বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে ভাড়াটিয়া সৈন্য ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার টার্গেট এখন আফ্রিকার বিভিন্ন গৃহযুদ্ধ-কবিলত দেশ। যেসব দেশে রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ। রাশিয়া এসব দেশে সরকারকে ভাড়াটিয়া সৈন্য দিয়ে সহায়তা করবে। যাদের কাজ হবে বিদ্রোহ দমন এবং ক্ষমতা সুংসহত করা। এ অঞ্চলে হিরাসহ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ পাহারা দেবে ভাড়াটে সৈন্যরা।
রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহারের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, ওই সব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবসায় পশ্চিমাদের সাথে ভাগ বসানো। সিরিয়া এবং লিবিয়ায় ভাড়াটিয়া সৈন্য ব্যবহারের পর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভাড়টিয়া সৈন্য ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করেছে রাশিয়া।
মোজম্বিক প্রেসিডেন্ট ফিলিপ জাসিন্টো নিউসির সমস্যা দুটি। প্রথমটি হলো কাবো ডেলগাডো রাজ্যের অশান্ত পরিবেশ। ডেলগাডো একটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য। মুসলিম অধ্যুষিত এই এলাকায় প্রায়ই সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সাল থেকে এখানে সংঘাত চলছে। সংঘাতের কারনে ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ স্থানান্তরিত হয়েছে।
অব্যাহত বিদ্রোহ দমনে মোজাম্বিক প্রেসিডেন্ট বেশ কয়েকটি প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানির দ্বারস্থ হয়েছেন। যাতে তাদের সৈন্যদের ভাড়া করা যায়। অবশেষে তিনি একটি রহস্যজনক কোম্পানী বাছাই করেছেন । এ প্রতিষ্ঠানের সাথে ক্রেমলিনের সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম রাশান ওয়াগনার গ্রুপ।
ফিলিপ জাসিন্টো নিউসির এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। ওয়াগনার গ্রুপের বেশ কয়েকজন ভাড়াটিয়া সৈন্য মারা পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। কারন রাশিয়ান এসব ভাড়াটিয়া সৈন্যদের কাছে আফ্রিকার ওইসব এলাকা ছিল একেবারেই অপরিচিত। মোজাম্বিকের এসব এলাকায় তাদের যুদ্ধের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এরপর মোজাম্বিক সরকার ভাড়া করে ডিএজি কোম্পানির সৈন্য। এ প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন দক্ষিন আফ্রিকান কর্ণেল লায়নেল ডাইক।
কর্নেল ডাইক সাবেক ব্রিটিশ কলোনী রোডেশিয়া আর্মির সদস্য। সে হিসেবে তার রয়েছে বিদ্রোহ এবং গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা।
মজার বিষয় হলো ১৯৭০ এর দশকে রোডেশিয়া আর্মি মোজাম্বিক এবং জিম্বাবুয়ের গেরিলা ঘাটিতে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। আর এসব গেরিলা বাহিনীকে আশ্রয় দিত মোজাম্বিক প্রেসিডেন্ট ফিলিপের দল। আর এখন তিনি ভাড়া করছেন তাদের বিরুদ্ধে এক সময়ে আক্রমণ পরিচালনাকরী আর্মি অফিসারের ভাড়াটিয়া সৈন্য।
আফ্রিকা হলো সমরাস্ত্র পরীক্ষার নতুন একটি ক্ষেত্র। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে যে যুদ্ধ চলছে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে আফ্রিকায়। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক চুক্তি অনুযায়ী মার্সেনারি ফোর্সেস বা ভাড়াটিয়া সৈন্য জাতিসংঘে নিষিদ্ধ। এরপরও সবচেয়ে বেশি ভাড়াটিয়া সৈন্য রয়েছে আফ্রিকায়। আফ্রিকার অনেকে দেশে ঔপনিবেশিক আমল থেকে এখেনো ভাড়াটিয়া সৈন্য রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যখন স্বাধীনতা লাভ শুরু করে তখন অনেক দেশের ভাড়াটিয়া সৈন্যরা বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা এবং অভ্যুত্থানে জড়িত হয়। ১৯৯০ এর দশকে অনেক তরুন যুবক ভাডাটে সৈনিক হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানিতে নাম লেখায়। অনেক তরুন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার খরচ চালানোর জন্য সৈন্যর খাতায় নাম লিখিয়েছে। ভাডাটিয়া সৈন্যরা ১৯৬০ এর দশকে যুদ্ধ করেছে কাতাঙ্গাকে কঙ্গো থেকে আলাদা করার জন্য। আবার বায়ফ্রায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধ করেছে নাইজেরিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য। এমনকি ২০০৪ সালে ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের সাবেক এক অফিসার গিনিতে অভ্যুত্থান চেষ্টা করে।
