ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গোয়েন্দাগিরি


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২১ মার্চ ২০২১, ০৮:৩২

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের প্রসার ঘটছে। এই অপটিকাল ফাইবার দিয়েই পশ্চিমা পরাশক্তির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সব হাঁড়ির খবর জানার সুযোগ পেয়ে পাচ্ছে। মিসরের পোর্ট সাইদ থেকে ওমান পর্যন্ত বিশাল এলাকায় টেলিকম্যুনিকেশনের ট্রাফিক খুবই বিস্তৃত আর তাই এ অঞ্চলে নজরদারির সুযোগও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক যেসব তথ্য এই অঞ্চলের টেলিকম্যুনিকেশন কেবল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তার সবটাই পশ্চিমাদের নজরের আওতায় থাকছে। শুধুমাত্র তুরস্কের ওপর দিয়ে যে লাইনটি চলে গেছে, সেটি নিয়ে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী তথ্য জানতে পারছে না।

গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সাংবাদিক ডানকান ক্যাম্পবেল। তার মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে যখন মধ্যপ্রাচ্যে ফাইবার কেবল বসানোর কাজ শুরু হয়, তখন থেকেই ৫টি দেশ একেবারে শকুনের চোখের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নজরদারি করে যাচ্ছে। এই ৫টি দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। এই ৫টি দেশের সিগনাল ইন্টেলিজেন্সের একটি জোটও বর্তমানে কার্যকর রয়েছে যার নাম সিগ-ইন্ট। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এনএসএ এবং যুক্তরাজ্যের গভর্নমেন্ট কম্যুনিকেশন্স হেডকোয়ার্টার্স বা জিসিএইচকিউ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দৃশ্যমান ও গোপন সব স্থাপনার মাধ্যমে গোটা অঞ্চলের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে খবরদারি করতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর এরকম নজর রাখা খুবই জরুরি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের গুরুত্ব রয়েছে। এর সাথে আরব-ইসরাইল সংঘাত এবং নজরদারি করা ৫ দেশের নিজস্ব স্বার্থগত দিক তো আছেই।

ইরান ও সিরিয়ায় থাকা নানা ধরনের বিদ্রোহী সংস্থার ওপর নজর রাখাও এই কার্যক্রমের আরেকটি উদ্দেশ্য। নজরদারির সাধারন প্রক্রিয়া যেমন এয়ারস্পেসে নজরদারি বা টেলিফোনে আড়ি পাতা এগুলো অনেক আগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। এবার অপটিকাল ফাইবারের বদৌলতে পরাশক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের আমজনতার সার্বিক কার্যক্রম সম্বন্ধেও জেনে নেয়ার সুবিধা পাচ্ছে।

ক্যাবল দিয়ে এই অসাধ্য সাধন করার বিষয়টি সাধারণ অনেক মানুষই এখনো জানে না। তারা মনে করে যে, স্মার্টফোনে যেহেতু তার সংযুক্ত থাকে না এবং সব কথা যেহেতু ইথারেই ভেসে যায় তাই এখানে কিছুই অরক্ষিত নয়। স্মার্টফোন, কম্পিউটার অথবা প্রযুক্তির অন্য যেকোনো ডিভাইস যে ক্যাবলের সাথে সংযুক্ত তারা তা বুঝতেই পারে না। আর এ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অপটিকাল ফাইবারে ঢুকে পড়ে এবং নানা ধরনের ডাটা সংগ্রহ করে নেয়। ফোন কলের রেকর্ড, ইমেইলের বিষয়বস্তু, ওয়েবসাইট ব্রাউজিং এর হিস্টোরি এবং মেটাডাটাসহ সবকিছুতেই তারা হাত দিতে পারে।

শুধুমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, সরকার ও প্রশাসনের অনেক তথ্য এমনকী সামরিক বাহিনীর নানা তথ্যও এখন ক্যাবল দিয়েই দেয়া নেয়া হয়। ডাটাগুলো গনহারে সংগ্রহ করার পর এগুলো পরে ফিল্টার করা হয় এবং প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোকে আলাদা করে সংগ্রহ করা হয়। এনএসএ এবং জিসিএইচকিউ এর হাতে ৪০ হাজারেরও বেশি সার্চ আইটেম, বিষয়াবলী, ফোন নাম্বার ও ইমেইল এড্রেস আছে, যেগুলোকে তারা স্পর্শকাতর হিসেবে সনাক্ত করেছে এবং নিয়মিতভাবে এর ওপর নজরও রাখা হচ্ছে।

