যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সমরাস্ত্রে স্বাবলম্বী হচ্ছে তুরস্ক

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৪ মার্চ ২০২১, ০৯:০২

তুরস্ক আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টানাপড়েন বেড়েই যাচ্ছে। এই সংকটের সূত্রপাত হয়, যখন মার্কিন প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে তুরস্ক রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে। এরপর তুরস্ককে কোণঠাসা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সাথে যৌথ নির্মাণাধীন এফ-থার্টি ফাইভ বিমান প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বাদ দেয়। এরপর তুরস্কের সামরিক শিল্প এবং এ খাতের শীর্ষ ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তুরস্ক এই সংকট কাটিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে।

তুরস্ক যখন নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র নির্মাণের ঘোষণা দেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ইঞ্জিন সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানসহ অন্যান্য আগ্রহী দেশের কাছে তুরস্কের সমরাস্ত্র বিক্রি ও রফতানিতেও বাধার সৃষ্টি করছে। তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকাণ্ডে তুরস্কের তেমন ক্ষতি হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বাজার হারাচ্ছে এবং উপমহাদেশসহ নানা স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-থার্টি ফাইভ বিমানটি হাতে পেলে তুরস্ক যে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে করে বিমানগুলোকে বহন করতো, সেই ক্যারিয়ারটিকে একটি আক্রমনাত্মক ড্রোন জাহাজে রূপান্তর করার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

এই ক্যারিয়ারগুলো ছিল স্টেলথ প্রযুক্তির। যুদ্ধবিমান বহণ ছাড়াও আরো বেশ কিছু উদ্দেশ্যে এর নকশা প্রনয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তুরস্ক ভাবছে, তাদের নির্মিত মনুষ্যবিহীন আকাশ যান বা ইউএভির উড্ডয়ন এবং অবতরণের জন্যও এই ক্যারিয়ারটিকে ব্যবহার করা হবে। যেহেতু এফ-থার্টি ফাইভ বিমান বহনের উপযোগী করে একে গড়ে তোলা হয়েছিল তাই এর মূল কাঠামোটি খুবই শক্তিশালী। তাই এ বিমানটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর ভরসা না করে বরং বর্তমান সময়ের তুর্কী ড্রোনগুলোর কাজে ব্যবহার করা হবে।

তুরস্কের সামরিক শিল্পখাতের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল দেমির নিশ্চিত করেছেন যে, তুরস্কের একাধিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে আনাদুলু নামের ক্যারিয়ারটিকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। যাতে বেরাকতার টিবিটু এবং অন্যান্য ড্রোনগুলোকে এই ক্যারিয়ার দিয়েই বহন ও পরিচালনা করা যায়। আনাদুলুকে যদি পরিকল্পনামতো ড্রোন উপযোগী করে তোলা যায় তাহলে এই ক্যারিয়ারে একইসাথে ১০টি সশস্ত্র ড্রোন বহন ও নিয়ন্ত্রন করা যাবে। প্রকল্পটির নির্মান শেষ হলে আনাদুলুর ডেক ব্যবহার করে ৩০ থেকে ৫০টি ড্রোন নিয়মিতভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। আনাদুলুর অপারেটিং সিস্টেমকেও প্রচলিত যুদ্ধজাহাজগুলোর মতো করেই তৈরি করা হচ্ছে।

ড্রোন ক্যারিয়ারের ধারনাটি নতুন। তুরস্কের আগে কেবলমাত্র চীন ভবিষ্যত বিমান ক্যারিয়ারগুলোকে এমনভাবে নির্মাণ করতে চাইছে। যাতে একই যুদ্ধজাহাজ দিয়ে ড্রোনও পরিচালনা করা যায়। তবে, তুরস্ক যেভাবে শুধুমাত্র ড্রোনের জন্যই ক্যারিয়ার তৈরির কথা ভাবছে- এমনটা আগে কেউ ভাবেনি।

