সেরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার কোনটি?

এএইচ-৬৪ অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৬ এপ্রিল ২০২১, ০৫:৫১

আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ অ্যাটাক হেলিকপ্টার। কম দূরত্বে হামলা, শত্রুর ট্যাঙ্ক ও সাজোয়া যানের বহরে হামলা, পাবর্ত্য বা যে কোনো দুর্গম এলাকায় অভিযানে হেলিকপ্টার খুবই কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, তুরস্কসহ বৃহৎ শক্তির দেশগুলোর রয়েছে অত্যাধুনিক সামরিক হেলিকপ্টার।

যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে এএইচ-সিক্সটি ফোর অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার। বোয়িং কোম্পানির নির্মিত সামরিক আকাশ যানটি ১৯৮৬ সাল থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এর কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। অ্যাপাচি দুই ইঞ্জিনের অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এটিতে মোট ক্রু থাকে তিনজন- পাইলট, কো পাইলট ও একজন গানার। এই তিন জনের বসায় জায়গা আলাদা। তিনটি জায়গার মধ্যে থাকে শক্ত একটি শিল্ড, যাতে কোনো আঘাত এলেও অন্তত একজন সুরক্ষিত থাকতে পারেন। সে কথা চিন্তা করেই ক্রুদের সবার সিট থেকেই অ্যাপাচিকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এর দুটি ইঞ্জিনও বডির দুই পাশে রাখা হয়েছে, যাতে একটি আক্রান্ত হলেও অন্যটি চালুুু থাকে। ক্রুদের হেলমেটের সাথেই রয়েছে এমন এক মনিটর, যার সামনে প্রয়োজনীয় সব তথ্য ভেসে ওঠে। এটিকে বলা হয় হেলমেট মাউন্টেড ডিসপ্লে সিস্টেম।

অ্যাপাচির রয়েছে এন-এপিজি সেভেন্টি এইট লংব্লো রাডার। এই রাডার ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে একই সাথে ২৫৬টি টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে। আছে শত্রুর রাডারে জ্যামিং করার প্রযুক্তি। আছে আর্লি ওয়ার্নিং, লেসার ওয়ার্নিং, ক্যামিকেল ওয়ার্নিং রাডার। এর ক্যামেরা আড়াই হাজার ফুট ওপর থেকে ৫ মাইল দূর পর্যন্ত স্পষ্ট ছবি তুলতে পারে। অ্যাপাচির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮৮ মাইল আর রেঞ্জ ২৯৯ মাইল। ম্যাক্সিমাম অলটিচ্যুড ২১ হাজার ফুট। আফগানিস্তানের মতো পাবর্ত্য এলাকাগুলোতে এ কারণেই অ্যাপাচি কার্যকর হয়েছে বেশি।

অ্যাপাচি বহন করতে পারে ১৬টি হেলফায়ার মিসাইল আর ৭৬টি রকেট। ৩০ মিলিমিটার কামানে এক সাথে লোড করা যায় ১২০০ রাউন্ড বিস্ফোরক। অ্যাপাচির আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে এটির ক্রুরা ড্রোন থেকে ভিডিও ও তথ্য গ্রহণ করতে পারে এবং ড্রোনের সেন্সর এবং গতিপথও নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই হেলিকপ্টার থেকে। এছাড়া আছে নাইট ভিশন টার্গেটিং সিস্টেম। যার করণে এটি রাতের অন্ধকারেও টার্গেট খুজে পেতে পারে। এর প্রতিটির নির্মাণ খরচ ৩ কোটি মার্কিন ডলারের আশপাশে। অ্যাপাচি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে এএইচ-ওয়ান জেড ভাইপার নামের আরেকটি শক্তিশালী অ্যাটাক হেলিকপ্টার।

