চীনা নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ব্যাপক বিধ্বংসী এক যুদ্ধজাহাজ। এর নাম ‘লাশা’। এটি টাইপ ০৫৫ ডেস্ট্রয়ার। এটি একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। বিশ্বে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরীর মধ্যে এটি একটি। চীন এখন পর্যন্ত দুটি টাইপ ০৫৫ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার নির্মাণ করেছে। প্রথমটির নাম ন্যান চ্যাং। ন্যান চ্যাং সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে ২০২০ সালে। দ্বিতীয়টি যুক্ত হলো কয়েকদিন আগে।
চীন দাবি করেছে, তাদের টাইপ ০৫৫ ডেস্ট্রয়ার লো আর্থ স্যাটেলাইটের গতিবিধি অনুসরণ এবং আঘাত করতে সক্ষম। এমনকি এটি স্টেলথ ফাইটারের হামলাও ঠেকাতে সক্ষম। সাধারণত, ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে উপগ্রহসমূহ। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রাডার ব্যবস্থা থাকলে এসব স্যাটেলাইটের চলাচল শনাক্ত করে মিসাইলকে গাইড করতে পারে আক্রমণের জন্য। টাইপ ০৫৫ ডেস্ট্রয়ারের এ ক্ষমতা থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্র নেভির জন্য খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নেভির অনেক রণতরী স্যাটেলাইট সিস্টেমের সাথে যুক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ডেস্ট্রয়ার চীনা ক্যারিয়ার গ্রুপে এসকর্টের পাশপাশি বৃহত্তর পরিমণ্ডলে অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম। চীন মোট আটটি টাইপ ০৫৫ ডেস্ট্রয়ার নির্মাণ করবে। আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বাকি ৬টি ডেস্ট্রয়ার সার্ভিসে যুক্ত হতে পারে।
টাইপ ০৫৫ ডেস্ট্রয়ার ১৮০ মিটার লম্বা, ২২ মিটার চওড়া। এর ডিসপ্লেসমেন্ট ক্ষমতা ১২ হাজার টান। এতে রয়েছে সারফেস টু এয়ার মিসাইল, এন্টি শিপ মিসাইল, ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল এবং এন্টি সাবমেরিন মিসাইল সিস্টেম।
টাইপ ০৫৫ চীনা মোস্ট এডভান্সড ডেস্ট্রয়ার। এ ডেস্ট্রয়ার বাড়িয়ে দিয়েছে চীনা ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের শক্তি। বিমানবাহী রনতরী লিয়াওনিং এবং শানডং নিয়ে গঠিত চীনা ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপস। টাইপ ০৫৫ দ্বিতীয় ডেস্ট্রয়ারের নামকরণ করা হয়েছে তিব্বতের রাজধানী লাশার নামে।
লাশা যাত্রা শুরু করেছে কিংগাডো থেকে। নর্দান থিয়েটার কমান্ড নেভিতে যুক্ত হতে পারে এটি। চীনা নেভিতে মোট ৫০টি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে।
বর্তমানে রণরতীর সংখ্যার দিক দিয়ে চীনা নেভি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌ বাহিনী। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর সর্বশেস তথ্য অনুসারে চীনা নৌবাহনীতে মোট রণতরীর সংখ্যা ৭৭৭টি। যুক্তরাষ্ট্রের রনতরীর সংখ্যা ৪৯০টি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া ৬০৩টি রণতরী নিয়ে।
সংখ্যায় সবচেয়ে বড় নেভি হবার পাশপাশি চীন ক্রমে বাড়িয়ে চলছে তাদের রণরতীর শক্তি ও দক্ষতা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন পেন্টাগন। চীনা নৌবাহিনীকে অতিক্রম করতে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির রণতরীর সংখ্যা ৫০০ তে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে।