আনাদুলুকে প্রথম নির্মাণ করা হয়েছিল হেলিকপ্টার বহনের জন্য। পরবর্তীতে এফ-থার্টি ফাইভ বহনের জন্য এর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। এবার ড্রোনের জন্য ক্যারিয়ারটিতে তৃতীয়বারের মতো পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে। বর্তমানে আনাদুলুর যে কাঠামো তা ড্রোন নিক্ষেপের জন্য উপযোগী নয়। যদিও আগামী মে মাসেই আনাদুলুর কমিশন হওয়ার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে তবে নকশায় পরিবর্তন হওয়ার জন্য এ প্রক্রিয়াও কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে।

এদিকে রাশিয়ার নিরাপত্তা সিস্টেম কেনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ শুরু হলেও তুরস্ক আবারও রাশিয়ার সাথে নতুন সমরাস্ত্র কেনার বিষয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তুরস্কের শিল্প ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মুস্তফা ভারাংক বলেন, আমেরিকা যতই নাখোশ হোক না কেন, তুরস্ক রাশিয়ার সাথে নতুন করে এসইউ-থার্টিফাইভ ও এসইউ ফিফটি সেভেন যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে আলাপ শুরু করতে আগ্রহী। ভারাংক বলেন, আমরা কোন দেশের সাথে কথা বলবো বা কী ক্রয় করবো, এগুলো জাতীয় স্বার্থের আলোকে নির্ধারন করতে চাই।

তিনি জানান, কোনো অস্ত্রের বা সমরযানের চাহিদা প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা যেকোনো দেশের সাথে কথা বলতে দ্বিধা করবো না। আমরা এক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশকে যেমন বিবেচনায় নিতে চাই না, আবার মার্কিন আপত্তির কারণে কাউকে হিসেবের তালিকা থেকে বাদও দিতে চাই না। যদি রাশিয়ার হাতে এমন বিমান থাকে যা আমাদের বর্তমান চাহিদা নিরসন করবে, তাহলে আমরা রাশিয়া বা ইউরোপের যেকোনো দেশ থেকেই সে বিমানটি কিনতে কার্যক্রম শুরু করবো।

তুরস্কের এই আগ্রহকে ইতিবাচকভাবেই মুল্যায়ন করছে রাশিয়া। রাশিয়ার ফেডারেল সার্ভিস ফর মিলিটারি টেকনিকাল কো-অপারেশনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তুরস্ক যদি রাশিয়ার কাছ থেকে কোনো অস্ত্র কিনতে চায় তাহলে এজন্য যেকোনো আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত। পঞ্চম প্রজন্মের এসইউ-ফিফটি সেভেন কিংবা চতুর্থ প্রজন্মের এসইউ থার্টি ফাইভই শুধু নয়, তুরস্কের কাছে তারা যেকোনো যুদ্ধবিমানই বিক্রি করতে আগ্রহী। পাশাপাশি, তুরস্কের সামরিক উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পেও রাশিয়া তুরস্কের সাথে একসাথে কাজ করতে চায়।

উপমহাদেশের দেশ পাকিস্তানও তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসেব নিকেষে নতুন এক তুরুপের তাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তুরস্কের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তুরস্ক চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের কাছে কমব্যাট হেলিকপ্টারগুলো বিক্রি করতে পারেনি। তাতে তুরস্কের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কারণ পাকিস্তান তুরস্কের অবস্থা বুঝেছে এবং দুদেশ আপোষের মাধ্যমেই বিকল্প চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পাকিস্তান এখন বাড়তি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। তুরস্কের কাছে হেলিকপ্টার না পেয়ে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে এই হেলিকপ্টার সংগ্রহ করছে। তুরস্ককে কোনঠাসা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে বড়ো বৈশ্বিক প্রতিপক্ষ চীনের জন্য যেন বিপুল অর্থ মুনাফা পাওয়ার পথ করে দিয়েছে।

ওয়াশিংটনের তুরস্ক নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধু আংকারাই প্রভাবিত হয়নি। তুরস্কের মিত্র দেশ পাকিস্তানও বেশ ধাক্কা খেয়েছে। কেননা তুরস্ক থেকে পাকিস্তান অনেকদিন থেকেই টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন এটাক হেলিকপ্টার সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। এটাক ওয়ান টোয়েন্টি নাইন হলো একটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট, আরামদায়ক সিটের, বহুমুখী কার্যক্রম করতে সক্ষম হেলিকপ্টার। যে কোনো প্রতিকূল বা অনুকূল আবহাওয়ায় একইভাবে পারদর্শিতা দেখাতে পারে।

পাকিস্তান নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য এই হেলিকপ্টারটি আশা করেছিলো। এই এটাক হেলিকপ্টারগুলো দিনে ও রাতেও অপারেশনে অংশ নিতে পারে। পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের এই এ্যাটাক হেলিকপ্টার সংক্রান্ত চুক্তিটি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আরোপিত প্রথম অবরোধের কারণে বেশ কয়েক দফা বিলম্বিত হয়।

তুরস্কের নির্মানাধীন এই হেলিকপ্টারগুলোতে টি-এইট হান্ড্রেড ফোর ইঞ্জিন ব্যবহার করার কথা ছিল। ইঞ্জিনটি তৈরির কথা ছিল এলএইচটেকের। এটি মূলত মার্কিন সামরিক প্রতিষ্ঠান হানিওয়েল এবং বৃটিশ কোম্পানী রোলস রয়েসের একটি যৌথ উদ্যোগ। আমেরিকান ইঞ্জিন ব্যবহার হওয়ায় অজুহাতে হঠাৎ করেই মার্কিন কর্তৃপক্ষ তুরস্ককে চাপ দেয় যাতে পাকিস্তানকে এই হেলিকপ্টারগুলো সরবরাহ করা না হয়।

তুরস্ক এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দুটো কাজ করেছে। তারা নিজ দেশে নিজ প্রযুক্তিতে অস্ত্র ও বিমান নির্মান শুরু করেছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটনেও পৃথক লবিং গ্রুপ নিয়োগ করেছে যারা মার্কিন প্রশাসন ও কংগ্রেসকে বুঝিয়ে তুরস্কের পক্ষে হেলিকপ্টার রফতানি লাইসেন্সটি আবারও অনুমোদন করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। পাকিস্তান মিত্র দেশ হিসেবে হেলিকপ্টার রফতানির ক্ষেত্রে তুরস্ককে সময় দিয়েছে আর অন্যদিকে বিকল্প হিসেবে চীনের সাথেও হেলিকপ্টারের বিষয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে।

ওয়াশিংটন পাকিস্তানের কাছে তুরস্কে নির্মিত ৩০টি এ্যাটাক হেলিকপ্টার রফতানিতে বাঁধা দেয়ায় বাধ্য হয়ে পাকিস্তান চীনের দিকেও ঝুকেছে। চীন থেকেই সমগোত্রীয় হেলিকপ্টার সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। চীন অনেক বছর ধরেই পাকিস্তানে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তুরস্কের কাছ থেকে এটাক হেলিকপ্টার না পেলে তারা চীনে নির্মিত জেড-টেন হেলিকপ্টারগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে।

জেড টেন হেলিকপ্টার নির্মান করছে চীনের চাংঘি এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন। জেড টেন হলো মাঝারি মানের একটি এ্যাটাক হেলিকপ্টার- যা চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল।

এই হেলিকপ্টারগুলো দিয়ে এন্টি ট্যাংক ওয়ারফেয়ার মিশন পরিচালনা করা যাবে। এই হেলিকপ্টারগুলোর সেকেন্ডারি এয়ার টু এয়ার যুদ্ধ সক্ষমতাও রয়েছে। পাকিস্তান এই হেলিকপ্টারগুলো হাতে পেলে সামরিকভাবে বিশেষ করে আকাশপথে বেশ শক্তিশালী হবে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করে বলছেন, তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অবরোধ তুরস্ককে যেমন সাবলম্বী করছে, তেমনি পাকিস্তানকে আরো বেশি চীনমুখী করছে। ফলে উপমহাদেশে চীনের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত- কারো জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়।