কী থাকছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নতুন বিমানে


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৮:২১

প্রখ্যাত মার্কিন অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ডের ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ বহু মানুষের প্রিয় সিনেমা। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একদল লোক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারকে প্রেসিডেন্টের বহনকারী বিমান এয়ারফোর্স ওয়ানসহ কিডন্যাপ করে। সেই মুভির সুবাদেই অনেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত প্লেন সর্ম্পকে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য যে সকল প্রযুক্তি এবং সুযোগ সুবিধার দরকার হয়, তার সবটাই এ বিমানে রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে বিমানটি মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ব্যবহার করছেন, সেই এয়ারফোর্স ওয়ানের মেয়াদ ২০২৪ সালেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর আসবে নতুন বিমান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নতুন বিমানটি হবে সুপারসনিক প্রযুক্তির। বর্তমান সময়ের প্রযুক্তির সব কিছুর সংযোজন ঘটানো হবে নতুন এয়ারফোর্স ওয়ানে। নতুন যে এয়ারফোর্স ওয়ানটি আসছে তাকে ভবিষ্যতের বিমান হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এতে থাকছে সুপারসনিক স্পিড। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান এক্সোসোনিক এই বিমানটি নির্মাণ করছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিমানটির সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। এয়ারফোর্স ওয়ানের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সুপারসনিক বিমানের নির্মাণ নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারাও যেন প্রয়োজনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুনিয়ার অন্য প্রান্তে ছুটে যেতে পারেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। এর আগে গত বছর এক্সোসোনিককে এক মিলিয়ন ডলারের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে তারা বিমানটির একটি প্রোটোটাইপ সংস্করণ নির্মাণ করতে পারে।

এক্সোসোনিকের প্রধান নকশাবিদ স্টিফানি চাহান জানান, নতুন এয়ারফোর্স ওয়ানে এমন সব প্রযুক্তি যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে যা এখন পর্যন্ত কোনো বানিজ্যিক বা যাত্রীবাহী বিমানেও করা হয়নি।

এক্সোসনিকের এ বিমানটি ম্যাচ ১দশমিক ৮ স্পিডে যাতায়াত করতে পারবে। অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় বিমানটি ১ হাজার ৩৮১ মাইল পথ পাড়ি দিতে পারবে। বিমানটির রেইঞ্জ হবে ৫ হাজার মাইল। এই বিমানটির মূল একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর চলাচলের সময় আওয়াজ ও কম্পন দুটোই কম হবে। তাই বিমানটি সুপারসনিক গতিতে চললেও তাকে কানের কোনো ক্ষতি হবে না। ভূমিতে থাকা কোনো স্থাপনারও কোনো সমস্যা হবে না।

নতুন এয়ারফোর্স ওয়ানে দুটো প্রাইভেট স্যুট থাকছে। আরো থাকছে তিনটি বৈঠক রুম- যার প্রতিটির সাথেই নিরাপদ টেলিকনফারেন্স সুবিধা থাকছে। বিমানটি যাতায়াতের সময়ও প্রেসিডেন্ট বা অন্য কোনো কর্মকর্তা তাৎক্ষনিকভাবে অনলাইনে গিয়ে বক্তব্য দিতে পারবেন এমনকী সংবাদ সম্মেলনও করতে পারবেন।

বিমানগুলোর আসনগুলো চক্রাকার ধরনের হবে। যাত্রী তার সুবিধামতো আসনগুলোকে ঘুরিয়ে নিতে পারবে। আসনগুলো হবে চামড়ার তৈরি, যার খোলসটি হবে কাঠের। অন্যদিকে, ভিডিও মনিটরগুলো আসনের সাথে সামঞ্জস্য করে রোলিং করা যাবে। খাবার জন্য অথবা বৈঠকের কোনো বক্তব্য উপস্থাপন বা লেখার জন্য সিটের সাথে আলাদা জায়গাও রাখা হচ্ছে।

