মিসরের যুদ্ধবিমান কেনা : হেরে গেল রাশিয়া

ড্যাসল্ট রাফালে যুদ্ধবিমান - উইকিপিডিয়া

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৫ মে ২০২১, ০৭:২৬

মিসর শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের সাথে ৩০টি ড্যাসল্ট রাফালে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছে। মিসরের সাথে এই চুক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। রাশিয়াও এ সুযোগে মিসরের কাছে এসইউ থার্টি ফাইভ বিমান বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিসর রাফালে ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফরাসি বিমান সংস্থার বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে বিগত ৫ বছরের মধ্যে মিসর দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সের ড্যাসল্টের সাথে চুক্তি করল। মিসরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ঋণ হিসেবে এই ক্রয়চুক্তিটি হয়েছে। এ ঋণ পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে মিসরকে পরিশোধ করতে হবে।

ফ্রান্সের বির্মান নির্মাণকারী সংস্থা ড্যাসল্ট রাফালে যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে এ বছর দুটি দেশের সাথে চুক্ত করেছে। একটি গ্রিস, অপরটি মিসর। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্রিসের সাথে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছিল। যার আওতায় গ্রিসকে ১২টি সেকেন্ড হ্যান্ড এয়ারক্রাফট এবং ৬টি নতুন বিমান সরবরাহ করবে। মিসরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য চুক্তির মূল্যটি এখনো খোলাসা করেনি। তবে মিসরের সাথে বিমান কেনার চুক্তিটির মূল্য হবে আনুমানিক ৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফ্রান্স দাবি করছে, এ চুক্তির মাধ্যমে তারা ২০২৪ সাল থেকেই মিসরকে ড্যাসল্টের বিমানগুলো সরবরাহ করতে শুরু করবে। মিসরের এ চুক্তিকে মস্কোর জন্য বড় আকারের ধাক্কা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। মস্কো অনেকদিন ধরেই মিসরীয় বিমান বাহিনীর কাছে তাদের এসইউ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমানগুলো বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে আসছিল।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিসরের সাথে এ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি করায় ফ্রান্সের তীব্র সমালোচনা করেছে। মিসরের সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। সিসির শাসনামলে মিসরে শুধু বিরোধী দল নয়, বরং নানা মানবাধিকার সংস্থা এবং মিডিয়ার বিরুদ্ধেও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। বর্তমানে মিসরের জেলগুলোতে ৬০ হাজারের বেশি রাজনৈতিক বন্দি আছে। জেলে বন্দিদের সাথে অমানবিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। নিয়মিত বিরতিতে সেখানে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। আবার কারাগারেও ক্ষুধা ও চিকিৎসার অভাবে বহু বন্দি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, নতুন এই যুদ্ধবিমান বিক্রির ঘটনা মিসরের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসির বর্বর নিপীড়নের পথকে আরো প্রশস্ত করবে। এর আগে সিসির বিরুদ্ধে একই অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই বছর মিসরের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রেখেছিল।

ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি বলছেন, এ চুক্তিটি নিছক বিমান ক্রয় সংক্রান্ত নয় বরং এটি একটি কৌশলী অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কের সূচনা মাত্র। এ চুক্তি অনুযায়ী সবকিছু ঠিকমতো অগ্রসর হলে আগামী ৩ বছরে ফ্রান্সে প্রায় ৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আর ফ্রান্স খুব আগ্রহ নিয়েই মিসরের সাথে এ চুক্তিটি করেছে। কারন ফ্রান্স ও মিসর উভয় রাষ্ট্রই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

মিসরীয় প্রেসিডেন্ট সিসি যখন প্যারিস সফরে যান, তখনও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফ্রান্সের সমালোচনা করেছিল। সিসিকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য ফরাসি প্রশাসনেরও নিন্দা করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন এসব সমালোচনাকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না না। উল্টো তিনি বলেছেন, তার সরকার মিসরের আভ্যন্তরীন মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে করে না। তার মতে মিসর গোটা অঞ্চলে উগ্রবাদী ইসলামের প্রতিরোধে এবং সন্ত্রাস মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে।

প্যারিসের সাথে মিসরের সামরিক সখ্যতাও বেশ পুরনো। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ফ্রান্স ছিলো মিসরের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। সে সময়ে ফ্রান্স মিসরের কাছে ২৪টি রাফালে বিমান বিক্রি করে। যদিও মিসরের হাতে এত বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র কেনার মতো অর্থ নেই। এ যাত্রায় মিসরকে ফ্রান্স ঋণ হিসেবে বিমানগুলো দিচ্ছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মিসর সেই ঋণ আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ম্যাক্রন বলছেন, মিসরের সাথে আমাদের ইতোপূর্বেও চুক্তি ছিল। তাই মিসরকে আমরা বিশ্বস্ত ক্রেতা হিসেবেই গণ্য করি। তবে ঋণ পরিশোধে তারা কতটা কথা রাখতে পারবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। তাই ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আমাদের মধ্যে ভবিষ্যতেও আরো খোলামেলা আলোচনা হবে।

