এফ-৩৫ নিয়ে নতুন জটিলতা, বেড়েছে ইঞ্জিনের দাম


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৩ মে ২০২১, ০৮:৩৬

তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বছর আগে থেকেই একসাথে একটি এফ-৩৫ বিমান প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। তুরস্ককে সে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার সাথে দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। তুরস্কে বিমানের ইঞ্জিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এত সব কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল তুরস্ককে কোণঠাসা করা। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা খাতের ওপর। বিশ্ববাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে বিমানের ইঞ্জিনের দাম।

২০১৯ সালে তুরস্ককে এফ-৩৫ বিমান প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার পর এফ-৩৫ বিমানের ইঞ্জিনের দাম এ পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাট অ্যান্ড হুইটনির সামরিক ইঞ্জিন ডিভিশনের প্রধান ম্যাথিউ বোমবার্গ সম্প্রতি হাউজ আর্মড সার্ভিসেস কমিটির শুনানিতে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রাট অ্যান্ড হুইটনি হলো এফ-১৩৫ ইঞ্জিনের উৎপাদক। আর এ ইঞ্জিন লকহিড মার্টিন উদ্ভাবিত এফ-৩৫-এর তিন ধরনের ফাইটার বিমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। শুরুতে এই ইঞ্জিনটি ১৮৮টি ছোটখাটো পার্টসের সমন্বয়ে তৈরি হতো। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ পার্টস যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বাজারেই পাওয়া যেতো। আর বাকি ২৫ শতাংশ পার্টস সরবরাহ করতেন তুরস্কের ঠিকাদারেরা। এই পার্টস ইঞ্জিনের জন্য খুবই জরুরি ছিল। আর তুরস্কের ঠিকাদাররা খুবই কম দামে ভালো মানের পার্টস সরবরাহ করতে পারতেন।

প্রাট অ্যান্ড হুইটনি আশা করছে, তুরস্ক যে ২৫ শতাংশ ইঞ্জিনের পার্টস সরবরাহ করতো তারা চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে সেই পার্টসগুলোও সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করবে। সেক্ষেত্রে ২০২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী বিমানের যে ১৫টি লট বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা, সেগুলোর নির্মাণ কিছুটা সমস্যার মুখে পড়বে। ২০২১ সালের পর থেকে এফ-৩৫-এর ইঞ্জিনের অবশিষ্টাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ পার্টস আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রেতারা নিজেরাই বানিয়ে নিতে পারবে।

ইঞ্জিনের ২৫ শতাংশ পার্টস ছাড়াও তুরস্ক জেট বিমানগুলোর প্রায় ২৪ হাজার এয়ারফ্রেম পার্টস উৎপাদন করে। পাশাপাশি তুরস্ককে যুদ্ধ বিমানগুলোর ইঞ্জিনের প্রোপালসন সিস্টেম তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। যারমধ্যে ইলেকট্রনিক ওয়্যারিং হারনেস, কম্প্রেসর রোটর হাবস, ব্রাকেট এ্যাসেম্বলি এবং এয়ার টার্বাইনের জন্য সিলগুলো তৈরি করারও দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

তুরস্কের ওপর অবরোধের পরও চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০২২ সাল পর্যন্ত তুরস্ককে এ কাজগুলো করে যেতে হবে। তুরস্কের সরবরাহকারীদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ায় এফ-৩৫-এর ইঞ্জিনের স্বল্পতা ভবিষ্যতেও থাকবে বলে অনেকে আশংকা করছেন। এর আগে গত বছর করোনা মহামারির কারণেও ইঞ্জিন ও বিমান নির্মাণ প্রকল্পটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

তুরস্ক অনেকআগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ বিমান প্রকল্পে যুক্ত ছিল। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই তুরস্কের মোট ১শটি এফ-৩৫ কনভেনশনাল মডেলও ক্রয় করার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এ প্রকল্প থেকে বাদ দেয়। প্রথম দিকে অবরোধের অংশ হিসেবে পেন্টাগন যুক্তরাষ্ট্রের সকল সামরিক প্রকল্প থেকে ২০২০ সালের মধ্যেই তুরস্কের সকল সরবরাহকারীকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু এমনটা করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সামরিক প্রকল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনুধাবন করার পর যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সাল পর্যন্ত তুরস্কের সরবরাহকারীদের কাজ করার সুযোগ দেয়।

মার্কিন আইন প্রণেতাদের কাছে একটি লিখিত বক্তব্যে এফ-৩৫ প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী লেফটেনেন্ট জেনারেল এরিক ফিক বলেন, পেন্টাগনের এফ-৩৫ যৌথ প্রকল্পটি এখনো প্রাট এন্ড হুইটনির সাথে কাজ করে যাচ্ছে। যাতে করে এফ-১৩৫ পরিচালনা এবং এফ-৩৫-এর এয়ার সিস্টেমকে যৌক্তিক বাজেটের মধ্যে সীমিত করে রাখা যায়।

