বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি


  • মেহেদী হাসান
  • ২৭ মার্চ ২০২১, ১৪:০৯

মানব ইতিহাসে কোনো দেশ বা সাম্রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বব্যাপী এত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেনি। ব্রিটেন এবং ফরাসি সাম্রাজ্য একসময় বিশ্বব্যাপী অনেক ঘাঁটি স্থাপন করলেও আজকের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির তুলনায় তা খুব সামান্য। বর্তমানে পুরো পৃথিবী ঘিরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত সামরিক ঘাঁটি। ৭০টির বেশি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৮ শতাধিক সামরিক ঘাঁটি। ১৫০টির বেশি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। বিপরীতে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া এ তিন দেশ মিলে বিদেশে তাদের ৩০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সুপার পাওয়ার হিসেবে যে আত্মপ্রকাশ তার নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম চালিকাশক্তি দেশটির সামরিক শক্তি। বিশ্বজুড়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশে সামরিক ঘাঁটির প্রকৃত সংখ্যা ও অবস্থানের বিস্তারিত তালিকা খুবই গোপনীয়। পেন্টাগন ২০১৩ সালে জানায়, তাদের মোট ৫ হাজার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশে ঘাঁটির সংখ্যা ৬০০।

সি আই এ’র সাবেক কনসালট্যান্ট চালেস জনসন বলেছেন, বাস্তবতা হলো আমাদের সামরিক ঘাঁটি পৃথিবী নামক গ্রহটি ঘিরে রেখেছে। আর সরকারের গোপনীয়তার কারণে আমাদের নাগরিকরা এটা জানে না।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গোপনীয়তার কারণে বাইরের লোজনের পক্ষে জানা সম্ভব নয় ঠিক কী পরিমান যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য বিদেশে মোতায়েন রয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা বিষয়ে সরকারিভাবে যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তাও বিভ্রান্তিকর। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে আড়াই হাজার সৈন্য রয়েছে । কিন্তু আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে তিন হাজার সৈন্য রয়েছে।

এমনকি অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও জানানো হয় না বিভিন্ন দেশে মোতয়েনকৃত সৈন্যদের সঠিক সংখ্যা। যেমন সিরিয়ায় সাবেক বিশেষ দূত জেমস জেফরি গত বছর প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন তিনি এবং তার সহকর্মীরা সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঠিক সৈন্য সংখ্যা প্রেসিডেন্টের কাছেও গোপন করেছেন।

ইরাকের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। ইরাকে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত সৈন্যদের সংখ্যা সেনা কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। ইরাক অভিযানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেখানে ৫০৫টি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি সামরিক ঘাঁটির তথ্য রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা কর্মকর্তা, মিলিটারি হিস্টরির প্রফেসর এডওয়ার্ড এরিকসন বলেছেন, রাশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৫ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের চারদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নির্মানের মাধ্যমে তাদের ঘেরাও করে ফেলা হয়। এর নাম ছিল কনটেইনমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্সেস এবং সিআইএ বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গোপন ও প্রকাশ্যে নানা ধরনের অপারেশন পরিচালনা করে। ইরাকী নেতা সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ান নেতা গাদ্দাফি গ্রেফতার এবং পাকিস্তানে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা অভিযানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তি দেখিয়ে চলছে।

সামরিক শক্তিবলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে এমন বক্তব্য স্বীকার করতে চান না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শুধুমাত্র ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স ১৩৮টি দেশে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন পরিচালনা করে।

বিশ্বের ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যুদ্ধ, আগ্রাসন, সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে। আজকের আন্তর্জাতিক সীমানা এবং বিশ্ব ব্যবস্থা মূলত নির্ধারিত হয়েছে সামরিক শক্তি আর যুদ্ধের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের নৃবিজ্ঞানী ডেভিড ভাইন সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৭০টির বেশি দেশ ও ভূখন্ডে ৮শ এর বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে ।

প্রাচীন রোমের আদলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সব মহাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের মিলিটারি কমান্ড। পেন্টাগনের নেতৃত্বে ১১টি ইউনিফাইড কমব্যটান্ট কমান্ড রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেন্ট্রাল কমান্ডের অধীনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং সেন্ট্রাল এশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের খবর অনুসারে কেবলমাত্র উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে রয়েছে তাদের ৪৫ হাজার থেকে ৬৫ হাজার সৈন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি সৈন্য মোতায়েন রয়েছে জাপানে। এ সংখ্যা ৫০ থেকে ৫৫ হাজার। জাপানে মোট ঘাঁটির সংখ্যা ২৩টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু জাপান এখন তাদের বড় মিত্র ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে। দক্ষিন কোরিয়ায় মোতায়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ হাজার সৈন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় কমান্ডের সদর দফতর জার্মানিতে। জার্মানিও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বড় শত্রু। জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা ৩৩ হাজার। ঘাঁটির সংখ্যা ২১ থেকে ৪০টি। জার্মানির পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশি সংখ্যক সৈন্য রয়েছে ইতালীতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালী ছিল জার্মানির মিত্র।

এশিয়ায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসেফিক কমান্ড, আফ্রিকায় আফ্রিকান কমান্ড, মধ্য এবং দক্ষিন আফ্রিকায় সাউদার্ণ কমান্ড।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ হাজার সৈন্য রয়েছে। এর মধ্যে কুয়েত ১৩ হাজার, কাতারে ১০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫ হাজার, বাহরাইন ৭ হাজার, ইরাকে ৫ হাজার, সৌদি আরব ৩ হাজার, জর্ডানে ৩ হাজার, তুরস্কে আড়াই হাজার, আফগানিস্তানে ১৪ হাজার,

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি ঘাঁটির তথ্য রয়েছে। সৌদি আরবে ৫, কুয়েতে ৮টি এবং, বাহরাইন ২টি ঘাঁটির তথ্য রয়েছে। ইরাকে এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের ৫০৫টি ঘাঁটি ছিল। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশে ঘাঁটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৮৫ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার। তবে যুদ্ধক্ষেত্রসহ এ ব্যয় ১৬০ থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার।

কোনো কোনো সময় বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার সামরিক ঘাঁটি ছিল । স্নায়ু যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিতে ২২০টি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধ সংঘাত, দ্বন্দ্ব বিভিন্ন কারণে এ সৈন্য সংখ্যা বিভিন্ন সময় বাড়ে কমে। ডিফেন্স ম্যান পাওয়ার ডেটা সেন্টারের তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে ১৭০টির বেশি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ২ লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণতন্ত্র রক্ষার নামে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারন ও আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার নতুন অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভিত্তিক ঘাঁটি নির্মান শুরু করে বিভিন্ন দেশে। যুদ্ধের পর পর বিজয়ী শক্তি হিসেবে দখল করে অনেক দেশের অনেক ঘাঁটি। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত রাখে বিশ্বজুড়ে সামরিক ঘাঁটি নির্মান। এমনকি এ যুদ্ধে ৩০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের পরও আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এ সম্প্রসারণ নীতি।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন আঙ্গিকে সাম্রাজ্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং তা ধরে রাখার পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি তাদের এসব সামরিক ঘাঁটি। এভাবে সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের প্রতি সহজেই চাপ সৃষ্টি করে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট উভয় দল থেকে এর তীব্র বিরোধীতা করা হয়। বিশেষ করে সিরিয়া থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধীতা করা হয়। অভিযোগ তোলা হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র গুটিয়ে আনছে আর রাশিয়া সেখানে প্রবেশ করছে।

অর্থনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন আর এভাবে বিশ্বব্যাপী ঘাঁটি বজায় রাখা সম্ভব নাও হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। সাধারণ অনেক আমেরিকানের মত যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেনা কর্মকর্তারাও মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এভাবে এত অর্থ ব্যয়ে বিদেশে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করা সম্ভব হবে না । এজন্য বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভর করতে হবে তার মিত্র দেশের ওপর। এজন্য তারা গ্রহণ করেছে অফসোর ব্যালেন্সিং নীতি। এ নীতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রতিরক্ষা বিভাগে। এ নীতির আলোকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত আসলে তারা রনতরী এবং বিমানের মাধ্যমে উপকূলে হাজির হবে।

অনেক আমেরিকান চাইছেন আমেরিকান সৈন্যরা আমেরিকায় ফিরে আসুক। বিদেশে ঘাঁটি বন্ধ হয়ে যাক। ডেভিড ভাইনের মতো লেখকরা বিদেশে আমেরিকান ঘাঁটি বন্ধ করার পক্ষে। তার মতে যেসব দেশে এসব ঘাঁটি অবস্থিত সেসব দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

অর্ধেক ঘাঁটি রয়েছে অগণতান্ত্রিক আর শ্বৈরশাসক দ্বারা চালিত দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব ঘাঁটি গণতন্ত্র বিকাশের বাধা হিসেবে কাজ করছে ওইসব দেশে। আর ঘাঁটি রয়েছে এমন অনেক দেশের সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ।

অনেকে মনে করে প্রতিরক্ষা আর যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ব্যয় করছে। আর এতে অবহেলিত হচ্ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসনের মত অনেক মৌলিক খাত।