কতটা শক্তিশালী রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল


  • মেহেদী হাসান
  • ২৯ মার্চ ২০২১, ০৮:৩৩

মিসাইল প্রযুক্তি আর মিসাইল উদ্ভাবনে বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। সোভিয়েত আমল থেকে রাশিয়া তার এ শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হলো রাশিয়ার এস-৪০০। বিশ্বে বর্তমানে যেসব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে তার মধ্যে রাশিয়ার এস-৪০০ সবচেয়ে শক্তিশালী, কার্যকর, উন্নত আর আধুনিক মিসাইল সিস্টেম হিসেবে স্থান পেয়েছে।

রাশিয়ার এ মিসাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার সনাক্ত করতে সক্ষম। এস-৪০০ মিসাইল একসাথে আকাশে ৩৬টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে আঘাত পরিচালনা করতে পারে।

সম্প্রতি এস-৪০০ মিসাইল ব্যাপক আলোচনায় এসেছে তুরস্ক এ মিসাইল কেনার পর থেকে। তুরস্ক ন্যাটোর একমাত্র সদস্য, যাদের কাছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এ মিসাইল সিস্টেম রয়েছে। এস-৪০০ মিসাইল ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য। এটি একটি এন্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম।

স্টেলথ ফাইটারসহ যে কোনো ধরনের যুদ্ধ বিমান, ক্রুজ মিসাইল এবং ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করা এর লক্ষ্য। এ মিসাইল ভূমিতেও লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।

এস-৪০০ মিসাইলের সর্বোচ্চ গতি শব্দের চেয়ে ১৫ গুন বেশি বা ম্যাক-১৫। ঘন্টায় গতিবেগ ১১ হাজার মাইল।

২০০৭ সালের ২৮ এপ্রিল এটি রাশিয়ান আর্মিতে সার্ভিসে যুক্ত হয়। এর অপারেশনাল রেঞ্জ ৪০০ কিলোমিটার। এজন্যই এর নাম এস-৪০০। একটি এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমে চার ধরনের মিসাইল যুক্ত থাকে। সর্বনিম্ন মিসাইলের পাল্লা ৪০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ মিসাইলের পাল্লা ৪০০ কিলোমিটার।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলতগত বোমারু বিমান বি-১ ল্যান্সার, বি-২ স্পিরিট, বি-৫২ এবং এফবি-১১১ বোমারু বিমান, টোমাহক ক্রুজ মিসাইল ধ্বংসের লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়া নির্মান করে এ মিসাইল। যুক্তরাষ্ট্রের আরো যেসব যুদ্ধ বিমান বর্তমানে এস-৪০০ মিসাইলের আওতায় সেগুলো হলো এফ-২২, এফ-৩৫, এফ-১৫, এফ-১৬, টি আর-১, ই-৩এ, ই-২সি এবং সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল ।

এস -৪০০ মিসাইল সিস্টেমে রয়েছে বহুমুখী রাডার, স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ, টার্গেটিং সিস্টেম, এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল, লঞ্চার, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার। ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে আকাশে সব ধরনের টার্গেট যেমন বিমান, ড্রোন বিমান, ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ মিসাইল আক্রমন করতে পারে। এস-৪০০ মিসাইল একই সাথে ৩৬টি লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে।

এস-৪০০ একটি মোবাইল সারফেস টু এয়ার মিসাইল। শক্তিশালী ট্রাকে সেট করা থাকে এ মিসাইল। চলমান অবস্থায় ট্রাক থামিয়ে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে এ মিসাইল ছোড়ার উপযুক্ত করা সম্ভব। মোবাইল হওয়ার কারনে স্থল, নৌ এবং বিমান তিন বাহিনীরই এয়ার ডিফেন্স ইউনিট ব্যবহার করতে পারে এ মিসাইল।

এস-৪০০ মিসাইল যে দেশ কিনতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সে সব দেশের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে আসছে। এর কারন এ মিসাইল ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেটের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এটি স্টেলথ ফাইটার সনাক্ত করতে সক্ষম। একই সাথে অনেকগুলো লক্ষ্যবস্তু সনাক্ত করতে পারে। স্টেলথ টার্গেট সনাক্ত করতে পারা এ মিসাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।

২০১৭ সালে লন্ডনের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন এস-৪০০ মিসাইলকে সবচেয়ে আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে আখ্যায়িত করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট এর সিমেন ওয়েজম্যান এস-৪০০ কে মোস্ট এডভান্সড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে অভিহিত করেন।

আর্টিলারি ব্যাটালিয়নের এক ইউনিট এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমে থাকে ৯টি লঞ্চার এবং ১২০টি মিসাইল। এর সাথে থাকে কমান্ড এবং সাপোর্ট ভেহিক্যাল।

এস-৪০০ মিসাইলের প্রথম বিদেশী ক্রেতা চীন। ২০১৮ সালে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে এ মিসাইল সিস্টেম সংগ্রহ করে। এ ছাড়া তুরস্ক এবং আলজেরিয়ার কাছে এ মিসাইল রয়েছে। ভারত এবং সৌদি আরব এ মিসাইল সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছে।