ইঞ্জিনের দামটি বেড়ে যাওয়ায় এফ-৩৫ প্রকল্পের ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। সম্প্রতি, দুজন কংগ্রেসম্যান অতিরিক্ত জেট বিমান নির্মানের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ছাড় দেয়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেন। তারা অতীতের বাজেটের ঘাটতি ব্যয়ও টেনে না নেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। যদি কংগ্রেস বাজেট বৃদ্ধি না করে তাহলে এফ-৩৫-এর লজিস্টিক সিস্টেমের উন্নয়নও থমকে যেতে পারে।

লকহিড মার্টিনের এফ-৩৫ লাইটনিং হলো পঞ্চম প্রজন্মের আমেরিকান একটি সিংগেল ইঞ্জিন যুদ্ধ বিমান। এফ-৩৫কে মূলত সকল আবহাওয়ায় ও পরিবেশের জন্য কার্যকর স্টেলথ বহুমুখী ফাইটার জেট বিমান হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পুরনো মডেলের যুদ্ধবিমানগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন বিমান চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এফ-৩৫-এর যৌথ নির্মাণ প্রকল্প হলো তারই একটি অংশ। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রকল্পের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

মার্কিন এয়ার ডিফেন্স না কিনে রাশিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ওপর ভরসা রাখায় তুরস্ক আমেরিকার অসন্তোষের শিকার হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে, যদি তুরস্ক রাশিয়ার এয়ার সিস্টেমও ব্যবহার করে আবার একইসংগে মার্কিন এফ-৩৫ বিমানও ব্যবহার করে তাহলে এই দুই প্রতিপক্ষ সুপারপাওয়ারের দুটো সিস্টেমের যুগপৎ কার্যকর থাকার সুযোগ নিয়ে মস্কো এফ-৩৫ পরিচালনা কৌশল সংক্রান্ত গোপন তথ্যগুলো জেনে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর আনুষ্ঠানিকভাবে আবারও এফ-৩৫ বিমান প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বাদ দেয়ার কথা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র জেসিকা ম্যাক্সওয়েল বলেন, আমাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এস-ফোর হান্ড্রেড সিস্টেম কোনোভাবেই এফ-৩৫-এর সাথে সহাবস্থান করতে পারে না। তাই আমরা তুরস্কের সাথে এফ-৩৫ প্রকল্পটি স্থগিত করেছি। আমরা তুরস্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রক্রিয়া থেবে বাদ দিয়ে বর্তমানে প্রকল্পটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সাথে সাক্ষরিত চুক্তিটিকে বাতিল করে অস্ট্রোলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সাথে এফ-৩৫ বিষয়ে নতুন করে চুক্তি সাক্ষর করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ককে বাদ দিয়ে সম্প্রতি নতুন করে চুক্তিটি করা হয়। কার্যত তুরস্ককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই। সে মাসেই প্রথম তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস ফোর হান্ড্রেডের ব্যাটারির চালান গ্রহণ করেছিল।

এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেসের চাপে তুরস্কের ওপর অবরোধও আরোপ করেন। এই অবরোধের কারণে শুধু ইঞ্জিনের দামই বৃদ্ধি পায়নি বরং পাশাপাশি পাওয়ার মডিউলেরও ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে যা সার্বিকভাবে এফ-৩৫ প্রকল্পকেই বাঁধাগ্রস্ত করেছে। গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ২১টি এফ-৩৫ ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে জরুরিভিত্তিতে অবতরণ করতে বাধ্য হয়। আশা করা হচ্ছে, ইঞ্জিনগুলো মেরামত করতে পারলে এই ২১টি বিমানের মধ্যে ১৫টিই আবারও সফলভাবে উড্ডয়ন করতে পারবে।

সাধারণভাবে অধিকাংশ ফাইটার ইঞ্জিন প্রকল্পগুলোতে স্পেয়ার পার্টস এর রেশিও থাকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। স্পেয়ার পার্টসগুলো এই পরিমানে রাখা হয় যাতে ফ্লাইট লাইনে কিংবা ডিপোতে এগুলো মজুদ থাকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এফ-৩৫ প্রোগ্রামে স্পেয়ার পার্টস এর রেশিও আছে মাত্র ১০-১২ শতাংশ। এ হার চলমান থাকলে স্পেয়ার পার্টস এর সংকটেও প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এফ-৩৫ প্রকল্পের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো, এই বিমানগুলো আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার পর থেকে এর স্পেয়ার পার্টস নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা ও অর্থায়ন করা হয়নি। স্পেয়ার পার্টস এর পুরো বিষয়টাই অনুমানের ওপর ভর করে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এফ-১৩৫-এর ইঞ্জিনের ডিপোটি রয়েছে ওকলাহোমার এয়ারফোর্স বেইসে।