অতীতে পশ্চিমা অনেক সরকার অর্থনৈতিক স্বার্থে ভাড়াটিয়া সৈন্যর কার্যক্রম সমর্থন করেছে। এখন এ কাজে রাশিয়া রয়েছে নেতৃত্বের পর্যায়ে। ওয়াগনার কোম্পানির মাধ্যমে রাশিয়া ভাডাটিয়া সৈন্য ব্যবহার এবং সরবরাহের কাজ করে থাকে। এ সংস্থার মূল পৃষ্ঠপোষক হলেন ইয়েভজেনি প্রিগোজিন। তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘণিষ্ঠজনদের একজন। রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেন থেকে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় ভাড়াটিয়া সৈন্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা পালন করেছেন।
২০১৯ সালে মোজাম্বিক প্রেসিডেন্ট ফিলিপ দেখা করেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে। এরপর মোজাম্বিকের গ্যাস ক্ষেত্র রক্ষার দায়িত্ব পায় ওয়াগনার কোম্পানি। আফ্রিকায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় জ্বালানি প্রকল্প রয়েছে মোজাম্বিকে। এখানে রয়েছে ফ্রান্সেরও স্বার্থ। ফ্রান্স এ ক্ষেত্রে ভায়া হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের মেগা কোম্পানী টোটাল।
ইউরোপে বাড়ছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব। একইভাবে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এবং সাইবারস্পেসে। তবে ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত আফ্রিকায় রাশিয়ার উপস্থিতি নিয়ে তেমন আলোচনা ছিল না। ২০১৯ সালের শুরুতে লিবিয়ায় ভাড়াটিয়া সৈন্য নিয়ে হাজির হয় ওয়াগনার।
আফ্রিকায় রাশিয়ার বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে পুতিনের আকাঙ্খা , পরিকল্পনা এবং পররাষ্ট্র নীতির প্রকাশ ঘটছে। অনেকের মতে পুতিনের নেতৃত্বে এবং রাশিয়ান আর্মির এডভেনচারিজমের মাধ্যমে রাশিয়া তাদের অতীত গৌরবজনক অধ্যায়ে ফিরতে চাচ্ছে।
আফ্রিকায় রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক বৈচিত্র্য। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার ছায়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থ আদায়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক ব্লক তৈরি করেছে। এখন এ পথে হাটছে রাশিয়া। আফ্রিকায় রাশিয়া প্রনয়ন করছে ভূ-অর্থনৈতিক কৌশল। এর লক্ষ্য আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের খনিজ সম্পদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ভাগ বসানো। এজন্য বেছে নেয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীন সংঘাত আর যুদ্ধ কবিলত দেশগুলোকে।
আফ্রিকার এসব দেশে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করে খনিজ সম্পদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একই সাথে রাশিয়া এসব দেশে ফিনিস পন্য এবং সমরাস্ত্র রপ্তানি করতে চায়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকে পশ্চিমাদের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। সে কারণে রাশিয়া এ অঞ্চলে উপযুক্ত মিত্রের সন্ধানে রয়েছে। রাশিয়া তাদের পুরনো সোভিয়েত আমলের মিত্রদের এ ক্ষেত্রে পাশে পাবার আশা করছে। আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য সিরিয়ার আদলে ভাড়াটিয়া সৈন্যের প্যাকেজ ডিল করতে চাচ্ছে।
আফ্রিকার টার্গেট করা দেশে রাশিয়া অস্ত্র বিক্রি করবে। সামরিক উপদেষ্টা পাঠাবে প্রশিক্ষনের জন্য। নিয়মিত আর্মি এবং প্যারামিলিটারি গ্রুপকে প্রশিক্ষন দেবে বিদ্রোহী দমন, দাঙ্গা বন্ধ এবং গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। রাজনৈতিক নেতাদের জন্য সরবরাহ করবে বডিগার্ড। একই সাথে তাদের শেখানো হবে ক্ষমতা সুসংহত করার পদ্ধতি।
ওয়াগনার কোম্পানি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে কাজ করেছে। সুদানে এ কোম্পানি দীর্ঘদিন সহায়তা করেছে ওমর আল বশিরকে। বিভিন্ন সময় বিদ্রোহ দমনে বশিরকে সহায়তা করেছে ওয়াগনার। তবে শেষ পর্যন্ত বশিরকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।