***
তুরস্ক তাদের নির্মাণাধীন বিমানবাহী রণতরী আনাদুলুকে একটি ড্রোন বিমানবাহী রণতরীতে পরিণত করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে পরীক্ষাও চালানো হয়েছে। তুরস্কের আনাদুলু একটি মিনি বিমানবাহী রণতরী। বহুল আলোচিত এফ-৩৫ বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে তুরস্ক নির্মাণ করছিল এ রণতরী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রগ্রাম থেকে বের করে দেয়ায় সে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে দেশটির। ফলে আনাদুলু নির্মাণের একটি বড় উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্ক তাই এখন আনাদুলুকে ড্রোন বিমান ক্যারিয়ারে রুপান্তর করতে যাচ্ছে । আগামী এক বছরের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চাচ্ছে তুরস্ক।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান ইসমাইল দামির জানিয়েছেন, ৩০ থেকে ৪০টি সশস্ত্র ড্রোন অপারেশন পরিচালনা করতে পারবে এ ক্যারিয়ার শিপ থেকে। এর কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার থাকবে ক্যারিয়ার শিপে। তবে এ কর্মসূচী বিষয়ে বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করেনি তুরস্ক। কারন তারা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে নতুন কমব্যাট ড্রোন বেরক্তার টিবি৩। এটি হবে অনেক বড় ড্রোন এবং এর অস্ত্র বহন ক্ষমতাও হবে অনেক বেশি।
ড্রোনবাহী রণতরীর মাধ্যমে তুরস্ক ইন্টেলিজেন্স, সার্ভিলেন্স, রিকনিস্যান্স এবং ছোট পরিসরে ড্রোন হামলা পরিচালনা করতে পারবে। এ ছাড়া এন্টি সাবমেরিন ওয়াফেয়ার অপারেশন এর জন্য এ রণতরীকে সনোবয় ক্যারিয়ার প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে ড্রোন বিমান।
তুরস্কের বিমানবাহী রণতরী আনাদুলু একটি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ বা হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং ডক নামেও পরিচিত। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। চলতি বছর মে মাসে এটি সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। এর র্দৈঘ্য ৭৬১ ফিট। ডিসপ্লেসমেন্ট ক্ষমতা ২৪ হাজার ৬৬০ টন।
***
এবার চীনের একেবারে নাকের ডগায় ঘাঁটি নির্মাণ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য বাছাই করা হয়েছে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জকে। সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ চীনের উপকূল রেখা থেকে মাত্র ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ দ্বীপপুঞ্জ বর্তমানে জাপানের অধীনে থাকলেও চীন এবং তাইওয়ান উভয়ে এ দ্বীপকে তাদের নিজেদের বলে দাবি করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় অবস্থান আরো শক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য গঠন করবে একটি মাল্টি ডোমেন টাস্ক ফোর্স। এ টাস্কফোর্সের কিছু সৈন্য এবং অস্ত্র রাখতে চায় সেনকাকু দ্বীপে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা এ ধারণা হাজির করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রধান জেনারেল জেমস ম্যাক কনভিলস বলেছেন, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে আরো কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
জেনারেল জেমস ম্যাক কনভিলস জানিয়েছেন, ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মাল্টি ডোমেন টাস্ক ফোর্স রয়েছে। আমরা আরেকটি করতে চাচ্ছি। মাল্টি ডোমেন টাস্ক ফোর্স বিষয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দীর্ঘ পাল্লার প্রিসিশন মিসাইল হামলা পরিচালনা করা যাবে। যে কোনো এলাকা হাইপারসনিক মিসাইলের আওতায় থাকবে । এতে থাকবে এন্টি শিপ ও এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। এ টাস্ক ফোর্সের আরো থাকবে ইন্টেলিজেন্স, ইনফরমেশন, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, সাইবার এবং স্পেস শাখা।
সেনকাকু একটি জনবসতিহীন দ্বীপ। সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ পূর্ব চীন সাগরে অবস্থিত। তাইওয়ানের উত্তরে এবং চীনা মূল ভূখণ্ডের পশ্চিমে এর অবস্থান। সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে চীন, জাপান এবং তাইওয়ানের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তিন দেশেই এ দ্বীপ তাদের নিজেদের বলে দাবি করছে। এ অবস্থায় এ দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটি নির্মাণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনায় নতুন মাত্রা পেতে পারে। কারন সেন কাকু দ্বীপের অবস্থান চীনা মূল ভূখণ্ডের একেবারেই কাছে। আর চীনের নাকের ডগায় যুক্তরাষ্ট্রের টাস্কফোর্সের অবস্থান মেনে নেবে না বেইজিং।
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গুয়াম দ্বীপের দূরত্ব চীনা উপকূল ভাগ থেকে ৩ হাজার ৩৭৭ কিলোমিটার। এ দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি চীনের জন্য একটি বিষফোড়া। এ অবস্থায় চীনা মূল ভূখণ্ড থেকে সামান্য দূরে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য আর সমরাস্ত্রের উপস্থিতি চীনের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
১৮৯৫ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সেনকাকু দ্বীপ জাপানের দখলে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের অধীনে ছিল। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বীপ আবার জাপানের কাছে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে সমুদ্র তলে তেলের সন্ধান আর কৌশলগত গুরুত্বের কারনে এ দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীন, জাপান ও তাইওয়ানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে।
***
রাশিয়া একাধিক রণতরীতে নতুন একটি এডভান্সড ক্রুজ মিসাইল মোতায়েন করছে। প্যাসেফিক অঞ্চলে রাশিয়ার সাবমেরিন এবং অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজে মোতায়েন করছে এ ক্রুজ মিসাইল। এ মিসাইল প্রতিপক্ষের জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম। এর নাম কালিবার ক্রুজ মিসাইল। বিশেষজ্ঞরা একে গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর পেন্টাগনও একে যথাযথভাবে তাদের হিসেবে নিয়েছে।
ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ড প্রধান এডমিরাল ফিল ডেভিডসন এ বিষয়ে কংগ্রেসকে লিখিত আকারে জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, রাশিয়া তাদের প্যাসিফিক নৌ বহরে ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল মোতায়েন করতে যাচ্ছে এক সপ্তাহের মধ্যে। এটা যুক্তরাষ্ট্র আর্মির পাওয়ার প্রজেকশন এবং সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর এ মিসাইল মোতায়েনের পর রাশিয়ান সাবমেরিন স্থলে দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল আক্রমন চালাতে পারবে। রাশিয়ান কালিবার ক্রুজ মিসাইলের পাল্লা কমপক্ষে আড়াই হাজার কিলোমিটার।
ডেভিডসন জানিয়েছেন, রাশিয়া তাদের প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন বাহনী আধুনিকীকরণ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এর আওতায় রাখা হয়েছে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ল্যান্ড বেইজড এন্টি শিপ মিসাইল, এডভান্সড ফাইটার জেট এবং দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল আক্রমনে সক্ষম বোমারু বিমান। এর লক্ষ্য প্যাসিফিক অঞ্চলে রাশিয়ান উপকূলে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করা প্যাসিফিক ও আর্কটিক অঞ্চলে তাদের শক্তি প্রদর্শন।
ক্রুজ মিসাইল, এন্টি শিপ মিসাইল, এন্টি সাবমেরিন মিসাইল, সাবমেরিন লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল, এয়ার লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল, ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল, সারফেস টু সারফেস মিসাইলসহ কমপক্ষে এক ডজনের বেশি বিভিন্ন প্রকার কালিবার মিসাইল রয়েছে। তবে সব ধরনের কালিবার মিসাইলে রয়েছে পারমানবিক বোমা বহনের ক্ষমতা। এর গতি সুপারসনিক। এর রয়েছে অতি নিখুতভাবে লক্ষ্যে আঘাত করার ক্ষমতা। ১৯৯৪ সালে এ মিসাইল রাশিয়া সার্ভিসে যুক্ত করে। সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়া ব্যবহার করেছে কালিবার মিসাইল।