মার্কিন প্রশাসনের সাথে মিসরের সেনাবাহিনীর সরাসরি সম্পর্কে না জড়ানোর ফায়দা নিতে চেয়েছিল রাশিয়া। তারা মিসরের কাছে অনেক ধরনের সমরাস্ত্র বিক্রি করতে চেয়েছিল। রাশিয়া ও মিসরের সরকার ২০১৪ সালে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তিতেও সম্মত হয়েছিল। যার আওতায় রাশিয়া ৪৬টি কেএ-ফিফটি টু এট্যাক হেলিকপ্টার এবং ৪৬টি মিগ-টোয়েন্টি নাইন যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে। রাশিয়ার পাশাপাশি মার্কিন নীরবতার সুযোগ নিয়ে ফ্রান্সও মিসরের কাছে রাফালে বিক্রি নিয়ে দৌড়ঝাপ শুরু করে।

২০১৫ সালে রাফালের প্রথম আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক ক্রেতা হিসেবে মিসরই ২৪টি বিমান অর্ডার করে। ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অংকের সে চুক্তির আওতায় বিমানের পাশাপাশি মাল্টি পারপাস ফ্রিগেট, মিসাইলও সরবরাহ করার কথা চুড়ান্ত হয়। একই সময়ে মিসর সরকার রাশিয়ার সাথেও ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি করে- যার আওতায় রাশিয়া মিসরকে দুই ডজন এসইউ থার্টি ফাইভ বিমান দিতে সম্মত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পাওয়ায় মিসরীয় সরকার এখন নানাদিকে উঁকিঝুঁকি মারছে। বিগত কয়েক বছরে মিসর মিগ-টোয়েন্টি নাইন, রাফালে, কেএ-ফিফটি টু গান শিপসহ অত্যাধুনিক নানা অস্ত্র কিনতে অগ্রসর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কাগজে কলমে মিসরে সমরাস্ত্র বিক্রির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্যান্য উৎস থেকে মিসরের অস্ত্র সংগ্রহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

মিসরীয় বিমান বাহিনীর অনেকদিন থেকেই নতুন কিছু বিমানের প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধবিমান বিক্রেতা দেশগুলো তাকিয়ে ছিল, মিসর বিমানের ঘাটতি দূর করার জন্য কোনটাকে বেছে নেয়। এসইউ থার্টি ফাইভ না রাফালে? শেষ পর্যন্ত মিসর রাফালের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহকারীরা বড়ো আকারের হোচট খেলো। যদিও কায়রোর এ সিদ্ধান্ত নেয়ার নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন চাপ যে ছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কেননা মার্কিন প্রশাসন আগে থেকেই কায়রো সরকারকে হুমকি দিয়ে আসছিল যে, যদি তারা আর একটিও এসইউ থার্টি ফাইভ বিমান ক্রয় করে তাহলে দেশটির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাটসা অবরোধ আরোপ করতে বাধ্য হবে।

এই হুমকি নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও মিসরকে হুমকি দিয়েছিলো, এ অঞ্চলে যে দেশ রাশিয়ার কোনো সিস্টেম ক্রয় করবে, তার ওপর অবধারিতভাবে কাটসা অবরোধ চলে আসবে। কাটসা বলতে বোঝায় কাউন্টারিং আমেরিকাস এডভারসারিজ থ্রু স্যাংকশন অ্যাক্ট। যে সব দেশ আমেরিকার প্রতিপক্ষ কোনো দেশ বিশেষ করে রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে কোনো অস্ত্র বা প্রতিরক্ষা সিস্টেম ক্রয় করবে তাদেরকে ওয়াশিংটন শত্রুপক্ষ হিসেবে গন্য করবে।

অবরোধের ঝুঁকি এড়াতে মিসর ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া যুদ্ধবিমান হিসেবে রাফালেও যথেষ্ট উন্নত। রাফালেতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি সংযুক্ত আছে। যার মাধ্যমে বিমান এয়ার টু এয়ার মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারবে। বিমানগুলো থেকে ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা যাবে। তাছাড়া এ বিমানগুলোতে এএএসএম হ্যামার মিউনিশন থাকায় গোলা বারুদ ও বিস্ফোরক নিক্ষেপেও রাফালে বেশ কার্যকর।

অন্যান্য আরব দেশগুলোর মতো মিসরীয় বিমান বাহিনীও নানা ধরনের বিমান ব্যবহার করে। দেশটির বিমান বাহিনীর হাতে এসইউ থার্টি ফাইভ এসই, রাফালে ডিই, মিগ টোয়েন্টি নাইন, মিরেজ টু থাউসেন্ড, এফ সিক্সটিন ধরনের ভারী বিমান আছে। আবার আলফা জেটের মতো হালকা ধরনের যুদ্ধবিমানও রয়েছে। মিসরীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের বহরেও পশ্চিমা ও রাশিয়ার তৈরি হেলিকপ্টার আছে। মিসর একমাত্র দেশ যারা রাশিয়ার কেএ-ফিফটি টু এ্যালিগেটর এবং আমেরিকার তৈরি এএইচ-সিক্সটি ফোর এ্যাপাচে হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে।