রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার হামলা


  • মেহেদী হাসান
  • ১৬ মার্চ ২০২১, ১৩:২৫

রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাইবার আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে এ আক্রমণ ঘটাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এ সাইবার যুদ্ধ গড়াতে পারে চীন পর্যন্ত। এ খবর ফাঁস করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছে, রাশিয়া ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সাইবার হামলা চালিয়েছে। সম্প্রতি সোলার উইন্ডস অ্যাটাক এবং মাইক্রোসফট হ্যাকিংয়ের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন সাইবার যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট সিস্টেমের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের যে কোনো সাইবার অ্যাটাক প্রতিহত করা এ সাইবার যুদ্ধের লক্ষ্য।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ২০২০ সালে টেক্সাসভিত্তিক সোলার উইন্ডস সিস্টেমে অ্যাটাক করেছে রাশিয়া আর সর্বশেষ মাইক্রোসফট হ্যাকিং করেছে চীন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার হামলার প্রস্ততি বিষয়ে ক্রেমলিন বলেছে এটা হবে একটি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। এ নিয়ে ক্রেমলিন উদ্বিগ্ন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে সব সাইবার হামলার অভিযোগ করেছে অস্বীকার করেছে ক্রেমলিন। চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ এ দুদেশ হ্যাকিং এবং সাইবার হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিস্টেম ধ্বংস করেছে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করেছে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের সাইবার হামলা নিয়ে বর্তমানে দুশ্চিন্তায় রয়েছে বাইডেন প্রশাসন। প্রতিপক্ষের সাইবার হামলার কারনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আর নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। ওবামা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ ছিল প্রতিপক্ষের ওপর পাল্টা সাইবার হামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সাইবার হামলা নিয়ে প্রতিশোধ যুদ্ধে জড়ায়নি। এর কারন হিসেবে তারা মনে করে এটি হলে বড় ধরনের সাইবার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিপক্ষের বড় ধরনের হামলায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সরকারি ও করপোরেট সিস্টেম।

তবে বাইডেন প্রশাসন প্রতিপক্ষকে আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো সাইবার হামলা, হ্যাকিং এবং তথ্য চুরির সুযোগ দিতে নারাজ।

অনেক ডেমোকেট মনে করেন, ২০১৬ সালের রাশিয়ার সাইবার অ্যাটাকের কারণে পরাজয় ঘটে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনের । আর জয় লাভ সহজ হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের। হিলারী ক্লিনটকে পরাজিত করা আর ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আনার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার হামলার অভিযোগ রয়েছে। কারণ হিলারী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ভøাদিমির পুতিনকে উৎখাতের চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সে কারনে পুতিন চাননি হিলারী ক্লিনটন ক্ষমতায় আসুক। এমনকি ২০২০ সালের নির্বাচনেও রাশিয়া চেষ্টা করেছে ট্রাম্প যাতে আরেকবার ক্ষমতায় আসে। এ দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

হিলারী ক্লিনটন পরাজয়ের চার বছর পর ক্ষমতায় এসেছে ডেমোক্রেটরা। অনেকে মনে করেন এবার ডেমোক্রেট সরকার রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার হামলার প্রতিশোধ নেবে। বাস্তবেও ঘটতে যাচ্ছে তাই। তবে এ খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি এখন কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।

৭ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার অ্যাটাক পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে সাইবার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক সে সময় তারা মোকাবেলা করছে চীনা সাইবার হামলার। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো চীনের বিরুদ্ধেও বড় ধরনের সাইবার হামলা পরিচালনা করতে হবে।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য চুরি, সরকারি ও করপোরেট সংস্থার মূল্যবান সিস্টেম ও অবকাঠামো ধ্বংসের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এরকম কিছু ঘটনায় চীনা কয়েকজন ব্যক্তি ধরা পড়েছে এবং বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তিও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বড় ধরনের সাইবার হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। গোটা রাশিয়াজুড়ে সমস্ত নেটওয়ার্ক, রাশিয়ান আর্মি প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের গোয়েন্দা সার্ভিসের ওপর ধারাবাহিক সাইবার অ্যাটাকের পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রথম দফার এ আক্রমণ কেবল রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। একই সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপেরও ঘোষণা দেয়া হবে।

সম্প্রতি মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে হ্যাকিংয়ের কারনে হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় পাল্টা সাইবার হামলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে স্থান পায়। মাইক্রোসফট এর বিরুদ্ধে হ্যাকিং ক্যাম্পেইনারদের চীনা সরকার সমর্থিত একটি গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মাইক্রোসফট। তবে সাইবার হামলার সাথে চীনের আরো অনেক হ্যাকিং গ্রুপ রয়েছে । এ হ্যাকিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রকাশ্যে কাউকে অভিযুক্ত করেনি। তবে হোয়াইট হাউস এবং মাইক্রোসফট মনে করে এটা বড় ধরনের গোয়েন্দাগিরি, তথ্য চুরি এবং ধ্বংসাত্মক কাজের সূচনা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে জানায় হোয়াইট হাউস এ হ্যাকিং ঘটনার তাৎপর্য এবং সরকারের করনীয় বিষয়ে পর্যালোচনা করছে। এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির সাবেক কর্মকর্তা এনি নিউ বারগারকে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে মাইক্রোসফটের ওপর সর্বশেষ হ্যাকিং ঘটনা একটি হুমকি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হ্যাকিং প্রতিরোধ ইস্যু বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা টিমের তালিকায় শীর্ষে স্থান পায় । এরপরই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার আক্রমণ পরিচালনার বিষয়টি প্রকাশ পায়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাশিয়ার কোনো আক্রমণ বিনা জবাবে ছেড়ে দেওয়া হবে না।

আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকার শক্তি পরীক্ষার ক্ষমতা যাচাই করা হবে। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা টিমের প্রধান জেইক সুলিভান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জবাবের জন্য প্রস্তুত।

বাইডেন প্রশাসনের প্রথম দিন থেকেই এ ধরনের জবাবের জন্য সুলিভান হোয়াইট হাউসকে পুর্নগঠিত করে চলছেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একটি গোপন ডকুমেন্টে সাক্ষর করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কমান্ডকে কর্তৃত্ব দেয়া হয় প্রেসিডেন্টের অনুমতি ছাড়াও হামলা পরিচালনার। সুলিভান ২০ জানুয়ারি এ বিষয়ে নতুন এক আদেশ জারি করেছেন। এতে সাইবার অ্যাটাকের আগে হোয়াইট হাউজ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের পর্যালোচনার শর্ত রাখা হয়েছে। রাশিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে সাইবার হামলা এ শর্তের আওতায় রাখা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতের চীনা হ্যাকিং এবং সাইবার অ্যাটাককে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে।

মাইক্রোসফট হ্যাকিং এর ঘটনায় প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমান আরো অনেক বেশি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে প্রাথমিকভাবে চীনের লক্ষ্য ছিল অল্প পরিসরে তথ্য সংগ্রহ করা। সর্বশেষ মাইক্রোসফট হ্যাকিংয়ের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র আর্মির অনেক কনট্রাক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের তথ্য চুরির ঘটনা ঘটতে পারে।

সর্বশেষ হ্যাকিংয়ের ঘটনায় অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রও চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে । সর্বশেষ চীনা হাকিং ঘটনাকে রাশিয়া কর্তৃক আগের সোলার উইন্ডস ঘটনার মতই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার সিস্টেমে গোয়েন্দা সংস্থার কোনো এখতিয়ার নেই। রাশিয়া এবং চীন উভয় দেশ বিষয়টি জানে। আর তারা আইনের এ দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে একটি প্রাইভেট সাইবার কোম্পানী জানার আগ পর্যন্ত সাম্প্রতিক হ্যাকিং বিষয়ে জানতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা।

চীন ২০১৪ সালে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অফিস অব পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ২৫ লাখ সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স রেকর্ড চুরি করে । আর রাশিয়া সাইবার আক্রমণ চালায় ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে।
সুলিভান গত চার বছর ধরে দাবি করে আসছেন শুধু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের মাধ্যমে চীন এবং রাশিয়াকে থামানো যাবে না। আবার অনেক কর্মকর্তা মনে করেন পাল্টা আক্রমণের ফলে সাইবার যুদ্ধ মারাত্মক পর্যায়ে পৌছতে পারে। চীন এবং রাশিয়া আমেরিকান সিস্টেমের ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মনে করেন রাশিয়ান সোলার উইন্ডস আক্রমণ ছিল কেবলমাত্র তথ্য চুরির জন্য। কিন্তু এর পেছনে রাশিয়ার আরো বড় কোনো উদ্দেশ্য। রয়েছে । এ ধরনের হামলা আমেরিকান সিস্টেমের প্রতি সন্দেহের সৃষ্টি তৈরি করেছে।

এমনকি ভোটিং সিস্টেমের প্রতিও সাধারন আমেরিকানদের সন্দেহ আর অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। আর এর মাধ্যমে আমেরিকান গণতন্ত্রের মূল ভিতিতে আঘাত করা হয়েছে। রাশিয়া ২০১৬ সালে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি এবং ভোটার রেজিষ্ট্রেশন সিস্টেমে প্রবেশ করে ।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পেন্টাগনের সাইবার কমান্ডের মত চীনের মিলিটারি হ্যাকিং ডিভিশনও স্ট্রাটেজিক সাপোর্ট ফোর্সে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি, চীনা প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দা এজেন্সি যুক্ত থাকে। যারা স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ করে।