পরনির্ভরশীল অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তি


  • মেহেদী হাসান
  • ১২ মে ২০২১, ১৫:১৩

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান বিশ্বে ১৯তম। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তি মূলত যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভর। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া আর্মির মূল ভিত্তি তাদের বিমানবাহিনী। আর বিমানবাহিনীর প্রায় সব বিমান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। স্থলবাহিনীর মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে সব ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, বেলজিয়াম, কানাডা ও দক্ষিণ আফ্রিকার তৈরি। শুধুমাত্র নেভিতে ফ্রিগটেসহ কিছু রণতরি নির্মাণে সক্ষম অস্ট্রেলিয়া।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র অস্ট্রেলিয়া। ভারতও চীনবিরোধী লড়াইয়ে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। অস্ট্রেলিয়াও চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে। উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারি বোমারু বিমান অবতরণের লক্ষ্যে বিমানবন্দর সংস্কারসহ নানা ধরনের সামরিক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন চীনবিরোধী লড়াইয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামার ঘোষণা দেন। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে চীনের উত্থান আর আধিপত্য মোকাবিলায় ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। কেবলমাত্র চীনকে মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়া ১৮৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এ বাজেট বরাদ্দের ঘোষণা দেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মরিসন বলেছেন, ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া অন্যতম খেলোয়াড়। চীনবিরোধী দ্রুত ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া আর্মি আরো ঝুকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।

করোনা অতিমারির মধ্যেও অস্ট্রেলিয়া শতকরা ৯ ভাগ বাড়িয়েছে সামরিক বাজেট। ২০২০-২১ অর্থ বছরে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাজেট ৪৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ দেশ অস্ট্রেলিয়া কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। অস্ট্রেলিয়ার মোট সৈন্য সংখ্যা ৮০ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য ৬০ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ২০ হাজার।

সমুদ্রবেষ্টিত আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারনে অন্যান্য দেশের আর্মির সাথে ব্যবধান রয়েছে অস্ট্রেলিয়া আর্মির। অস্ট্রেলিয়ান আর্মির মূল শক্তি তাদের বিমান বাহিনী। তবে বর্তমানে তারা ব্যাপক শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে নৌ, মিসাইল এবং সমর প্রযুক্তি।

অস্ট্রেলিয়ার মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৪২৫টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ৭৫টি, ডেডিকেটেড অ্যাটাক ১৯টি। সামরিক পরিবহন বিমান রয়েছে ৩৮টি। প্রশিক্ষন বিমান ১২৩টি। স্পেশাল মিশন ৩১টি, ফুয়েল ট্যাঙ্কার ৬টি। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক হেলিকপ্টার সংখ্যা ১৩৩টি। এর মধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ২২টি। আসুন জেনে নেই অস্ট্রেলিয়ার বিমান বাহিনীর আরো কিছু তথ্য।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার রয়েছে ৩৩টি। অস্ট্রেলিয়া মোট ৭২টি এ বিমান সংগ্রহের অর্ডার দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৮ হরনেট রয়েছে ৫৩টি। এটি একটি সুপারসনিক বহুমুখী যুদ্ধ বিমান। ২ ইঞ্জিন বিশিষ্ট এফ-১৮ হরনেট একটি এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল অ্যাটাক এয়ারক্রাফট।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং নির্মিত এফ-১৮ সুপার হরনেট রয়েছে ১৮টি। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি শক্তিশালী ফাইটার জেটের তালিকায় রয়েছে বোয়িং সুপার হরনেট বিমানের নাম। এটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি সুপারসনিক বহুমুখী ফাইটার জেট। এর রয়েছে এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধ বিমান।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৬টি এয়ারবর্ণ আর্লি ওয়ার্নিং এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম বিমান রয়েছে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং নির্মিত। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১১টি বোয়িং নির্মিত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১৪টি শক্তিশালী বহুমুখী মেরিটাইম টহল বিমান রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি বোয়িং পি-৮ পজিডন। আরো ২টি পি-৮ পজিডন অর্ডার দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। লকহিড নির্মিত এপি ৩সি অরিয়ন রয়েছে ২টি। এটি একটি চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট শক্তিশালী মেরিটাইম টহল বিমান।

অস্ট্রেলিয়ার সামরিক পরিবহন বিমানের মধ্যে রয়েছে বোয়িং সি-১৭ গ্লোব মাস্টার, লকহিড সি-১৩০ সুপার হারকিউলিস। অস্ট্রেলিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সুইডেন এবং এয়ারবাসের তৈরি বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী হেলিকপ্টার রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার স্থলবাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিখ্যাত চিনুক, ব্ল্যাক হক ছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি এবং ব্রিটেনের তৈরি বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার রয়েছে। এয়ার ফোর্সের কাছে রয়েছে ইতালীর শক্তিশালী অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার। অস্ট্রেলিয়া সামরিক বিমান যেসব এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বহন করে তা সবই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