অপটিকাল ফাইবার এখন বিশ্বের সকল দেশকেই সংযুক্ত করেছে। এই ফাইবার ক্যাবল দিয়েই আন্তর্জাতিক পরিসরে ভয়েজ ও ডাটা ট্রাফিকের ৯৫ শতাংশ প্রবাহিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ফাইবারের গতিপথের হিসেব থেকে দেখা গেছে রেড সি থেকে ইরানে আরব্য উপদ্বীপ হয়ে সরাসরি কোনো টেরেসট্রিয়াল অপটিকাল ফাইবার ক্যাবল চলে যায়নি।

ইউরোপ থেকে এশিয়ায় ইন্টারনেটের যাবতীয় ট্রাফিকটি হয় দুটি রুটে। একটি ককেশাস এবং ইরান হয়ে ইউরোপ পার্সিয়া এক্সপ্রেস গেটওয়ে ধরে। দ্বিতীয়টি মিশরীয় বা অন্য কোনো রেডসি রুট ব্যবহার করে। ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ায় বা আফ্রিকায় তথ্য আসার ক্ষেত্রে মিশর হলো একটি গুরুত্বপূর্ন চেকপয়েন্ট। মিশর থেকে ভূমধ্যসাগরে এবং রেডসির তলদেশে মোট ১৭টি ক্যাবল চলে গেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭ থেকে ৩০ শতাংশ তথা ১৩০ কোটি থেকে ২৩০ কোটি মানুষ এই দুটো ক্যাবলই ব্যবহার করছে।

ভৌগলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এইসব ক্যাবল ভিত্তিক যোগাযোগের পথকে আরো সুগম করে দিয়েছে। কেউ হয়তো সংঘর্ষ বা সংঘাতের কারণে ইরানে বা সিরিয়ায় যেতে পারছে না, কিংবা ইয়েমেনে যুদ্ধ চলার কারণে সে দেশের কোনো আপডেটও পাবেন না। তাই তারা ক্যাবলকেই বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। বিশ্বের খুব কম অঞ্চলই অপটিকাল ফাইবার ক্যাবল ভিত্তিক যোগাযোগের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মতো এতটা গুরুত্ব পায়। রেডসির তলদেশের ক্যাবলটি এক্ষেত্রে গোটা অঞ্চলের জন্য নিয়ামক। আফ্রিকা মহাদেশের জন্য এই ক্যাবল যোগাযোগের মূল কেন্দ্র হলো জিবুতি নামক দেশটি।

ফাইবার ক্যাবলের অধিকাংশকেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সাগরের নীচ দিয়ে। সমুদ্র তলদেশ দিয়ে ক্যাবল গেলে তাকে তুলনামূলক বেশি নিরাপদ মনে করা হয়। কারণ স্থলপথের ওপর দিয়ে লাইন টানলে তাতে যেকোনো সময় আঘাত আসতে পারে। এছাড়া আবহাওয়াসহ নানাবিধ কারণে বিঘ্নিত হতে পারে। সমুদ্র তলদেশে গিয়ে ক্যাবলের ক্ষতি করা অনেকটা দু:সাধ্য। মিশরের সুয়েজ খাল দিয়ে যে ক্যাবলগুলো চলে গেছে তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা সুয়েজের সংকীর্ণ পরিসরে জাহাজগুলো নোঙ্গর ফেলায় সেখানে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। ২০১৩ সালে কিছু মানুষ সাধারণ যন্ত্র দিয়েই মিশরের সাথে ইউরোপের সংযুক্তকারী তিনটি ক্যাবল ছিড়ে ফেলে। এই ঘটনার পরপর মিশরের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের গতি প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

এই ক্যাবলগুলো মিশরের ভেতর দিয়েই চলে গেলেও মিশরের শাসকদের এখানে তেমন কোনো কর্তৃত্ব নেই। এমনকী ৫টি দেশের নজরদারি থেকেও তাদের বাঁচার মতো কোনো উপায় নেই। যদিও মিশরের স্বৈরশাসক ও দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি এবং তার ছেলে মিশরের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের উপপ্রধান মাহমুদ জনগনের ওপর নানাভাবে নজরদারি করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের ওপরে থাকা পরাশক্তির নজরের কাছে তাদের এসব কর্মকান্ড একেবারেই যৎসামান্য।

মিশরকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমা পাঁচটি দেশ তাদের নজরদারি বিষয়ক জোট গঠন করেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো তারা মিশরকেই এ জোটের আওতায় নেয়নি। তারা মিশরের ওপর এই নেটওয়ার্ক বসানোর কাজে ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ, এমনকী জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ার সাথেও কিছু বোঝা পড়ায় গিয়েছে। কিন্তু মিশরকে বরাবরই এ প্রক্রিয়ার বাইরেই রাখা হয়েছে।

সিগ-ইন্ট নামক জোটটি মিশরের এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চীন ও রাশিয়া সম্পর্কেও নানা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করে। এ কার্যক্রমকে আরো ত্বরান্বিত করার জন্য তারা সুইডেনের সাথেও চুক্তি করেছে। কেননা রাশিয়ার বালটিক অঞ্চলের যাবতীয় ল্যান্ডিং পয়েন্ট হিসেবে সুইডেন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই সুইডেনের সাথে চুক্তি করা ছাড়া পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো বালটিক অঞ্চলে রাশিয়ার কর্মতৎপরতা সম্পর্কেও জানার সুযোগ পাচ্ছিলো না। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক গভীর করলেও তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেশটি তার মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশ তথা মিশর, ইসরাইল, জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক বা আরব আমীরাত কারো সাথেই কোনো চুক্তি এখনো পর্যন্ত করেনি।

শুধু পানির নীচ দিয়ে যাওয়া ক্যাবলের মাধ্যমেই নজরদারি চলছে তা নয়। এডওয়ার্ড স্নোডেন ২০১৩ সালে যেসব তথ্য প্রকাশ করেছিলেন তা থেকে জানা যায় মধ্যপ্রাচ্যে ড্যান্সিং ওয়েসিস নামে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একটি ছায়া প্রতিষ্ঠান অনেকদিন ধরেই কাজ করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকারকেও অন্ধকারে রেখে আমেরিকানরা এ কাজটি সম্পন্ন করেছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের কোথায় কোথায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এই অফিস এবং আড়িপাতা কার্যক্রমটি চলমান তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। তবে, ধারণা করা হচ্ছে, জর্ডান, সৌদি আরব এবং মিশরে এই অফিসগুলো আছে। পাশপাশি, ওমান ও বাহরাইনেও মার্কিন গোয়েন্দাবৃত্তি এখন চুড়ান্ত কাঠামোলাভ করেছে বলেও জানা যায়।

ইসরাইল অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের এই নেটওয়ার্ক আর ব্যবহার করছেনা। ইসরাইলের দুটো ল্যান্ডিং পয়েন্ট আছে। একটি হলো তেলআবিব আর অপরটি হাইফায়। কিন্তু এর কোনোটিতেই সমুদ্র তলদেশ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই নেটওয়ার্কের লাইন যায়নি। ইসরাইল বর্তমানে নতুন আরেকটি লাইন ব্যবহার করছে যা ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারত পর্যন্ত গেছে। যেটি জর্ডান, সৌদি আরব ও ওমানকে অতিক্রম করেছে। ফলে, এই তিনটি দেশও এই নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে।

ইসরাইলের ব্যবহৃত ক্যাবলের দুটো অংশ। নীল অংশটি ইতালি থেকে বের হয়ে জর্ডানের রেডসি উপকূলের ওপর দিয়ে এসে আকাবা অবধি পৌঁছেছে। অন্যদিকে, রামান নামে আরেকটি ক্যাবলও আছে যা জর্ডানের বন্দর থেকে শুরু হয়ে ভারতের মুম্বাই পর্যন্ত এসেছে। যদি সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় তাহলে রামান ক্যাবলটিকে আরো দূরে নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা ইসরাইলীদের রয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক নিয়মিত করতে সম্মত হয় তাহলে ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে এটি একটি ভিন্ন যুগের সূচনা করবে। রাজনৈতিক ও সামরিক হিসেব নিকেষের বাইরে তথ্য প্রযুক্তিখাতেও অভাবনীয় পরিবর্তন আসবে। এমনও হতে পারে, এই ফাইবার ক্যাবলের ওপর ভিত্তি করেই ইসরাইল তার আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ দেশগুলোর সাথে নতুন যোগাযোগ ও বাণিজ্যের সূচনা করবে।