রাশিয়ার রয়েছে সর্বাধূনিক কেএ-ফিফটি টু এলিগেটর অ্যাটাক হেলিকপ্টার। যেটির আরেক নাম ব্ল্যাক শার্ক। কোনো দিক থেকেই এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপাচির চেয়ে পিছিয়ে নেই।এলিগেটর নির্মাণ করেছে জেএসসি কামোভ নামের একটি রুশ কোম্পানি। আসুন জেনে নেই রাশিয়ার এই হেলিকপ্টার সর্ম্পকে নানা তথ্য

একজন ক্রু ও একজন গানার নিয়ে এলিগেটর আকাশে ওড়ে। সেকেন্ডে ১০ মিটার গতিতে এটি খাড়া উপরের দিকে উঠতে পারে আড়াই হাজার মিটার পর্যন্ত। আবার জায়গা না পাল্টেই দিক পাল্টাতে পারে দুই ইঞ্জিনের হেলিকপ্টারটি। দিন ও রাতের জন্য এটির আছে আলাদা নেভিগেশন সিস্টেম ও সেন্সর। এতে ব্যবহার করা হয়েছে এইএসএ রাডার। এই রাডার একই সাথে ১৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত স্থল ও সমুদ্রে ভাসমান টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে। ৪৫ কিলোমিটার দূর থেকেও শত্রুর ট্যাঙ্ক বহর সনাক্ত করে বলে দেবে ঠিক কতটি ট্যাঙ্ক আছে সেখানে। আশপাশের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিমান থাকলে সেটিও ধরা পড়বে এলিগেটরের রাডারে। শুরুর দিকে এর রাডার একই সাথে ২০টি করে এয়ার ও গ্রাউন্ড টার্গেট সনাক্ত করতে পারলেও পরবর্তীতৈ সেই সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

অ্যালিগেটর ছুড়তে পারে অত্যাধুনিক ভিখার ও আটাকা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল। এছাড়া আকাশ থেকে ভুমিতে নিক্ষেপযোগ্য কেএইচ টুয়েন্টি ফাইভ মিসাইল ও ৮০ মিলিমিটার আনগাইডেড এস-এইট রকেটও ছুড়তে পারে। এখানেই শেষ নয়- এলিগেটর ছুড়তে পারে কেএইচ-থার্টিফাইভ এন্টিশিপ মিসাইল। যা আঘাত হানতে পারবে ৮০ মাইল দূরে সাগরে ভাসমান যে কোনো যুদ্ধজাহাজে। থার্টি মিলিমিটার অটোমেটিক গান থেকে প্রতি মিনিটে ছোড়া যায় ৫৫০টি গুলি।শক্ত কোনো প্রতিরোধ যেমন বাঙ্কার ইত্যাদিতে আঘাত হানতেও এলিগেটর সবচেয়ে উপযুক্ত।

অ্যালিগেটরের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট আছে যা অ্যাপাচির নেই। সেটিকে বলা হয় সিট ইজেকশন সিস্টেম। অর্থাৎ কোনো কারণে হেলিকপ্টার শত্রুর মিসাইল হামলায় আক্রান্ত হলে পাইলট একট মাত্র সুইচে চাপ দিলে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চেয়ারসহ দুই ক্রুকে ছুড়ে ফেলবে শূন্যে। এরপর প্যারাসুট খুলে যাবে। সাধারণত ফাইটার জেটে এই ব্যবস্থাটি থাকলেও হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে অ্যালিগেটরই প্রথম পেয়েছে এই ইউনিক ফিচারটি।

এলিগেটর ঘণ্টায় ১৯৬ মাইল বেগে উড়তে পারে। আর সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠার ক্ষমতা ১৮ হাজার ৪৪ ফুট পর্যন্ত। উড্ডয়ন রেঞ্জ ৬৮৩ মাইল।এর প্রতিটির নির্মাণ খরচ প্রায় দুই কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়াও রাশিয়া রয়েছে এমআই-টুয়েন্টি এইট হ্যাভোক ও এমআই-২৪ হাইন্ড নামের আরো দুই ধরণের অ্যাটাক হেলিকপ্টার।