২০১৮ সালে ওয়াগনার কোম্পানির শত শত ভাড়াটিয়া সৈনিক প্রবশে করে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে। তারা সেখানে যায় হিরার খনি, স্থানীয় আর্মিকে প্রশিক্ষন এবং প্রেসিডেন্ট ফস্টিনকে পাহারা দেয়ার জন্য। গিনিতে ব্যাপকভাবে যুক্ত রয়েছে রাশিয়ার এলুমিনিয়াম কোম্পানি রুসাল। ওয়াগনার সহায়তা করেছে গিনির প্রেসিডেন্ট আলফা কোন্ডেকে কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমনে। নতুন সংবিধানের বিরুদ্ধে রক্তাত্ব প্রতিবাদ দমন করে কোন্ডে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন।
লিবিয়ায় জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ওয়াগনার ১২শ ভাড়াটিয়া সৈন্য মোতায়েন করেছে বিদ্রোহী খলিফা হাফতার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। লিবিয়ায় জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করতে লড়াই করছে খলিফা হাফতার বাহিনী। তাদের সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে সিরিয়ার ঘাটি থেকে রাশিয়া তাদের যুদ্ধ বিমানের রং পরিবর্তন করে লিবিয়ায় পাঠিয়েছে খলিফা হাফতার বাহিনীকে সহায়তার জন্য।
তবে লিবিয়ায় জাতিসংঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারের পক্ষে তুরস্ক শক্ত অবস্থান নেয়ায় রাশিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনী সেখানে সফল হতে পারেনি। লিবিয়ার সরকারি বাহিনী হাফতার বাহিনীর পরিত্যক্ত স্থানে অনেক গণকবরের সন্ধান পেয়েছে। এসব গণকবর হাফতার বাহিনীর নিহত সৈন্যদের। তারহুনা শহরের গণ কবরে শত শত দেহের সন্ধান মিলেছে। আর বনি ওয়ালিদ এলাকায় ওয়াগনার সদর দফতরে পাওয়া গেছে নির্যাতনের প্রমান।
ভাড়াটিয়া সৈন্যদের কোম্পানিগুলো দাবি করে তারা বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। তাদের কারণে অনেক দেশে বিশৃঙ্খলা দূর হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তারা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের কথা বলে থাকে। ২০১৬ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে ফ্রান্স তাদের অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করে। এরপর সেখানে জাতিসংঘ এবং ইউরোপের সামান্য সংখ্যক সৈন্য ছিল। তারা সেখানে বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হয়। আর এমন সময় সেখানে হাজির হয় ওয়াগনার কোম্পানি।
২০১৫ সালে দক্ষিন আফ্রিকান কোম্পানি এসটিটিইপি হাজির হয় উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায়। তারা সেখানে যায় বোকো হারামের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষনের জন্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুখারী তাদের সাথে চুক্তি বাতিল করে। বোকো হারাম দমনে সরকারি বাহিনী যথেষ্ট বলে জানান তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনী বোকো হারাম দমন করতে পারেনি।
ভাড়াটিয়া বাহিনী ব্যবহারের বেশ কিছু সুবধিা রয়েছে। তা ভালো করেই জানে রাশিয়া। প্রথম সুবিধা হলো ভাড়াটিয়া বাহিনী ব্যবহার মানে রাষ্ট্রকে অগ্রাহ্য করা। ভাড়টিয়া সৈন্য ব্যবহারকারী একটি রাষ্ট্র নিজে সেই সুযোগ করে দেয়। সরকার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের গোপনে নানাভাবে ব্যবহার করতে পারে।
দ্বিতীয় সুবিধা হলো ভাড়াটিয়া সৈন্যরা ভাসমান। তাদের জন্য কোনো ব্যারাকের দরকার হয় না। অথচ তারা প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ। নিয়মিত আর্মি প্রতিপালনের তুলনায় তাদের খরচ অনেক কম। একজন সৈন্যকে সার্ভিস লাইফের পরও সারা জীবন পেনশন দিতে হয় কিন্তু ভাড়াটিয়া সৈন্যদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বিষয় নেই।
ব্যয়বহুল ভারী সমরাস্ত্র ক্রয়ের চেয়েও তারা সস্তা। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ যেমন বৃটেন বিভিন্ন ভাড়াটিয়া সৈন্য কোম্পানিকে সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এশিয়া এবং আফ্রিকায় অনেক নেতাকে তারা এ সহায়তা দিয়ে থাকে।
রোডেশিয়ার জন গার্টনার পরিচালিত ওএএম কোম্পানি আফ্রিকার কমপক্ষে ১৮টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভাড়াটিয়া সৈন্য দিয়ে। কাগজে কলমে জাতিসংঘ ভাড়াটিয়া সৈন্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে কিন্তু এ নিয়ে তাদের সুর বেশ নরম। রাশিয়া ভাড়াটিয়া সৈন্য ব্যবহার করলেও অফিসিয়ালি তাদের কোনা অস্তিত্ব নেই। কারণ রাশিয়ান আইনেও এটি নিষিদ্ধ।