বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ৬ ফাইটার জেট


  • মেহেদী হাসান
  • ২১ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৫

বিশ্বের বিভিন্ন সামারিক গবেষণা সংস্থা দীর্ঘদিন শীর্ষ ফাইটার জেটের তালিকা করে আসছে। সব সংস্থার তালিকায় বিশ্বের মোস্ট অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‌্যাপ্টর অথবা এফ-৩৫। এরপর কোনো কোনো সংস্থার তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকে চীনের চেংদু জে-২০ অথবা রাশিয়ার এসইউ-৫৭। এছাড়া তালিকায় চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে ঘুরে ফিরে স্থান পায় ফ্রান্সের রেফালে, ইউরোপের টাইফুন অথবা বোয়িং সুপার হরনেট। আবার কোনো কোনো সংস্থার তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ অ্যাডভান্সড ফাইটার জেটের তালিকায় চীনের শেনিয়াং এফসি-৩১, যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬, এফ-১৫ ঈগলকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনেক সংস্থার তালিকায় বর্তমান বিশ্বের মোস্ট অ্যাডভান্সড ফাইটার জেটের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে এফ-২২ র‌্যাপ্টর। যুক্তরাষ্ট্র এ বিমান অন্য কোনো দেশে বিক্রি করে না। বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের সাথে এ বিমান নির্মাণে যুক্ত রয়েছে বোয়িং।

এফ-২২ একটি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার। এ বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৯৭ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মোট ১৯৫টি এ বিমান রয়েছে। এফ-২২ এর ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। এর রয়েছে এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু গ্রাউন্ড, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সিগনাল ইন্টেলিজেন্স ক্যাপাবিলিটি।

সুপারসনিক এফ ২২ এর গতি ম্যাক ২ দশমিক দুই পাঁচ। ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫শ মাইল। বিমানটির ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। মেক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ৩৮ হাজার কেজি। দৈর্ঘ্য ৬২ফিট ১ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৪৬ ফিট ৬ ইঞ্চি।

লহহিড মার্টিনের বহুল আলোচিত এফ-৩৫ বিমানও বর্তমান বিশ্বের মোস্ট অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট হিসেবে পরিচিত। এ বিমান ১২টি বি৬১ পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম। এটিও যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফিফথ জেনারেশন মাল্টিরোল স্টেলথ ফাইটার।

এয়ার সুপেরিয়রিটি এবং স্ট্রাইক মিশন উভয় দক্ষতা রয়েছে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানের। রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইন্টেলিজেন্স, সাভির্লেন্স এবং রিকনিসেন্স ক্ষমতা।

সুপারসনিক এফ-৩৫ এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং শক্তিশালী এন্টি শিপ মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ।

এফ-৩৫ এর ইঞ্জিন সংখ্যা ১টি। লকহিড মার্টিন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নরথ্রপ গ্রুম্যান এবং ব্রিটেনের বিএই সিস্টেম এ বিমান নির্মাণের সাথে যুক্ত। জয়েন্ট স্ট্রাইফ ফাইটার এফ-৩৫ নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালী, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং তুরস্ক। এফ-৩৫ সম্পূর্ণ ভার্টিক্যাল উপায়ে উডডয়ন এবং অবতরণ করতে পারে। এমনিক পেছনেও চলতে সক্ষম এ বিমান।

এফ-৩৫ ফাইটার জেট ৯ হাজার ২ শ কেজি ওজনের সমরাস্ত্র বহন করতে পরে। এফ-৩৫ প্রথম আকাশে ওড়ে ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রথম সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র মেরিন কর্পস এ। এফ-৩৫ এর গতি ম্যাক ১ দশমিক ৬ । দৈর্ঘ্য ৫১ ফিট ৪ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৩৫ ফিট। ম্যা´িমাম টেক অফ ৩১ হাজার ৭৫১ কেজি।

আকাশে আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক জঙ্গি বিমান এফ-২২ র‌্যাপটরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাশিয়া তৈরি করে এসইউ-৫৭। রাশিয়া এ বিমানে যুক্ত করতে যাচ্ছে শব্দের চেয়ে ১০ গুন বেশি গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। হাইপারসনিক এ মিসাইলের থাকবে প্রচলিত এবং পারমাণবিক উভয় ধরনের বোমা বহনের ক্ষমতা।

অনেক বিশ্লেষকের মতে হাইপারসনিক মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হলে রাশিয়ার এসইউ-৫৭ হতে পারে বিশ্বের সবেচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার জেট। আর আকাশে হয়ে উঠবে এটি ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ বিমান।

২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারিতে প্রথম আকাশে ওড়ে এ বিমান। ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। এসইউ-৫৭ রাশিয়ার প্রথম ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ টেকনোলজি যুদ্ধ বিমান।

রাশিয়া এখন পর্যন্ত ১২টি এসইউ-৫৭ বিমান তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত একমাত্র রাশিয়া এ বিমানের ব্যবহারকারী। তবে রাশিয়া এ বিমান অন্য দেশে বিক্রি করবে। এটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সমুদ্রে মিসাইল ছুড়তে পারে।

রাশিয়ার এসইউ -৫৭ যুদ্ধ বিমানে রয়েছে সর্বশেষ এভিয়েশন টেকনোলজি। এর রয়েছে রাডার ফাঁকি দেয়ার এবং ত্বরিত বাক নেয়ার ক্ষমতা।

