যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীনের গোপন মেরিটাইম মিলিশিয়া। চীনের এ মেরিটাইম মিলিশিয়ার নাম ‘লিটল ব্লু মেন’। গোপন এ মিলিশিয়া বাহিনীতে রয়েছে শত শত রণতরী এবং হাজার হাজার শক্তিশালী সেনা। মাছ ধরার জাহাজ বা ফিশিং বোটের আড়ালে এসব মেরিটাইম মিলিশিয়ারা বিচরণ করছে দক্ষিণ চীন সাগরে। এরা চীনা আর্মির অংশ।
স্পার্টলি দ্বীপের কাছে গত মার্চের শেষে দুই শতাধিক মেরিটাইম মিলিশিয়া জাহাজ মোতায়েনের পর টনক নড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে এ গোপন মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীকে আগামী দিনে মোকাবিলা করতে হবে। ইতোমধ্যে চীনের লিটল ব্লু মেন নামের এই বাহিনী নিয়ে ফিলিপাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
দক্ষিণ চীন সাগরের চীনা দাবি করা বিভিন্ন দ্বীপ এবং সমুদ্র সীমা রক্ষায় চীন গড়ে তুলেছে এ মিলিশিয়া বাহিনী। চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনী যে রণতরী ব্যবহার করে তার রং নীল। পশ্চিমারা সে কারনে একে লিটল ব্লু মেন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যদিও চীন এমন বাহিনীর অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি করা বিতর্কিত বিভিন্ন দ্বীপ, প্রবাল প্রাচীর, মগ্নচড়া এবং সমুদ্র সীমায় দ্রুত গতিতে চীনা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে। আর সামরিক সংঘাত ছাড়া তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আর কোনো উপায় নেই।
হুইটসান প্রবাল প্রাচীরের চার দিকে হত মার্চে ২২০টি চীনা ফিশিং বোট জড়ো হওয়ার পর চীনা মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীর বিষয় সামনে আসে। হুইটসান প্রবাল প্রাচীর স্পার্টলি আইল্যান্ড চেইনের মধ্যে অবস্থিত। স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ, রিফ ও মগ্নচড়া চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ব্রুনাই এবং মালয়েশিয়ার দখলে রয়েছে।
ব্রুনাই এখানে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের দাবি করেছে। এসব দেশের মধ্যে স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জ ফিলিপাইন এবং চীন উভয়ে তাদের বলে দাবি করে আসছে।
ফিশিং বোটের নামে স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জে চীনা শত শত নীল রঙের রণতরী উপস্থিতির প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিপাইন। দক্ষিণ চীন সাগরে হুইটসান প্রবাল প্রাচীরে নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখা গেছে নীল রঙের রণতরী। হুইটসান প্রবাল প্রাচীরকে চীন নিউ জিয়াও নামে ডেকে থাকে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় দাবি করেছে ঝড়ো বাতাস থেকে রক্ষা পেতে কিছু ফিশিং বোট নিউ জিয়াও দ্বীপের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। ম্যানিলায় চীনা দূতাবাস জানায় সেখানে কোনো চীনা মেরিটাইম মিলিশিয়া ছিল না।
চীন অস্বীকার করলেও মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনী যে সত্য সে বিষয়ে নিশ্চিত পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদর দফরত পেন্টাগন এর নাম দিয়েছে পিপসল আর্মড ফোসের্স মেরিটাইম মিলিশিয়া।
ই্উএস প্যাসিফিক কমান্ডস জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক অপারেশন কার্ল সাস্টার বলেন, পিপলস আর্মড ফোসের্স মেরিটাইম মিলিশিয়া মাছ ধরে না। তাদের জাহাজে রয়েছে অটোমেটিক উইপন্স, রিইনফোর্সড হালস। আর ক্লোজ রেঞ্জে তারা খুবই বিপজ্জনক। তাদের এসব ব্লু জাহাজের গতি প্রতি ঘন্টায় ১৮ থেকে ২২ নটিক্যাল মাইল । বিশ্বের কোনো ফিশিং বোটের এত গতি নেই। ফিশিং বোটের গতি এর অর্ধেক।
যুক্তরাষ্ট্র নেভি, মেরিনস এবং কোস্ট গার্ডের ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনা এ মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীর কাজ হলো অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করা আর বেআইনী দাবি প্রতিষ্ঠা করা।
চীনা মেরিটাইম মিলিশিয়া চীনা আর্মির অংশ। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে গঠিত এবং সরাসরি চীনা আর্মি নিয়ন্ত্রিত।
এই বাহিনী চীনের ফিশিং ফ্লিটের সাথে যুক্ত। চীনা ফিশিং ফ্লিটে রয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বোট যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিশিং ফ্লিট। তবে মেরিটাইম মিলিশিয়ার প্রকৃত জাহাজের সংখ্যা কত সে বিষয়ে এখনো অন্ধকারে পশ্চিমারা। তাদের র্যাঙ্ক যা-ই হোক তারা চীন সরকারের নীতি এবং দক্ষিণ চীন সাগরসহ চীনা ভূখন্ডগত দাবি রক্ষায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে স্পার্টলি দ্বীপে অপারেশনের জন্য ২০১৬ সালে হাইনান প্রদেশে গঠন করা হয় একটি মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনী। এর জাহাজের সংখ্যা ৮৪টি।
