সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই তিক্ত হয়ে পড়েছে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামল শুরু হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে দুই পক্ষই পরস্পরকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে কথা বলেছে। প্রকাশ্যে কড়া ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের নানা অভিযোগের জবাব দিয়েছে চীন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার অ্যাংকোরেজ শহরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন তার বক্তব্যে চীনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, চীনের অনেক কাজ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে। যেমন জিনজিয়াং, হংকং, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের মতো বিষয়। এসব বিষয়ে চীনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের জবাবে চীনের পররাষ্ট্রবিষয়ক সেন্ট্রাল কমিশনের পরিচালক ইয়াং জেইচি যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তিনি তার বক্তব্যে চীনা স্টাইলের গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার গণতন্ত্র বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেয়ার কাজটি বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষই দেশটির গণতন্ত্রের উপর আস্থা নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার, মানবাধিকার সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, দেশটি বল প্রয়োগ ও আর্থিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় নিরাত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তারা চীনের ওপর আক্রমণ চালাতে অন্য দেশগুলোকে উস্কানি দিচ্ছে। কাজেই আমরা বিশ্বাস করি যে, যুক্তরাষ্ট্রকে আগে তার ইমেজ বদলাতে হবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের অবস্থা এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করা হচ্ছে।
গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমের সামনে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের কর্মকর্তাদের এই উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলেছে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। এটি ছিলো ‘অস্বাভাবিক রকমের এক অ-কূটনৈতিক বিবাদ। আর এটি ঘটেছে এমন এক বৈঠকে যেখানে কি-না এক নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের আমলে দু’পক্ষের সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই করার কথা।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না অনেক বছর ধরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সম্পর্ক আরো বাজে দিকে মোড় নিচ্ছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান তার বর্তমান দায়িত্ব পাওয়ার আগে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে কুর্ট ক্যাম্পবেলের সাথে মিলে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ক্যাম্পবেল এখন জো বাইডেনের এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ উপদেষ্টা। এই নিবন্ধে তারা বলেছিলেন, ‘চীনের সাথে মিলে-মিশে কাজ করার যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র এতদিন অনুসরণ করেছে, তার অনানুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে। তাহলে কেমন হতে যাচ্ছে চীনের সাথে নতুন সর্ম্পক।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে এখন এক নতুন ‘শীতল যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে । আসলেই কি তাই? বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরি সম্পর্কে যেভাবে গোটা বিশ্বে ছায়া ফেলেছিল, এখানেও তাই ঘটতে যাচ্ছে কি-না এমন প্রশ্ন উঠেছে।
বাইডেন প্রশাসনের অন্তবর্তীকালীন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কৌশল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আরো দৃঢ়প্রত্যয়ী চীনই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী যারা তাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি দিয়ে একটি স্থিতিশীল এবং মুক্ত বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। কাজেই বাইডেন প্রশাসনের মন্ত্র হচ্ছে- যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই চীনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও, আর যেখানে সম্ভব সেখানে সহযোগিতা করো।
অন্য দিকে চীনও যেন একই ধরনের অবস্থান নিয়েছে। তারা এক দিকে গঠনমূলক সম্পর্কের কথা বলছে। অন্য দিকে তাদের নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। হংকং-এ গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন শক্ত-হাতে দমন করছে, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, যাকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
দুই দেশের কৌশলগত লড়াইয়ের অন্যতম মঞ্চ হিসেবে দু’পক্ষই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বেছে নিয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা ৭০ কোটির বেশি।একসময়ের গরিব কয়েকটি দেশ কৃষি, শিল্প ও পর্যটনে ভর করে গত কয়েক দশকে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।
