ভারতকে মাঠে নামাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র


  • মেহেদী হাসান
  • ২৫ মার্চ ২০২১, ০৭:৪২

মারাত্মক এক চীন-ভীতি যেন পেয়ে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশকে। চীনকে মোকাবিলায় তাদের বিরামহীন একের পর এক নানা কর্মকাণ্ড আর উদ্যোগ এমনটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। চীনকে মোকাবিলার নামে যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে ব্যয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। নিয়মিত বাজেটের বাইরে আগামী ১০ বছরের জন্য বিশেষ ২৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট চাওয়া হয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ডের পক্ষ থেকে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের জুলাই মাসে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের মিত্রদের জন্য ৩২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। এক মাসে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘটনা। আবার চীনকে মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়া সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করেছে। ভারতও একইভাবে চীনকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জাপানকে নিয়ে এ তিনটি দেশ গঠন করছে চার দেশীয় জোট কোয়াড। এর লক্ষ্যও চীন।

প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের কয়েকটি দেশ নিয়মিত সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে জাপান, দক্ষিন কোরিয়া সফরের পর ১৯ মার্চ দিল্লি সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়ড অস্টিন। সফরের সময় উভয় দেশের শীর্ষ কূটনীতিকরা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বন্ধন আরো শক্তিশালী করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। উভয় দেশের মধ্যে সামরিক সম্পৃক্ততা, লজিস্টিক এবং পারষ্পরিক গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদান বৃদ্ধি করা হবে । আর এটি তারা করবে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের উত্থান মোকাবেলায়।

লয়ড অস্টিন এবং ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং দিল্লি বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো গভীরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন। এ সময় লয়ড অস্টিন বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ভারত ক্রমবর্ধমান ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে ভারত হলো কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক ভবিষ্যতমুখী সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি পনুর্ব্যক্ত করেন।

বাইডেন হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেয়ার পর অস্টিন হলেন শীর্ষ ব্যক্তি যিনি দিল্লি সফর করলেন। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন দায়িত্ব পাওয়ার পর ফোনে কথা বলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করের সাথে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেন । ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীন বিরোধী এ চার দেশের জোট বর্তমানে কোয়াদ নামে পরিচিত। এই চার দেশ চীন বিরোধী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আসুন জেনে নেই সে সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

এই চার দেশ দক্ষিন চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে চায়। চার দেশীয় এ জোটের প্রত্যেকটি দেশই বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের উত্থানে শঙ্কিত। প্রত্যেকের কমন শত্রু এখন চীন এবং এ চীন বিরোধীতা তাদের এক কাতারে দাড়ানোর মূল ভিত্তি।

সম্প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান, যুক্তরাষ্ট্র - ভারত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও চীন বিরোধীতা তাদের এক কাতারে নিয়ে এসেছ । চাপা পড়েছে নিজেদের মধ্যে চলমান বিভিন্ন বিরোধ। অস্টিনের সাথে বৈঠকের পর রাজনাথ সিং বলেন, দুই দেশের মধ্যে মিলিটারি টু মিলিটারি সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের তাৎপর্য এবং সম্ভাবনা বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন।

দিল্লি সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অস্টিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথেও বৈঠক করেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র - ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিশন বা দূরদৃষ্টি তুলে ধরেছেন মোদী। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়ড অস্টিনের এশিয়া সফরের আগে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে আলাস্কায়। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এ বৈঠকে ভাল কোনো ফল হয়নি। এরপর অস্টিনের এ ভারত সফরের কারনে অনেকের মতে বাইডেন প্রশাসন দিল্লিকে তাদের নিরাপত্তা মিত্র হিসেবে পাশে রাখবে। এটা তারই ইঙ্গিত।

গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সামরিক সম্পর্ক ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই দেশ সাক্ষর করেছে একাধিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। গভীর হয়েছে সামরিক সহযোগিতা। ২০১৯ সালে দুই দেশ ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক বানিজ্য ছিল শূন্যের কোটায়। ২০১৯ সালে তা দাড়িয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য চুক্তিসহ বেশ কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ থাকলেও চীন ইস্যু দুই দেশকে কাছাকাছি হতে সাহায্য করছে। সর্বশেষ চীনের সাথে লাদাখ সংঘাতের পর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার সাড়ে নয় ভাগ কিনেছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সমরাস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা রাশিয়া। বর্তমানে ভারতীয় আর্মির ৬০ ভাগ অস্ত্র রাশিয়ান অরিজিন।

স্টিমসন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ভারতের আর্মির ৯০ ভাগ, নেভির ৪১ ভাগ আর এয়ারফোর্সের ৬৬ ভাগ অস্ত্র রাশিয়ার। গত ৫ বছরে ভারত যত অস্ত্র ক্রয় করেছে তার ৬২ ভাগ কিনেছে রাশিয়া থেকে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আশা রাশিয়ার ওপর ভারতের এ নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্ক আরো সম্প্রসারিত হবে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের অস্ত্র সংগ্রহের পরিমানও ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পাবে।

গত কয়েক বছর ধরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল থেকে অনেক সমরাস্ত্র কিনেছে। স্টকহোম পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপ্রির সর্বশেষ মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দ্বিতীয় অস্ত্র বিক্রির দেশ রাশিয়া। তবে গত ৫ বছরে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি ২২ ভাগ কমেছে। এটি কমেছে মূলত ভারতে অস্ত্র বিক্রি কমে যাওয়ায়। গত ৫ বছরে ভারতে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি ৫৩ ভাগ কমেছে।

রাশিয়ার কাছ থেকে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম এবং এসইউ-৩৬ বিমান সংগ্রহ নিয়ে ভারত -যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অবণতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। লয়েড অস্টিন রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার ব্যাপারেও সর্তক করে দিয়েছেন। যদিও এই ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার বড় অংকের অর্থ পরিশোধ করেছে ভারত।

এস-৪০০ মিসাইল কেনা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এর আগে অবরোধের হুমকি দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ হুমকি বাস্তবে রুপ নেয়ার সম্ভাবনা কম। কারন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ে এখন তাদের কমন শত্রু চীনকে মোকাবেলার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত।

রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম সংগ্রহের জন্য ভারত ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। ২০১৯ সালে পারমানবিক শক্তিচালিত আকুলা সাবমেরিন লিজের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার চুক্তি করে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ভারত সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে। এরও বেশিরভাগ অস্ত্র কেনা হবে রাশিয়ার কাছ থেকে।

বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে আট শতাধিক সামরিক ঘাট। দীর্ঘকাল ধরে এসব ঘাটি এবং সেখানে অবস্থানরত প্রায় ২ লাখ সৈন্যদের খরচ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। করোনার কারনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক কারনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন আর এভাবে বিশ্বব্যাপী ঘাটি রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন মিত্রদের ওপর ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি নির্ধারক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সরাসরি এভাবে বিদেশে ঘাটি না রেখে বিভিন্ন দেশের সাথে মিত্র ও অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক তৈরি করা। সে সব দেশের সৈন্যদের যথাযথ প্রশিক্ষন ও সহায়তা দিয়ে যুদ্ধের মাঠে পাঠানো। যুক্তরাষ্ট্র এখন সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। এজন্য তারা গ্রহণ করেছে অফসোর ব্যালেন্সিং নীতি। এ নীতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রতিরক্ষা বিভাগে। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলায় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের সাথে অধিকতর মিত্রতা ও অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভাল ফল লাভের আশা করছে।