অস্ট্রেলিয়ার স্থলবাহিনী এবং নৌ বাহিনীর শক্তি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। অস্ট্রেলিয়ার ট্যাঙ্ক সংখ্যা ৫৯টি। সাজোয়া যান ৩ হাজার ৫০টি। টাউড আর্টিলারি ৫৪টি। অস্ট্রেলিয়ার মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক আবরাম যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আরমারড পারসোনাল ক্যারিয়ার অস্ট্রেলিয়া কানাডার সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আরমারড পারসোনাল ক্যারিয়ার রয়েছে ৪৩১টি। মাল্টিরোল ফাইটিং ভিহিক্যাল জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের তৈরি।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আরমারড রিকোভার ভিহিক্যাল রয়েছে ১৩টি। অস্ট্রেলিয়া ইউটিলিটি, রিকনস্যিান্স এবং সাপোর্ট ভেহিক্যাল তৈরি করতে পারে। এছাড়া এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন, জার্মানি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার তৈরি বিভিন্ন ধরনের ভেহিক্যাল, ট্রাক ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫৪টি হাউইজার রয়েছে। এগুলো ব্রিটেনের তৈরি। অস্ট্রেলিয়ার স্থলবাহিনীতে ফ্রান্স এবং জার্মানির তৈরি ৬৩টি হেলিকপ্টার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক হক রয়েছে ২০টি এবং চিনুক রয়েছে ১০টি।

চীনের তৈরি ফ্যান্টম-৪ ড্রোন রয়েছে ৩৫০টি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ব্যাটল ফিল্ড সার্ভিল্যান্স ড্রোন রয়েছে ১০টি। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমফিভিয়াস কার্গো ভিহিক্যাল রয়েছে ১৫টি।

অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রিয়ার সাথে এসল্ট রাইফেল তৈরি করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রিটেন এবং বেলজিয়ামের তৈরি বিভিন্ন ধরনের এসল্ট রাইফেল, ব্যাটল রাইফেল ব্যবহার করে। অস্ট্রেলিয়ার হেভি এবং হালকা সব ধরনের মেশিন গান বেলজিয়াম এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আর্মির অন্যান্য ক্ষুদ্রাস্ত্র জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

অস্ট্রেলিয়ার মোট রণতরীর সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে হেলিকপ্টার কেরিয়ার ২টি। ডেস্ট্রয়ার ৩টি। ফ্রিগেট ৮টি। সাবমেরিন ৬টি। টহল জাহাজ ১৩টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ৬টি। অস্ট্রেলিয়ার ৬টি কলিন ক্লাস সাবমেরিন সুইডেন কর্তৃক নকশাকৃত । এগুলো নির্মিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।

অস্ট্রেলিয়ার দুটি হেলিকপ্টার ডকের একটি স্পেনের তৈরি। আরেকটি ব্রিটেনের কাছ থেকে ক্রয় করা।

অস্ট্রেলিয়ার কাছে আনজাক ক্লাসের ৮টি ফ্রিগেট রয়েছে। এগুলো অস্ট্রেলিয়ার টেনিক্স ডিফেন্স সিস্টেম নির্মাণ করেছে। এছাড়া টহল জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট রণতরী, অয়েল ট্যাঙ্কার অস্ট্র্রেলিয়া নির্মাণ করে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩০টি স্বল্প পাল্লার ম্যান পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। এগুলো সুইডেনের তৈরি।

ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের উত্থান আর আধিপত্য মোকাবেলায় ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। কেবলমাত্র চীনকে মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়া ১৮৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাজেট বরাদ্দ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ভবিষ্যতে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল হলো ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। এ অঞ্চল ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত লড়াইয়ে অংশ নেবে অস্ট্রেলিয়া। চীনের উত্থান মোকাবেলায় সম্ভাব্য সকল পদপেক্ষ গ্রহণ করবে অস্ট্রেলিয়া। মরিসন বলেছেন চীনের কারনে ভয়াবহ অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া।

চীনকে মোকাবেলায় ডিফেন্স স্ট্রাটেজি বা প্রতিরক্ষা কৌশলের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া বড় ধরনের পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে।

চীন বিরোধী বরাদ্দকৃত ১৮৭ বিলিয়ন ডলার থেকে অস্ট্রেলিয়া উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করবে অ্যান্টি-শিপ মিসাইলসহ দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল সংগ্রহে। এছাড়া উদ্ভাবন করবে হাইপারসনিক মিসাইল। একই সাথে স্যাটেলাইট সার্ভিলেন্স, উচ্চ গতির প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং গবেষণা খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

২০২০ সালের ১ জুলাই অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স একাডেমিতে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ১৮৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সংগ্রহ তালিকা এবং ডকুমেন্ট প্রকাশ করেন। বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করবে বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ পাল্লার অ্যান্টি-শিপ মিসাইল। এজিএম-১৫৮সি মিসাইলের আওতা ৩৭০ কিলোমিটার। এ মিসাইল স্থাপন করা হবে সুপার হরনেট ফাইটার জেটে। এছাড়া এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানেও এ মিসাইল স্থাপন করা হবে। ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হবে গবেষণা এবং হাইপারসনিক মিসাইল উদ্ভাবনে।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যেসব উচ্চ গতির দীর্ঘ পাল্লার আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র অর্জন করেছে সে ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে চায় অস্ট্রেলিয়া। এ অঞ্চলে তার মিত্রদের রক্ষায় অস্ট্রেলিয়া সাগরতলে হাই-টেক সেন্সর সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করবে যাতে করে শত্রু রাষ্ট্রের মেরিটাইম কার্যক্রম সনাক্ত করা যায়। অস্ট্রেলিয়া গুরুত্ব দেবে ড্রোন সাবমেরিন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে। ২০৩০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া কমক্ষে ১২টি নতুন অ্যাটাক সাবমেরিন অর্জন করবে।

স্কট মরিসন বলেছেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌছেছে। কিন্তু তারাই একমাত্র খেলোয়াড় নয় আর অস্ট্রেলিয়া এ খেলায় কোনো দর্শক মাত্র নয়। অবশই এ খেলায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ আছে অস্ট্রেলিয়ার।