গত এক দশকে এসব দেশের অর্থনীতির ৫৭ শতাংশ বিকাশ ঘটেছে। মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশ। আয় বেড়েছে এসব দেশের জনগণের। বেড়েছে ভোক্তা ব্যয়ও। তাই এ অঞ্চলের উদীয়মান বাজার চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দু-পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাজার দখলের এই প্রতিযোগিতা দু’পক্ষকে ছায়াযুদ্ধে জড়াতে প্রভাবিত করেছে।
ছায়াযুদ্ধের আরেকটি প্রভাবক দক্ষিণ চীন সাগরের ভৌগোলিক অবস্থান। চীন এ সাগরের বড় একটি অংশ নিজেদের দাবি করে আসছে। এতে আপত্তি জানিয়েছে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চীনের সাথে এসব দেশের বিরোধ চলছে। এই ইস্যুতে এসব দেশকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের জ্বালানি, কাঁচামাল ও পণ্য বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট এ সাগর। স্বাভাবিকভাবে বাণিজ্যরুটের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা রক্ষায় বেইজিং সর্বদা সচেষ্ট। এ জন্য দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে চীন। অন্যদিকে এ জলপথে যুক্তরাষ্ট্রেরও জোরালো সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। দেশটি এ অঞ্চলে চীনের বিপরীতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা ও আঞ্চলিক মিত্রদের নিরাপত্তা দিতে দক্ষিণ চীন সাগরে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম নৌবহর মোতায়েন করেছে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের জলপথে পাহারা বসিয়েছে দু’পক্ষই।
মাঝেমধ্যে এ অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থান রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। তবে বড় ধরনের কোনো অঘটন এখনো ঘটেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট। একই রকম অবস্থান চীনেরও। দু’পক্ষই জানে, সংঘাত তৈরি হলে এর পরিণতি কত ভয়াবহ হবে। এ কারণেই তীব্র রেষারেষি থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে জড়ায়নি।
মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধে প্রযুক্তির একটা ভূমিকা ছিল। যুদ্ধাস্ত্র এবং মহাকাশে অভিযান নিয়ে দু’পক্ষ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েছিল। নতুন চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বেও প্রযুক্তির ভূমিকা রয়েছে। তবে এখানে যেসব প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে যা ভবিষ্যতে সমাজের ভোল পাল্টে দেবে, যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ফাইভ-জি।
এবারের বিশ্ব প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। গত শতকের শীতল যুদ্ধের সময় বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল, তার বাইরে ছিল আবার জোটনিরপেক্ষ শিবির কিন্তু এখন বিশ্ব অনেক বেশি মেরুতে বিভক্ত। তবে এখনকার বিশ্বে উদারনৈতিক ব্যবস্থা যে রকম হুমকির মুখে পড়েছে, সেটা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর ফলে চীন তাদের নিজস্ব ভাবনা পুরো দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মুখোমুখি সংঘাতের ঘটনা ছিল বিরল, কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যে যে প্রক্সি-যুদ্ধ হয়েছে, তাতে বিপুল প্রাণহানি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের সমজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেসে গেছে ইতিহাসের স্রোতে। কিন্তু চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। চীন তাদের পরাজয় এড়াতে অনেক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির ঝুঁকিও নিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বেশ ভালো অবস্থায়, তখনো তাদের জিডিপি ছিল মার্কিন অর্থনীতির তুলনায় মাত্র ৪০ শতাংশ। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই চীনা অর্থনীতি মার্কিন অর্থনীতির সমান হয়ে যাবে। উনিশ শতক হতে আজ পর্যন্ত চীনের মতো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই চীন-মার্কিন সম্পর্ক যতই তিক্ততার দিকে যাবে বিশ্ব ততই বেশি বিভাজন ও সংঘাতের ঝুকিতে পড়বে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীন-মার্কিন বৈরিতা কোনো দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ নয়, বরং তার চেয়েও বিপজ্জনক কিছু। চীন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেসব বিষয়কে জরুরি বলে মনে করে। সেরকম অনেক ক্ষেত্রে সামরিকভাবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। চীন এখন এমন এক বিশ্ব শক্তি হয়ে উঠেছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে যে কোন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক যেভাবে দিন দিন জটিল ও সঙ্ঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে তাতে বিশ্ব এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন।