দক্ষিণ কোরিয়ার স্টেলথ যুদ্ধবিমান নিয়ে আলোচনা


  • মুসফিক মাহমুদ
  • ০৩ মে ২০২১, ০৮:৫৬

চীনের সাথে পাল্লা দিতে এবার বিশ্বব্যাপী সুপারসনিক যুদ্ধবিমান প্রস্তুতকারী দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে অভিজাত দক্ষিণ কোরিয়া। চতুর্থ প্রজন্মের চেয়েও অগ্রসর ‘কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান’ ফাইটার জেট তৈরি করেছে দেশটি। নিজস্ব উদ্ভাবিত সুপারসনিক যুদ্ধবিমানটি এরইমধ্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে।

চীন ও উত্তর কোরিয়ার বিপরীতে নিজস্ব প্রতিরক্ষা জোরদারের কৌশল হিসাবে এই যুদ্ধবিমান বানানোর দিকে নজর দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। পাশাপাশি ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ কর্মসূচির লক্ষ্য যুদ্ধবিমান রফতানির বাজার ধরা। বোরামাই নামে পরিচিত ‘কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান’ জেট বিমানটিতে থাকবে কয়েক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। এমনকি দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তেও সক্ষম বিমানটি। দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এ যুদ্ধবিমানে থাকবেন একজন পাইলট। তবে মিশনের গুরুত্ব বুঝে দু’জন রাখার সুযোগও রয়েছে। তবে এই বিমানের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর রাডার। অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম এবং ইনফ্রারেড সুবিধা থাকায় আকাশে যেকোনো ধরনের বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে পারবে কেএফ টোয়েন্টি ওয়ান। এমনকি ভূমিতে সবচেয়ে ক্ষুদ্র টার্গেটেও শতভাগ লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব এই রাডারের মাধ্যমে।

প্রায় ২০ বছর আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম দেই জুং এর শাসনামলে অ্যাডভান্স ফাইটার জেট নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। প্রতিবেশি চীরবৈরী উত্তর কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা নিরসনে ‘সানশাইন প্রকল্প’ হাতে নেয়ায় শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন তিনি। কয়েক দফা যাচাই-বাছাই, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরের পর অবশেষে ২০১৬ সালে এই যুদ্ধবিমান নির্মাণ শুরুর ঘোষণা দেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন।

প্রকল্প উদ্বোধনের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন বলেন, স্বাধীন প্রতিরক্ষার এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এটি বিমান শিল্পের উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। ২০২৮ সালের মধ্যে ৪০টি এবং ২০৩২ সালের মধ্যে ১২০টি যুদ্ধবিমান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করেছে সিউল। এরআগে ছয়টি প্রটোটাইট ফাইটার দিয়ে চলবে অন্তত ২ হাজার পরীক্ষা পরীক্ষা।

কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এ প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়ার মালিকানা ৮০ শতাংশ আর ইন্দোনেশিয়ার মালিকানা বাকি ২০ শতাংশ। এছাড়া এই প্রকল্পের সাথে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার ৭শ’র বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হলে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন।

কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান’ যুদ্ধবিমানটি সম্পূর্ণ দক্ষিণ কোরিয়ার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। দক্ষিণ কোরিয়া এখন বিদেশি সাহায্য ছাড়াই উন্নতমানের যুদ্ধবিমান তাদের বহরে যুক্ত করতে সক্ষম। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দেশটির সাথে সামরিক চুক্তির অংশ হিসেবে, এম-সিক্সটিন রাইফেল থেকে শুরু করে ভারী আর্টিলারি এবং এফ-সিক্সটিন যুদ্ধবিমানের মতো অস্ত্রও পেয়ে থাকে দেশটি। এছাড়া নিজস্ব প্রযুক্তিতে অস্ত্র উদ্ভাবন এবং রফতানিও করে থাকে। তবে চতুর্থ প্রজন্মের চেয়েও অগ্রসর ’কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান ফাইটার জেট তৈরীর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে সামরিক সক্ষমতায় পশ্চিমা ছায়া থেকে সরে আসতে চায় সিউল।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিমানগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ যুদ্ধবিমান এফ-থার্টি ফাইভ এর সমান শক্তিশালী কিন্তু দামে সস্তা। দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বহরে বর্তমানে মার্কিন এফ-ফিফটিন, এফ-সিক্সটিন রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব বিমানের স্থলাভিষিক্ত হবে কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান ফাইটার জেট ফাইটার।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম পিস রিসার্চ ইন্সটিউটের গবেষক পিয়েটার ওয়েজম্যান মনে করেন , সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব সমরাস্ত্র তৈরী এবং ব্যবহারের অর্থই হলো প্রতিযোগীদেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করা।