এসইউ-৫৭ এর সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ২ বা শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বেশি। ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি ১ হাজার ৩২০ মাইল। ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। মেক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ৩৫ হাজার টন। রয়েছে দেড় হাজার কেজি ওজনের গাইডেড বোমা বহনের ক্ষমতা। বিমানটির দৈর্ঘ্য ৬৫ ফিট ১১ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৪৬ ফিট ৩ ইঞ্চি। জ্বালানি ধারন ক্ষমতা ১০ হাজার ৩শ কেজি।

রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে এসইউ-৫৭ বিমানে হাইপারসনিক মিসাইল যুক্ত করার কথা। তাসের খবরে বলা হয় কিনজহাল মিসাইল যুক্ত হতে পারে এতে।

বার্তা সংস্থা তাস জানায় রাশিয়ার কিনজাহাল হলো বিশ্বে একমাত্র এয়ারবর্ণ হাইপাসনিক মিসাইল সিস্টেম। এটি এন্টি এয়ারক্রাফট এবং এন্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম । এ মিসাইল এর লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার কিলোমিটার।

চেংদু জে ২০ চীনের নিজস্ব তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। চেংদু জে ২০ একটি আলোচিত ফিফথ জেনারেশন মাল্টিরোল স্টেলথ ফাইটার। চীনে এটি পরিচিত মাইটি ড্রাগন হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা চেংদু জে ২০ কে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এফ-২২ ও এফ-৩৫ এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করেন। চেংদু জে ২০ এর সর্বশেষ ভার্সন হলো জে ২০ বি। এটি আরো বেশি শক্তিশালী।

চেংদু জে ২০ প্রথম আকাশে ওড়ে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৭ সালের মার্চে। ২০১৮ সালে তৈরি করা হয় জে ২০ কমব্যাট ইউনিট। চেংদুর ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। চেংদু জে -২০ এর গতি শব্দের চেয়ে ২ গুন বেশি বা ম্যাক ২। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ৩৭ টন।

চেংদুর দৈর্ঘ্য ৬৬ ফিট ৮ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৪৪ ফিট ২ ইঞ্চি। ৬৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে পারে চেংদু জে ২০। চেংদু জে ২০ এর নির্মাতা চেংদু এরো স্পেস করপোরেশন। এটি নির্মাণ করা হয়েছে এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার জেট হিসেবে। সব আবহাওয়ায় অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম এ বিমান। এর রয়েছে স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল বহন ক্ষমতা। রয়েছে প্রিসিশন স্ট্রাইক সক্ষমতা।

ফ্রান্সের রেফালে একটি ফোর প্লাস জেনারেশন বহুমুখী যুদ্ধ বিমান। এর রয়েছে শক্তিশালী এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু গ্রাউন্ড এবং এন্টি শিপ মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। রেফালের রয়েছে পরমানু বোমা বহনকারী মিসাইল ছোড়ারও ক্ষমতা। এছাড়া ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি বহুমুখী ফোর্থ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান। ইউরো ফাইটার টাইফুন এর যৌথ নির্মাতা ইউরোপের এয়ারবাস, ব্রিটেনের বিএই সিস্টেম এবং ইতালীর লিওনার্দো। টাইফুন সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৩ সালে। এটি একটি এয়ার সুপেরিয়রিটি বিমান। ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। এখন পর্যন্ত ৫৭১টি এ বিমান নির্মাণ করা হয়ছে।

রেফালেতে রয়েছে রাডার, লেজার এবং মিসাইল ওয়ানির্ং রিসিভার। এভয়নিক্স, রাডার এবং উইপন সিস্টেমের কারনে রেফালে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি যুদ্ধ বিমান হিসেবে বিবেচিত। একটি ফ্লাইটে একাধিক অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম রেফালে।

রেফালের শক্তি, ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা প্রমানিত। এর রয়েছে দীর্ঘ অপারেশন পরিচালনার ইতিহাস। ২০০১ সালে এটি ফ্রেন্স এয়ার ফোর্স ও নেভিতে যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া অভিয়ানে অংশ নিয়েছে রেফালে।

আকাশে ১০০ কিলোমিটার দূরের শত্রু বিমানকে মিসাইল আঘাত করতে সক্ষম রেফালে । রেফালে ভূমিতে আক্রমনের জন্য ব্যবহার করে দীর্ঘ পাল্লার ক্রুজ মিসাইল। এ ধরনের একটি মিসাইলের ওজন ১ হাজার ৩০০ কেজি। এ মিসাইলের আওতা ৬০০ কিলোমিটার এবং এর আঘাত ক্ষমতা নিখুত।

সুপারসনিক রেফালের ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। গতি ম্যাক ১.৮। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ২৪ টন ৫০০ কেজি। রেফালের দৈর্ঘ্য ৫০ ফিট। ইউং স্প্যান ৩৫ ফিট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৭ ফিট ৬ ইঞ্চি। শুধু বিমানটির ওজন ১০ টন ৩০০ কেজি। ৫০ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম রেফালে।

অপরদিকে ইউরো ফাইটার টাইফুন একটি সুপারসনিক ফাইটার জেট। সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ২। এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি-শিপ মিসাইল ছুড়তে সক্ষম এ বিমান। মিসাইল ছাড়াও প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী বোমা বহনের ব্যবস্থা রয়েছে এতে। ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ ৯টি দেশের কাছে রয়েছে এ বিমান।

ব্রিটেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৬০টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। জার্মানি ১৪৩টি, ইতালী ৯৬টি, স্পেন ৭৩টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। ইতালীর কাছে ৯৬টি, সৌদি আরবের কাছে ৭১টি ইউরো ফাইটার টাইফুন রয়েছে। ইউরোফাইটার টাইফুন প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৯৪ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৩ সালে।