কেন এত জনপ্রিয় এফ-১৬ ফাইটার জেট


  • মেহেদী হাসান
  • ২৯ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৩

বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি যুদ্ধবিমানের মধ্যে অন্যতম এফ-১৬। আকাশে ওড়ার ৪৭ বছর পরও এফ-১৬ ফাইটার জেট ধরে রেখেছে তার শ্রেষ্ঠত্ব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ব্যয়বহুল এফ-৩৫ বিমান কেনা কমিয়ে নতুন করে এফ-১৬ বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন কারণে ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয় হতে যাচ্ছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। এ বিমানের শক্তি অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে।

উপমহাদেশে এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের নাম খুবই পরিচিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে আলোচনায় আসে এ যুদ্ধবিমানের নাম। কারণ, পাকিস্তানের কাছে থাকা এ বিমানের কারণে ভারত বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান একটি সুপারসনিক এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি শিপ যুদ্ধবিমান। বিশেষ করে এর রয়েছে পারমাণবিক বোমা বহনের ক্ষমতা। এফ-১৬ একটি ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার জেট। যুক্তরাষ্ট্র এ বিমান অনেকবার সংস্কার করেছে এবং সর্বশেষ অনেক শক্তিশালী প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে ।

এফ-১৬ একটি বহুমুখী যুদ্ধবিমান। টানা ৪২ বছর ধরে এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত। এফ-১৬ জঙ্গি বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি। সার্ভিসে যুক্ত হয় ১৯৭৮ সালে। ফিল্ড উইং বিমান হিসেবে বিশ্বের মিলিটারি সার্ভিসে সবচেয়ে বেশি রয়েছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের ২৫টি দেশ ব্যবহার করে এ যুদ্ধবিমান। কোনো কোনো দেশের বিমান বাহিনীতে অর্ধেকের বেশি যুদ্ধবিমান হলো এফ-১৬ জঙ্গি বিমান। তাইওয়ানের কাছে রয়েছে ১৪০টি এফ-১৬ ফাইটার জেট।

এফ-১৬ জঙ্গি বিমান আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সাগরে মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে রকেট এবং দীর্ঘ পাল্লার গাইডেড মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা।

পারমাণবিক বোমাসহ প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের বোমা আর মিসাইল বহন করতে পারে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। এফ-১৬ জঙ্গি বিমান বি৬১ এবং বি৮৩ এ দুই ধরনের পারামানবিক বোমা ছুড়তে সক্ষম। ১১টি হার্ড পয়েন্টে ৭ হাজার ৭০০ কেজি ওজনের অস্ত্র বহন করতে পারে।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন সংখ্যা ১টি। এর গতি সুপারসনিক, শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বা ম্যাক-২। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ৩১৮ মাইল। এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের নির্মান ও অপারেশন খরচ অনেক কম। এর ডিজাইন আধুনিক, ইঞ্জিন শক্তিশালী, খুবই হালকা এবং সব আবহাওয়ার উপযুক্ত।

সারা বিশ্বের পাইলটদের অন্যতম পছন্দ এ ফাইটার জেট। এফ-১৬ বিমানে রয়েছে গ্লাস ককপিট। ফলে পাইলট সহজে চারদিকে দেখতে পান।

এফ-১৬ একটি এয়ার সুপেরিয়রিটি ডে ফাইটার। এতে রয়েছে এম৬১ ভালকান ক্যানন, সমরাস্ত্র রাখার ১১টি পয়েন্ট । এফ-১৬ বিমানের অফিসিয়াল নাম ফাইটিং ফ্যাকন। তবে এর পাইলট এবং ক্রুদের কাছে এটি অধিক পরিচিত ভাইপার হিসেবে।

বিমানটির দৈর্ঘ্য ৪৯ ফিট ৫ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৩২ ফিট ৮ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৬ ফিট। শূন্যে বিমানটির ওজন ৮ হাজার ৫৭৩ কেজি। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ১৯ হাজার ১৮৭ কেজি। জ্বালানি ধারণ ক্ষমতা ৩ হাজার ২শ কেজি।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান উদ্ভাবন করেছে জেনারেল ডিনামিকস। ১৯৯৩ সালে এ বিমান নির্মান কর্তৃত্ব তারা বিক্রি করে লকহিড মার্টিনের কাছে।

যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্সের রিজার্ভ কমান্ড, থান্ডার বার্ডস, ইউএস নেভি, ন্যাশনাল গার্ড ইউনিট ব্যবহার করে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান। বর্তমানে ১ হাজার ৩ শর বেশি এফ-১৬ বিমান যুক্তরাষ্ট্র আর্মির বিভিন্ন শাখায় সার্ভিসে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২৩১টি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান কিনেছে।

এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬শ এ বিমান নির্মিত হয়েছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে এর নির্মান। নির্মানের পর থেকে এক ডজনের বেশি আধুনিক ভার্সন তৈরি করা হয়েছে এফ-১৬ ফাইটার জেটের । সর্বশেষ ভার্সনের নাম এফ-১৬ভি বা ভাইপার। তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ সংগ্রহ করেছে শক্তিশালী আধানিক ভার্সন এফ-১৬ ভি। যুক্তরাষ্ট্র ১৩৪টি এফ-১৬কে এফ-১৬ভিতে আপগ্রেড করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালে এফ-১৬ বিমান অবসরে পাঠাবে। এরপর এফ-১৬ এর পরিবর্তে এফ-৩৫ ব্যবহার করবে। কিন্তু সর্বাধুনিক এফ-৩৫ বিমানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়ায় এবং নির্মানে দেরি হওয়ায় এ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। এখন অনেক কম খরচের কিন্তু শক্তিশালী এফ-১৬ বিমান আরো দীর্ঘ সময় সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনা করেছে। একে সংস্কার করে এর ক্ষমতা আরো বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ২০৪৮ সাল পর্যন্ত ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বাহিনী আরো অনেক আধুনিক এফ-১৬ জঙ্গি বিমান কেনার পরিকল্পনা করছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো বহু বছর সার্ভিসে থাকবে এ যুদ্ধবিমান।

যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা আর নন স্টেলথ ফাইটার জেট কিনবে না। কিন্তু এফ-১৬ বিমানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় আগ্রহী হবার কারন হলো রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইলের আওতায় রয়েছে তাদের সর্বাধুনিক ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-৩৫। যুক্তরাষ্ট্রের আশা ছিল এফ-৩৫ হবে এ সময়ের এফ-১৬। কিন্তু তা হয়নি। এফ-৩৫ এর দাম এবং পরিচালনা খরচ এফ-১৬ এর তুলনায় অনেক বেশি।

একটি এফ-৩৫ বিমানের দাম ১১০ মিলিয়ন ডলার। প্রতি ঘন্টা আকাশে ওড়ার খরচ কমপক্ষে ৩৬ হাজার ডলার। অপর দিকে একটি এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের দাম মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাপী এফ-১৬ জনপ্রিয় হবার কারন এর কম দাম। দামের তুলনায় এ বিমান অনেক শক্তিশালী। এছাড়া এ যুদ্ধবিমানের শক্তি বিভিন্ন যুদ্ধে পরীক্ষিত। আর এসব কারনে ভবিষ্যতে এ বিমান আরো জনপ্রিয় হতে পারে।

এফ-১৬ এর সর্বশেষ ভার্সন এফ-১৬ ব্লক ৭০/৭২ অথবা এফ-১৬ ভিতে রয়েছে অটোমেটিক গ্রাউন্ড কলিশন এভয়ড্যান্স সিস্টেম। এর ফলে পাইলট অমনোযোগী হলেও এটি ভূমিতে বিধ্বস্ত হবে না।

৪২ বছর ধরে বিশ্বের অনেক দেশের মিলিটারি সার্ভিসে যুক্ত থাকায় এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের রয়েছে রেকর্ডসংখ্যক যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ইতিহাস।

সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান অভিযানের সময় পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের সাহায্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৮টি বিমান ভুপাতিত করে। এগুলো হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের এসইউ-২২, এসইউ২৫. এসইউ২৬ এবং মিগ-২৩ বিমান।

২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের দুটি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ভারতের একটি মিগ ২১ বিমান ভূপাতিত করে। পাকিস্তানের দাবি তারা ভারতের আরেকটি এসইউ-৩০ এমকে বিমান ভূপাতিত করে যা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিধ্বস্ত হয়েছে।

২০০২ সালে লাহোরে ইসরাইলের তৈরি ভারতীয় এয়ার ফোর্সের একটি ড্রোন বিমান পাকিস্তান ভূপাতিত করে এফ-১৬ বিমানের সাহায্যে। এ ঘটনা ঘটে রাতে এবং এটি এফ-১৬ বিমানের একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারন এ বিমান রাতের অপারেশনের জন্য বানানো হয়নি।

এফ-১৬ বিমানের কারনে আকাশ যুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ৮৫টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে।

১৯৯১ সালে ইরাক যুদ্ধ, ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান যুদ্ধ, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ, ২০১১ সালের লিবিয়া অপারেশনে অংশ নেয় এফ-১৬ যুদ্ধবিমান।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অপর যেসব দেশের কাছে বর্তমানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে সেগুলো হলো পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডান, মরক্কো, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইসরাইল, গ্রিস, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিন কোরিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, চিলি, নেদারল্যন্ড নরওয়ে, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, ভেনিজুয়েলা এবং তাইওয়ান। ইতালীও এক সময় ব্যবহার করেছে এ বিমান।

সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিপুলসংখ্যক সর্বাধুকি প্রযুক্তিসম্পন্ন এফ-১৬ বিমান কিনতে যাচ্ছে। প্রাথমিক অব¯’ায় ৯০টি আধুনিক এফ-১৬ বিমান সরবরাহ করা হবে।