বিমানে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট অথবা অন্য যে কেউ থাকেন না কেন, তার জন্য বিমানে সব ধরনের সুযোগ সুবিধাই রাখা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এ বিমানটি নিয়মিত ব্যবহার হবে। বর্তমানে যে বিমানটি এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি বোয়িং সেভেন ফোর সেভেন। নতুন সংস্করনের বিমানটিও একই মডেলের। তবে, নতুন মডেলটি আগের মডেলের তুলনায় অনেকটা লম্বা এবং ভেতরে জায়গাও অনেক বেশি।

হোয়াইট হাউজ থেকে প্রশাসন চালানোর জন্য প্রেসিডেন্টের যা কিছুর দরকার হয় তার সবটাই থাকে এয়ারফোর্স ওয়ানে। কোনো নির্দিষ্ট প্রেসিডেন্টের জন্য এ বিমান ব্যবহৃত হয় না। বিমানটি মার্কিন প্রেসিডেন্সি এবং মার্কিন সরকারকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এয়ারফোর্স ওয়ানটি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের আশা আকাংখার আর গর্বের প্রতীক। তবে আগের সব প্রেসিডেন্টই বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনে উড্ডয়ন করেছেন তা কিন্তু নয়। কেনেথ ওয়ালশ নামক একজন লেখক ‘এয়ারফোর্স ওয়ান: এ হিস্টোরি অব প্রেসিডেন্টস এন্ড দেয়ার প্লেনস’ নামে একটি বইও লিখেছেন। বইটি থেকে জানা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিমানের নাম ছিল ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্স। ট্রুম্যান এমনভাবে বিমানটির নকশা করিয়েছিলেন যেন বিমানটিকে ঈগল পাখির মতো দেখায়। ঈগলের মতো করে বিমানটির লেজে পালকও সংযোজন করা হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহওয়ার চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি বোয়িং সেভেন জিরো সেভেন ব্যবহার করেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময়ে এসে বিমানটিকে সাদা আর নীল রংয়ে সুশোভিত করা হয়। এখনও অবধি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিমানে এই দুই রংয়ের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। কেনেডির সময়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমানের নামানুকরণ করা হয় এয়ারফোর্স ওয়ান।

এয়ারফোর্স ওয়ান একটি বিশেষ কোড। এই কোডের প্রবর্তন করা হয় যাতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তারা এ বিমানটিকে সাধারণ কোনো বিমানের সাথে গুলিয়ে না ফেলেন। এখন শুধু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নয়, সাধারণ মানুষও এখন এ শব্দটির সাথে অনেকটাই পরিচিত। কেনেডি চার ইঞ্জিনের বোয়িং সেভেন জিরো সেভেনের যে এয়ারফোর্স ওয়ানটির ব্যবহার শুরু করেন তা ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে যে বিমানটি এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রের আমলে। তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের এই বোয়িংয়ে আরোহন করেন। নতুন এ বিমানটিকে এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে উন্নীত করার কারণ ছিল, আগের বিমানগুলো অনেকটা পুরনো হয়ে গিয়েছিল। আর নতুন বিমানে উন্নীত না হলে অনেক সুবিধা ভোগ করারও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিলো না।

নতুন বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের ইঞ্জিন ছিলো আগের বিমানের চেয়ে অনেক উন্নত। আর এ বিমানটিতে আধুনিক প্রতিরক্ষা কৌশল ও যোগাযোগের ডিভাইসগুলোও সংযোজন করা হয়েছিল। এরপরও জর্জ বুশ জুনিয়র যখন ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন তিনি প্লেনে যাতায়াতে সময় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন।