সিপরির হিসাব বলছে, গত ২০ বছরে অস্ত্র আমদানি এবং রফতানিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২০ সালে অস্ত্র রফতানিতে ৩১তম অবস্থানে থাকলেও মাত্র ২ দশকে তালিকার ৬ষ্ঠ অবস্থানে উঠে এসেছে দেশটি। এরমধ্যে রয়েছে সাজোয়া যান, ট্যাঙ্ক এবং প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানের মতো অস্ত্র। সেক্ষেত্রে বাকি ছিলো যুদ্ধবিমান। সেই চাহিদা পুরণ করা হবে কেএফ টোয়েন্টি ওয়ান রফতানি করে। এই যুদ্ধবিমানের বাজার হতে পারে আফ্রিকা, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে। এরমধ্যে রয়েছে ইরাক, কাতার, পেরু, মালয়েশিয়া, সেনেগাল এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশ।

২০১৪ সালের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে সিউলের জন্য। ওই চুক্তির ফলে মানবতাবিরোধী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে না সরবরাহকারী দেশগুলো। যার কারণে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। আর সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছে দক্ষিণ কোরিয়া।

এরইমধ্যে রিয়াদের কাছে রে-বোল্ট অ্যান্টি ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে সিউল। যা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। এবার কে এফ টোয়েন্টি ওয়ান দিয়ে সেই বাজার ধরতে চাইছে দক্ষিণ কোরিয়া। সেসব দেশ বেশি দামের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা ফ্রান্সের ফাইটার জেট কিনতে পারছে না, তাদের জন্য বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে কোরিয়ান এই বিমান।

অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি উত্তর কোরিয়া। এরপর রয়েছে চীন। পিয়ংইয়ংয়ের সাথে শান্তিচুক্তি এবং দফায় দফায় সমঝোতা হলেও পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ রাখেনি উত্তর কোরিয়া। এর পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে ঘিরে দিনকে দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সিউল-বেইজিং সম্পর্ক। বিতর্কিত সমুদ্রসীমায় চীনের নিজের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। । চীনের বিরুদ্ধে শক্ত জবাব দিতেই এবার কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান নিয়ে মাঠে নামছে দক্ষিণ কোরিয়া। চীনের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান, চেংদু -জে টোয়েন্টি ফাইটার জেটের বিপরীতে মোতায়েন করা হবে কেএফ-টোয়েন্টি ওয়ান।

কেএফ-২১ বোরেমায়ে নির্মান করছে কোরিয়ান এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এ বিমান নির্মানের খরচ ধরা হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার। এর ২০ ভাগ অর্থ পরিশোধ করবে ইন্দোনেশিয়া। বিনিময়ে ইন্দোনেশিযাকে ৪৮টি কেএফ-২১ ফাইটার জেট এবং এর প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে। ২০২৮ সালে এ বিমান কোরিয়ান সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার কথা। আগামী বছর জুলাই মাসে এর ফ্লাইট টেস্ট শিডিউল নির্ধরণ করা হযেছে।

কে এফ-২১ একটি চার দশমিক ৫ জেনারেশন ফাইটার জেট। এটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের সমান ক্ষমতা সম্পন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিফথ জেনারেশন এফ-৩৫ এর তুলনায় কিছুটা কম চৌকস। কে এফ- ২১ একটি এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু গ্রাউন্ড এটাক বিমান।

বিমানটির গতি ম্যাক ১ দশমিক ৮। টেক অফ ক্ষমতা ২৫ হাজার ৬শ কেজি। বিমানটির দৈর্ঘ্য ৫৫ ফিট ৫ ইঞ্চি। বিমানটির ৬৫ শতাংশ উপকরণ দক্ষিণ কোরিয়ার তৈরি। এর ইঞ্জিন জেনারেল ইলেকট্রিক।