চীনের রয়েছে জেড-টেন অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এটির ছদ্মনাম ওয়াটর মার্জিন। দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এটি উদ্ভাবন করেছে পিপলস লিবারেশন আর্মির জন্য। মূলত এন্টি ট্যাংক ওয়ারফেয়ারের জন্য এটি তৈরি করা হলেও এয়ার টু এয়ার অ্যাটাকের ক্ষেত্রেও দক্ষ হেলিকপ্টারটি। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো সার্ভিসে যুক্ত হয় এটি। আসুন জেনে নেই চীনের এই হেলিক্টার সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

রাডার, সেন্সর, জ্যামিং- সব কিছুতেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টারটিতে। এর ওয়াই এইচ-নাইনটি সিক্স রাডার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিপদ চিহ্নিত করতে পারে। আছে ইনফ্রারেড জ্যামার, হেলমেট মাউন্টেড টার্গেটিং ও নাইট ভিশন সিস্টেম। যে কোনো আবহাওয়ায় সর্বোচ্চ সার্ভিস দিতে পারে হেলিকপ্টারটি।

একজন পাইলট ও একজন গানার নিয়ে আকাশে ওড়ে হেলিকপ্টারটি। এইচ জে-এইট, নাইন ও টেন মডেলের ট্যাংক বিধ্বংসী ক্রুজ মিসাইল বহন করে এটি। আর আছে ১৬টি টিওয়াই-নাইনটি এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহনের ক্ষমতা। আকাশ যুদ্ধে যে কোনো হেলিকপ্টার বা বিমানকে নিশানা করতে পারবে এই মিসাইল। এছাড়া এফএন-সিক্স ও কিউডব্লিউ সিরিজের মিসাইলও বহন করতে পারে এটি।এছাড়া ২০ থেকে ১৩০ মিলিমিটার পর্যন্ত আনগাইডেড রকেট ছুড়তে পারে এই হেলিকপ্টার।

৪৬ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা হেলিকপ্টারটিতে রয়েছে প্রতিটি ১৩০০ হর্স পাওয়ারের দুটি ইঞ্জিন। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৭০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে সক্ষম এটি। আর অপারেশনাল রেঞ্জ ৮০০ কিলোমিটার বা ৫০০ মাইল।
তবে আরো অনেক যুদ্ধ সরঞ্জামের মতোই চীন তার এই হেলিকপ্টারটির সব তথ্য প্রকাশ করছে না। সরাসরি কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হওয়ায় এর কার্যকারিতা বোঝাও যাচ্ছে না।

এখন পর্যন্ত এই হেলিকপ্টারের ছয়টি সংস্করণ তৈরি করেছে চীন। এটি কোনো দেশে রফতানি করা হয়নি। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই জেড-টেন অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার জন্য বেইজিংয়ের সাথে আলোচনা চালাচ্ছে পাকিস্তান।

ফ্রান্স ও জার্মানি যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছে ইউরোকপ্টার টাইগার অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এই দুটি দেশ ছাড়াও বর্তমানে হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করেছে স্পেন ও অস্ট্রেলিয়া। ইউরোকপ্টার টাইগার নির্মাণ করেছে বিখ্যাত বিমান নির্মাতা কোম্পানি এয়ারবাস। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইউরোপের রুশ আক্রমণ ঠেকানোর উদ্দেশ্যে এই হেলিকপ্টারটি উদ্ভাবন করা হয়। যেটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো রাশিয়ার ট্যাঙ্ক বহরকে ঠেকিয়ে দেয়া।

একজন ক্রু ও একজন গানার নিয়ে আকাশে ওড়ে ৪৬ ফুট দীর্ঘ হেলিকপ্টারটি। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ইউরোকপ্টারের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ২৯০ মাইল। এর উড্ডয়ন রেঞ্জ ৮০০ কিলোমিটার। ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠেও এটি অভিযান চালাতে পারে।হেলমেট মাউন্টেড সিস্টেমসহ অত্যাধুনিক রাডার, সেন্সর, নাইট ভিশন - সব ব্যবস্থাই রয়েছে এটিতে।সব ধরণের আবহাওয়ায় দিনে ও রাতে যুদ্ধ করতে পারে হেলিকপ্টারটি।
এয়ার টু এয়ার ও এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল ছুড়তে সক্ষম ইউরোকপ্টার টাইগার। মিসট্রাল এয়ার টু এয়ার মিসাইল অথবা দুটি স্টিঞ্জার মিসাইল বহন করতে পারে হেলিকপ্টারটি। এছাড়া আরো ৪টি বিভিন্ন ধরণের মিসাইল বহন করতে পারে। অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্স এই হেলিকপ্টারে মোতায়েন রাখে স্ট্রিঞ্জার মিসাইল। জার্মানি ব্যবহার করে হট থ্রি বা পার্স থ্রি মিসাইল। এর বাইরেও অনেকগুলো আনগাইডেড রকেট রয়েছে এতে। ৩০ মিলিমিটার কামান দিয়ে ছুড়তে পারে ৪৫০ রাউন্ড গোলা।

এই হেলিকপ্টারটি আফগানিস্তান, লিবিয়া ও মালিতে ব্যবহার করেছে ফরাসি সেনাবাহিনী। এর বেশ কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে।

তুরস্কের তৈরি প্রথম অ্যাটাক হেলিকপ্টার টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন। ইতালিয়ান কোম্পানি আগুস্তা ওয়েস্ট ল্যান্ডের কারিগরি সহায়তায় এই হেলিকপ্টারটি তৈরি করেছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্কের স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে আরেকটি মাইলফলক এটি।

যে কোনো আবহাওয়া ও যে কোনো ভৌগলিক পরিবেশে যে কোনো সময় অভিযান চালাতে পারে দুই ইঞ্জিনের হেলিকপ্টারটি। ৪৪ ফুট লম্বা হেলিকপ্টারটি দুইজন ক্রু নিয়ে আকাশে ওড়ে। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২৭৮ কিলোমিটার। অপারেশনাল রেঞ্জ ৫৬১ কিলোমিটার। ৮টি হেলফায়াল মিসাইল বহন করতে পারে হেলিকপ্টারটি। আরো বহন করতে পারে ১২টি সিরিট মিসাইল।প্রতি ফ্লাইটে দুটি স্ট্রিঞ্জার বা মিস্ট্রাল মিসাইলও ছুড়তে পারে এটি। এছাড়াও শতাধিক আনগাইডেড রকেট ও কামানের গোলাও ছুড়তে পারে টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন।

বিভিন্ন ধরণের মিসাইল বহনের এই ক্ষমতাই হেলিকপ্টারটিকে সেরাদের কাতারে নিয়ে এসেছে। এছাড়া ইলেকট্রোনিক ওয়ারফেয়ারেও হেলিকপ্টারটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির।

তুরস্কের তৈরি এই অ্যাটাক হলিকপ্টারটির প্রতি আগ্রহ রয়েছে বিশে^র অনেক দেশের। ইতোমধ্যেই পকিস্তানে রফতানির জন্য এর উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান ৩০টি টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন কেনার চুক্তি করে। হেলিকপ্টারে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ইঞ্জিন ব্যবহৃত হওয়ায় রফতানিতে বাধা দিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। পরে টার্কিশ ইঞ্জিনিয়াররা এই হেলিকপ্টারের জন্য ইঞ্জিনও উদ্ভাবন করে। ফিলিপাইনও ছয়টি হেলিকপ্টার কেনার জন্য চুক্তি করেছে তুরস্কের সাথে।

কাতারও এই হেলিকপ্টার কেনার জন্য চুক্তি করেছে বলে জানা যায়। এছাড়া ব্রাজিল, সৌদি আরব, আজারবাইজনাসহ বেশ কিছু দেশ এই অ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।