কেনেথ ওয়ালশ তখন ইউএস নিউজ এবং ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের রাজনৈতিক বিশ্লেষক পদে চাকুরি করতেন। সে সুযোগে ২০০১ সালে এবং আগে ও পরে বেশ কিছু সময় তিনি অনেকবার এয়ারফোর্স ওয়ানে ওঠারও সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর জর্জ বুশ প্লেনে যাতায়াত করার সময় বেশ কয়েকবার তার ফোন কেটে গিয়েছিল। তখন তিনি এয়ারফোর্স ওয়ানের নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আরো উন্নত করার নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপর এয়ারফোর্স ওয়ানে বেশ কিছু নতুন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়।

বর্তমানে যে বিমানটি এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহৃতক হচ্ছে সেখানেও গোপন অনেক নিরাপত্তা কৌশল রয়েছে। যদি কখনো নিউক্লিয়ার ওয়ার শুরু হয় তাহলে এয়ারফোর্স ওয়ান থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস উদগিরন করার সুযোগ রয়েছে। এয়ারফোর্স ওয়ানের পরবর্তী সংস্করণেও এ সুবিধাটি থাকবে। কোনো সন্ত্রাসী যদি কাধেঁর ওপর বহনযোগ্য কোনো সমরযান থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করে তাহলে বর্তমানে এয়ারফোর্স ওয়ানে তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।এই প্লেনটি ওপরে উড্ডয়ন ও ল্যান্ড করার সময় ভূমি থেকে এ ধরনের হামলা হতে পারে- এ আশংকায় আলাদাভাবে বিশেষ এ প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে। আসুন জেনে নেই এয়ার ফোর্স ওয়ান নিয়ে আরো কিছু তথ্য

এয়ারফোর্স ওয়ানের প্রতিরক্ষা কাঠামো নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলো কখনোই খুব বেশি মুখ খুলতে চায় না। কারণ অন্য কোনো দুষ্কৃতিকারীর কাছে এ বিমানের বিষয়ে তথ্য যেন চলে না যায়- এ আশংকা থেকে এয়ারফোর্স ওয়ানের নিরাপত্তা ইস্যুটি সবসময়ই আড়াল করে রাখা হয়।

নতুন এই বিমানটি নিয়ে নানা মহলের তীব্র কৌতুহলের মুখে এয়ারফোর্স ওয়ান কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ‘নতুন সংস্করনের বিমানে নতুন কী কী ফিচার যুক্ত হচ্ছে তা অপারেশনের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা প্রকাশ করতে পারছি না। তবে, আশা করা যায় এতে ইলেক্ট্রিকাল পাওয়ারের উন্নত সংস্করণ থাকবে। মিশন কমিউনিকেশন সিস্টেম। একটি পুর্নাংগ মেডিকেল ফ্যাসিলিটি। বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র। একটি আত্ম-প্রতিরক্ষা সিস্টেম এবং যেকোনো অবস্থায় ভূমিতে হামলা করার মতো প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি থাকবে।

এ বিমানটিকে আকাশপথের হোয়াইট হাউস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যেখানে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কমান্ডার ইন চিফ যে কোনো পরিস্থিতিতে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বিমানে থাকা অবস্থাতেই তার সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রন করার মধ্য দিয়ে যে কোনো স্বাভাবিক ও জরুরি অবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারবেন।

২০২৪ সালে বহরে যুক্ত হতে যাওয়া এ বিমানটির বাইরের রং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লাল, সাদা ও নীলে ডিজাইন করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময় থাকা সাদা ও নীলে এয়ারফোর্স শোভিত হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এতে লাল রংও যুক্ত করেন। বাইডেন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেই ট্রাম্পের সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়ে আগের রং বহাল রাখেন। ধারনা করা হচ্ছে, বর্তমান এয়ারফোর্সকে হটিয়ে সে জায়গায় নতুন সংস্করণের এয়ারফোর্স ওয়ান ব্যবহার শুরুর এ প্রক্রিয়ায় সর্বমোট ৫দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। এই বিপুল বাজেটের মধ্যে শুধু বিমান তৈরিই নয় বরং নতুন বিমানটির পরীক্ষা, প্রশিক্ষন এবং আনুষাঙ্গিক সামরিক কাঠামো নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।