২০১৭ সালে ইরান কাহার ফাইটার জেটের একটি প্রটোটাইপ পরীক্ষা হয়েছে।
ইরান উদ্ভাবন করেছে হেসা ইরান-১৪০ নামে সামরিক পরিববহন ও মেরিটাইম টহল বিমান। ইরানের কাছে রয়েছে কয়েক ধরনের নিজস্ব তৈরি প্রশিক্ষন বিমান। এগুলো হলো ফজর এফ-৩, হেসা ডরনা, হেসা ইয়াসিন, হেসা সিমর।
ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইরানের মিসাইল, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, রাডার ব্যবস্থা যে কোনো আধুনিক বিমান বাহিনীর হামলা মোকাবেলায় সক্ষম।
ইরানের বিমান বাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ৫১৬টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ১৬১টি। ডেডিকেটেড এটাক ২৩টি। সামরিক পরিবহন বিমান ৮৫টি। প্রশিক্ষন বিমান ৯৬টি। স্পেশাল মিশন ৯টি। ট্যাঙ্কার ফ্লিট ৬টি। হেলিকপ্টার ৯৯টি। এটাক হেলিকপ্টার ১২টি।
ইরানের বিমান বাহিনীর সামরিক বিমান যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং চীনের তৈরি। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের আগে রেজা শাহের আমলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইরান অনেক যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করে। এর অনেকগুলো এখনো সক্রিয় রয়েছে। অপর দিকে ইরানের কাছে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের যেসব বিমান রয়েছে সেগুলো ইরাকের বিমান। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক অভিযানের সময় ইরাক তাদের শতাধিক যুদ্ধ বিমান যাতে ধ্বংস না হয় সেজন্য ইরানে পাঠায়। যুদ্ধ শেষে অনেক বছর ধরে এসব বিমান অচল পড়ে থাকে । এরপর ইরান এসব বিমান তাদের বিমান বাহিনীতে যুক্ত করে ।
ইরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৪ টমক্যাট রয়েছে ৪৩টি, এফ-৪ ফ্যানটম রয়েছে ৬৪টি। এফ-টাইগার ৬০টি। ইরানের কাছে সোভিয়েত আমলের মিগ ২৯ রয়েছে ৪৪টি, এসইউ -২২ রয়েছে ২০টি এবং এসইউ-২৪ বিমান রয়েছে ৩৬টি। ফ্রান্সের মিরেজ এফ১ রয়েছে ২৩টি। চীনের চেংদু জে-৭ ২৪টি।
ইরানের কাছে লকহিড মার্টিনের ৫টি পি-৩ অরিয়ন বিমান রয়েছে। এগুলো মেরিটাইম টহল বিমান। ইরানের কাছে বোয়িং ৭৪৭ ৬টি এবং বোয়িং ৭০৭ ৩টি পরিবহন বিমান রয়েছে। লকহিড মার্টিন সি-১৩০ হারকিউলিস রয়েছে ২৭টি। ইরানের কাছে ইউক্রেনের এনটোনভ এন-৭৪ রয়েছে ১২টি, রাশিয়ার টেকটিক্যাল এয়ার লিফটার রয়েছে ১৫টি, নেদারর্যান্ডের ফকার এফ-২৭ রয়েছে ১২টি। এ ছাড়া সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সেরও কয়েকটি সামরিক পরিবহন বিমান রয়েছে।
ইরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সামরিক বিমান রয়েছে তার প্রায় সবই ১৯৭৪ সালে সংগ্রহ করা। ইরানের বিমান বাহিনীতে যেসব হেলিকপ্টার রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং চিনুক ২টি এবং ইতালীল অগাস্টা বেল ৫টি।
ইরান সম্প্রতি ব্যাপক ভিত্তিক ড্রোন মহড়া পরিচালনা করেছে। এতে অংশ নেয় তাদের নিজস্ব তৈরি কয়েকশ শক্তিশালী ড্রোন। এসময় কারার ড্রোন বিমান থেকে শক্তিশালী এয়ার টু এয়ার মিসাইল ছোড়া হয়। ইরানের শক্তিশারী কারার ড্রোনের গতি ঘন্টায় ৫২৬ মাইল। এর রয়েছে এয়ার টু এয়ার মিসাইল, এন্টি শিপ মিসাইল এবং ভারী গাইডেড বোমা বহনের ক্ষমতা। কারার ড্রোনে রয়েছে হেভি অটোমেটিক মেশিন গান। এ ড্রোন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী এমকিউ-৪, এমকিউ-৯ এবং পি-৮কে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম।
জানুয়ারির এ ড্রোন মহড়ায় ইরান সাত ধরনের নতুন ড্রোন প্রযুক্তি প্রদর্শন করে। ইরানের কাছে রয়েছে কমপক্ষে ২০ ধরনের নিজস্ব উদ্ভাবিত ড্রোন বিমান। বর্তমানে ইরান উদ্ভাবনের পথে রয়েছে স্টেলথ ড্রোন বিমান যা রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে।