চীনের সাইবার হামলার ঝুঁকিতে ভারত


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৫ মে ২০২১, ০৭:৫১

ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত সম্প্রতি বলেছেন, ভারত আইটি জগতের পাওয়ার হাউস হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হলেও সাইবার ওয়ারফেয়ারের দিক থেকে এখনও অনগ্রসর। এ কারণে ভারত প্রতি মুহূর্তেই চীনের সাইবার আক্রমণের হুমকিতে রয়েছে। তিনি আরও জানান, সাইবার প্রযুক্তিতে ভারতের তুলনায় চীন অনেকটা এগিয়ে থাকায় যে কোনো মুহূর্তে চীন ভারতের বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণ শুরু করে দিতে পারে। বিপিন রাওয়াতের মতে, চীন যে কোনো মুহূর্তে ভারতের যে কোনো সিস্টেম থামিয়ে দিতে পারে বা প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করতে পারে।

চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারতের নীতি নির্ধারকদের সাইবার আক্রমণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। একইসাথে সাইবার ওয়ারের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ভারতের লক্ষ্য হলো, যদি প্রতিপক্ষ কোনো দেশ ভারতের বিরুদ্ধে সাইবার হামলা চালায়, তাহলে এর প্রভাব যেন স্থায়ী না হয়। খুব দ্রুতই যেন সেই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে যাবতীয় সিস্টেম আবার আগের মতো সচল রাখা যায়।

গত বছরের অক্টোবরে ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বাই বেশ লম্বা সময় বিদ্যুতের সংকটে পড়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো একের পর এক সিস্টেম লসে আক্রান্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান রেকর্ডেড ফিউচারের মতে, এ ঘটনাটি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে একটি বার্তা। ভারত যদি চীনের সাথে সীমান্তে আরও বেশি সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে দেশটি আরও কতভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, চীন অক্টোবরের সাইবার আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। রেকর্ডেড ফিউচার জানিয়েছে, অক্টোবরের ওই বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটার মূল কারণ ছিল চীনের মালওয়্যার, যাকে সুকৌশলে ভারতের জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ সিস্টেমে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

রেকর্ডেড ফিউচার আরো জানায়, ২০২০ সালের একেবারে শুরু থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় ভাইরাসের অনুপ্রবেশ বেড়ে যায়। এসব ভাইরাস ও মালওয়্যারের বেশিরভাগই ছিল চীনা পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা গ্রুপের তৈরি। প্রাপ্ত গ্রুপগুলোর তৈরি। ভারতের ৪টি রিজিওনাল লোড সেন্টারসহ এমন ১০টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে টার্গেট করা হয়। যেগুলোর মাধ্যমে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। এই হামলাকে ভারতের স্পর্শকাতর অবকাঠামোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ হামলা হিসাবে দেখা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ প্রতিপক্ষ দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রথাগত সামরিক যুদ্ধের চেয়ে বরং সাইবার হামলার ওপর বেশি ভরসা রাখছে। এ কারণে দেশে দেশে স্পর্শকাতর অবকাঠামো ও সিস্টেমগুলোর বিরুদ্ধে সাইবার হামলার সংখ্যাও অনেকটা বেড়েছে। সাইবার হামলা সাধারণ চোখে দেখা না গেলেও এর ক্ষতিকারক প্রভাব অনেক বেশি।

অতি সম্প্রতি ইরানের নাতানজে পারমাণবিক স্থাপনায় সাইবার হামলা চালানো হয়। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প অনেকটা মন্থর হয়ে যায়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরন কার্যক্রমও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই হামলাকে ইরানের পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান মারাত্মক ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ইসরাইলকে এ হামলার জন্য দায়ী করে ইসরাইলী কর্মকর্তাদের এর জন্য বিচারের আওতায় নিয়ে আনারও দাবি জানান। ইসরাইল এখনো পর্যন্ত এ হামলার দায় স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করেনি।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এবারই প্রথম সাইবার হামলার মুখে পড়লো তা নয়। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যৌথভাবে একটি সাইবার আক্রমণের মধ্য দিয়ে স্টাক্সনেট নামক একটি কম্পিউটার ভাইরাসকে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিলে গোটা প্রকল্পটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিহ্রস্থ হয়। ২০১০ সালের এই সাইবার আক্রমণের কারণে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পটি ৭ বছর পিছিয়ে পড়েছিল। এবার আবার যখন নাতানজের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়, তার পরপরই ইসরাইল দ্বিতীয় দফা সাইবার আক্রমণ করে ইরানকে আরেকবার সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে।

জেনারেল বিপিন রাওয়াতের সতর্ক বার্তার পর ভারতের নীতি নির্ধারনী মহলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাইবার নিরাপত্তায় ভারতের আরো অনেক বেশি বিনিয়োগ করা উচিত। এ খাতে ব্যাপক পরিমান সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। ২০২০ সালে সাইবার পাওয়ারের যে বিশ্বজনীন সূচক প্রকাশিত হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র আছে এক নম্বর অবস্থানে। আর যুক্তরাষ্ট্রের পরই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানেই আছে চীন। ইসরাইল তালিকায় ১১ নম্বর অবস্থানে থাকলেও ভারত প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে নেই।

ভারত এ তালিকায় ২১ নাম্বার অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতের একটি পৃথক সাইবার আর্মি গঠনেরও প্রস্তাব করেছেন যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত যাবতীয় স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করবে। চীন এরই মধ্যে সাইবার সিকিউরিটিকে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে গন্য করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, সাইবার সিকিউরিটিকে ভারত এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত গুরুত্বই দেয়নি।

ভারতীয় সাইবার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের বিদ্যুৎ ও টেলিকম সেক্টরে চীনের আর কোনো বিনিয়োগও অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। চীনের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম আর মেকানিজমের ওপর ভারতের নির্ভরতা যত বাড়বে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেলিকম সেক্টরও তত বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়বে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৩ সাল পর্যন্ত ভারত ও চীন অনেকক্ষেত্রেই কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। কিন্তু এখন এসে শুধু সাইবার প্রযুক্তি নয় বরং আরো অনেক খাতেই ভারত চীনের অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছে।

২০০৩ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ সাইবার ওয়ারফেয়ারে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তখন থেকেই তারা অনুধাবন করেছিল যে, সাইবার জগতে রক্ষণাত্মক কৌশল কখনোই কোনো কার্যকরী কৌশল নয়। বরং আক্রমণাত্মক কৌশলই এখানে বেশি কার্যকর।

২০০৩ সালের পর নিজেদের সাইবার সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে চীন যেসব কাজ করেছিল তার মধ্যে আছে, তথ্য খনি স্থাপন, তথ্য সংগ্রহ, নেটওয়ার্ক ডাটায় পরিবর্তন, তথ্য প্রকাশ ও লজিক বোমা, প্রোপাগান্ডা কৌশলকে সংহতকরণ, ক্লোন ইনফরমেশন, এবং স্পাই স্টেশন প্রতিষ্ঠার মতো বিষয় রয়েছে।

২০১০ সালে মোসাদ ও সিআইএ যৌথভাবে ইরানের বিরুদ্ধে সে স্টাক্সনেট ভাইরাসটি ছাড়ার পর সর্বপ্রথম বিশ্ববাসী এ ধরনের ভাইরাসের সক্রিয়তা ও ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এ ভাইরাসটি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় অনুপ্রবেশ করানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পের সেন্ট্রিফিউজকে ধ্বংস করে দেওয়া। এ ভাইরাসটি প্রমাণ করে যে, যেকোনো ভাইরাস সাইবার স্পেসের চৌহদ্দি অতিক্রম করে যেকোনো সময় ফিজিকাল জগতে এসে বাহ্যিক অবকাঠামোগুলোকেও অকার্যকর করে দিতে পারে।

স্টাক্সনেটের এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, যদি বড়ো কোনো আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র এ ধরনের সাইবার আক্রমণাত্মক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে তাহলে তারা সাথে সাথেই সাইবার যুদ্ধও শুরু করে দেয়। এক্ষেত্রেও চীন তাই করছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে মুম্বাইতে চীন যে সাইবার আক্রমণটি চালিয়েছিল তাকে বলা হয় ব্যাটল ডেমেজ এসেসমেন্ট। এ ধরনের আক্রমণ করে চীন বোঝার চেষ্টা করেছে যে, তাদের প্রতিপক্ষের কৌশলগত টার্গেটগুলো জয় করতে কতটা সক্ষম।

এই আক্রমণের মধ্যদিয়ে চীন প্রতিপক্ষ ভারতের ডিটেকশন সক্ষমতা সম্বন্ধেও ভালো ধারনা পেয়ে গেছে। সবক্ষেত্রে না হলেও ভারত অনেকগুলো স্থাপনা ও প্রকল্পের ক্ষেত্রে কম্পিউটার ইমারজেন্সি টিম প্রতিষ্ঠা করায় ভারতের ডিটেকশন সক্ষমতা ভালো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত এখনও সাইবার যুদ্ধে ততটা অগ্রসর হতে পারেনি কারণ অনেকক্ষেত্রেই ভারতের সাইবার কৌশলগুলো বেশ রক্ষণশীল। চীনের সাথে লড়াই করতে গেলে আক্রমণাত্মক কৌশল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

শুধু সাইবার বিশেষজ্ঞরাই নয়, ভারতের মূল ধারার রাজনীতিবীদরাও এখন জোরে শোরে সাইবার কমান্ড প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলছেন। কংগ্রেস প্রধান রাহুল গান্ধীও অনেকবার একটি স্বতন্ত্র সাইবার কমান্ড প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তার মতে ভারতের বেসামরিক ও সামরিক স্থাপনাগুলো অনেকগুলো অরক্ষিত।

ভারতের সিংহভাগ প্রকল্পে যেসব হার্ডওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে তার অধিকাংশই আমদানীকৃত। এমনকি চীনেরও অনেক সামগ্রী আছে। অথচ, ভারতের নিজের মাটিতে অনেক প্রতিষ্ঠান হার্ডওয়্যার তৈরি করলেও রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর প্রকল্পে সেই হার্ডওয়্যারগুলো এখনো ব্যবহার করা হয়না। রাহুল গান্ধী আশংকা প্রকাশ করেন, আমদানীকৃত হার্ডওয়্যারগুলো স্পাইওয়্যার কিনা তা নিয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনও হতে পারে এগুলোর মাধ্যমেই পেছনের দরোজা দিয়ে আমাদের তথ্যগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে।

রাহুল গান্ধী বলেন, আজ অবধি ভারতের মতো দেশে সাইবার সিকিউরিটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়নি। ভারতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার ও প্রশাসনের এই গাছাড়া মনোভাবের কারণেই চীনসহ প্রতিপক্ষ দেশগুলো ভারতের অবকাঠামোগুলোতে সাইবার আক্রমণ পরিচালনা করার সাহস পাচ্ছে।