তুরস্ক ২০১৯ সালের ১২ জুলাই রাশিয়ার কাছ থেকে প্রথম এস-৪০০ মিসাইল গ্রহণ করে। ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ কর্মসূচী থেকে বের করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি এস-৪০০ মিসাইল এবং এফ-৩৫ এক সাথে থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা তুরস্কের মাধ্যমে এফ-৩৫ প্রযুক্তি চলে যাবে রাশিয়ার কাছে।

২০২০ সাল পর্যন্ত তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে ৪ ব্যাটারি এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম গ্রহণ করেছে। এতে রয়েছে ৩৬টি ফায়ার ইউনিট এবং ১৯২টির অধিক মিসাইল। এক ইউনিট এস-৪০০ মিসাইলের দাম ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এক ইউনিটে থাকে ৯টি লঞ্চার এবং ১২০টি মিসাইল ।

ইরান, ইরাক, মিশর, দক্ষিন কোরিয়া, কাতারসহ অনেক দেশ এ মিসাইল সিস্টেম কিনতে আগ্রহী। অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের আশঙ্কায় কিনতে পারছে না এ মিসাইল।

এস-৪০০ মিসাইলের নকশা প্রস্তুত করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আলমাজ আন্তে। এর নির্মাতা ফাকেল মেশিন বিল্ডিং বুরো। এস-৪০০ মিসাইল উদ্ভাবন প্রজেক্টের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আলেকজান্ডার লেমনস্কি।

প্যাসিফিক ফ্লিট, বাল্টিক ফ্লিটসহ রাশিয়ার তার সমস্ত কৌশলগত পয়েন্টে মোতায়েন করে রেখেছে এস-৪০০ মিসাইল।

এস-৩০০ মিসাইলেরই উন্নত ভার্সন হলো এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম। এস-৩০০ মিসাইলের ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে এর মাধ্যমে চার ধরনের মিসাইল ছোড়ার সক্ষম করা হয়েছে।

রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ মিসাইল সিস্টেম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঠান্ডা লড়াই চলকালে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করে। এস-৩০০ মিসাইল শত্রু পক্ষের বিমান চিহ্নিত করতে পারে। এক সাথে অনেকগুলো লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে। এস-৩০০ মিসাইল সিস্টেমে এক সাথে স্বল্প ও দূর পাল্লার মিসাইল নিক্ষেপ করা যায়। ফলে এটি এক সাথে এন্টি এয়ারক্রাফট রাইফেল ও শটগানের ভূমিকা পালন করতে পারে ।

এস-৪০০ এর পর রাশিয়া উদ্বাবন করেছে ভয়ানক শক্তিশালী এস-৫০০ মিসাইল সিস্টেম। ব্যালেস্টিক মিসাইল, হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল এবং জঙ্গি বিমানসহ তীব্র গতিতে ছুটে আসা শত্রু পক্ষের অন্যান্য আকাশ অস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম এস-৫০০ মিসাইল।

২০১৮ সালের মে মাসে রাশিয়া ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এস-৫০০ মিসাইল পরীক্ষা চালায়। এটি সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে। আর আকাশে ৬০০ কিলোমিটার দূরে থাকতেই এটি ব্যালিস্টিক মিসাইলকে আঘাত করতে পারবে । এ ছাড়া শত্রু পক্ষের ছোড়া অন্যান্য অস্ত্র ৫০০ কিলোমিটার দূরে থাকতে আঘাত করে ধ্বংস করতে পারবে। প্রতি ঘন্টায় ১১ থেকে ১৬ হাজার মাইল গতিতে ছুটে আসা শত্রু পক্ষের ১০টি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল সনাক্ত করে তাকে নিবৃত বা ধ্বংস করতে সক্ষম রাশিয়ার এস-৫০০ মিসাইল। ১০ চাকার শক্তিশালী সামরিক ট্রাকে বসিয়ে এটি নিক্ষেপ করা যায়।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়াকে তুলনায় আনার সুযোগ নেই। কিন্তু সমরাস্ত্র অঙ্গনে রাশিয়ার উদ্ভাবন ক্ষমতা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো জন্য শুধূ উদ্বেগের কারন নয় বরং বড় ধরনের ভীতির কারন হয়ে দাড়িয়েছে।

বিশেষ করে মিসাইল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাদের অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্বের সমস্ত প্রতিরোধ আর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে অকার্যকর করে দিয়েছে।

রাশিয়ার উদ্ভাবিত এবং মোতায়েনকৃত সর্বশেষ অতি ভয়াবহ এরকম এক হাইপারসনিক মিসাইলের নাম অ্যাভানগার্ড। এ মিসাইলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের কারো কাছে নেই। রাশিয়ার হাইপারসনিক মিসাইল নিয়ে পুতিনের দাবি রাশিয়াই একমাত্র দেশ যার কাছে রয়েছে হাইপারসনিক অস্ত্র। তিনি বলেছেন, ইতিহাসে এই প্রথম রাশিয়া গোটা বিশ্বকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অস্ত্র উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর রাশিয়া তার নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করেছে।