গত মার্চে স্পার্টলি দ্বীপে যে পরিমান ব্লু জাহাজ দেখা দেখা গেছে তাতে তাদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। আর এদের সাথে হাইনান প্রদেশের মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীর মিল নেই। কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে হুইটসান প্রবাল প্রাচীরে যে মেরিটাইম মিলিশিয়া বোট দেখা গেছে তা এসেছে দক্ষিণের গুয়াংডং প্রদেশ থেকে। ২৯ মার্চ হুইটসন প্রবাল প্রাচীরের কাছে ৪৪টি মিলিশিয়া জাহাজ ছিল। বাকীগুলো ছড়িয়ে পড়ে কাছের অন্যান্য বিতর্কিত দ্বীপ এবং প্রবাল প্রাচীরের কাছে।
চীনা এসব মিলিশিয়া বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইনস এর ইনিস্টিটিউট অব মেরিটাইম এফেয়ার্স এর পরিচালক জে বাটোংবাকাল বলেন গত কয়েক বছরে চীন যা অর্জন করেছে তা হলো ১৩ লাখ বর্গমাইল দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটা চীন তাদের সমুদ্র সীমা বলে দাবি করছে। এসব মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে এখন তারা হুইটসান রিফ দখল করছে।
পুরো দক্ষিণ চীন সাগরে ডি ফ্যাক্টো নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই হলো চীনের উদ্দেশ্য এবং কৌশল।
চীনা এ বিপুলসংখ্যক মেরিটাইম মিলিশিয়া ফিশিং বোট মোকাবেলায় এখন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো বেশি ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন করতে হবে। ছোট ছোট বেশিসংখ্যক রনতরীর কারনে চীন এ সুবিধা পাচ্ছে। এ ধরনের জাহাজ নির্মান সহজ এবং খরচও কম। এদের সংখ্যা যত ইচ্ছা বাড়ানো যায়। আর এসব ছোট ছোট জাহাজ চ্যালেঞ্জ করাও কঠিন।
চীন বারবার অভিযোগ করে আসছে দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে উত্তেজনার মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারাই এখানে বার বার রনতরী এবং জঙ্গি বিমান পাঠাচ্ছে । আর কূটনৈতিক পর্যায়ে যুদ্ধবাজ কথাবার্তা বলছে।
গবেষকদের মতে ১৯৬০ এর দশক থেকেই চীন মেরিটাইম মিলিশিয়া গঠন করেছে। তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনায় ব্যবহার করা হয়েছে তখন থেকেই।
দক্ষিণ চীন সাগরে প্যারাসেল দ্বীপের দখল নিয়ে ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে চীন যুদ্ধে লিপ্ত হয় । এসময় চীন ফিশিং ভেসেল ব্যবহার করে সফলতা লাভ করে। অন্যান্য ফিশিং ভেসেলের সাথে তখন চীন কয়েকটি ফিসিং ভেসেলে করে শত শত সৈন্য পাঠায় প্যারাসেল দ্বীপে ফলে এ দ্বীপে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যরা পরাজিত হয়।
২০১৬ সালে হেগে জাতিসংঘ আদালত দক্ষিণ চীন সাগরেরর স্কারবোরো শোল ফিলিপাইনের বলে রায় দেয়। কিন্তু এ শোল বর্তমানে চীনের দখলে রয়েছে। ২০১২ সালে স্কারবরো শোল দখলে নেয় চীন। একইভাবে ১৯৯৫ সালে চীন দখলে নেয় মিচচিফ রিফ। স্কারবোরো শোল এবং মিচচিফ রিফের কাছে চীন কৃত্রিম আরো দ্বীপ তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মান করছে। মিচ চিফ রিফকে তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামও তাদের নিজেদের বলে দাবি করছে।
ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ। ফিলিপাইনের অভিযোগ এ দ্বীপ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করছে না। সম্প্রতি এ নিয়ে ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক তিক্ত আকার ধারন করে। চীন মিচ চিফ রিফ এবং স্কারবোরো শোল তাদের বলে দাবি করে আসছে।
বিভিন্ন সময় দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রণতরী চীনের ফিশিং ভেসেলের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছে। ২০০৯ সালে চীনা দুটি ফিসিং ভেসেল আকস্মিক যুক্তরাষ্ট্রের রনতরীর সামনে এসে হাজির হয়। সংঘর্ষ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী পুরোপুরি থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। চীনের অভিযোগ তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে অপারেশন পরিচালনা করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি তাদের রণতরী আন্তর্জাতিক পানিসীমায় ছিল।
তবে ঘটনাটি ছোট হলেও যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনাকে মনে করে ফিসিং ভেসেলের আড়ালে চীনা ছোট এসব জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীর কত কাছে চলে আসতে পারে তা পরীক্ষা করা হয়।। এভাবে ইয়ালো সাগরে চীনা জাহাজের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি রণতরী হয়রানির শিকার হয় । বিশ্লেষকদের মতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকে হিসেবে আনতে হবে চীনের এ মেরিটাইম মিলিশিয়া বাহিনীকে।