মুসলিম বিশ্বের আস্থা ও সম্ভাবনার নতুন শক্তি তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই সমরাস্ত্র উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়ে আসছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো তুরস্ককে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র একটা পর্যায়ে তুরস্কের অস্ত্র শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। কিন্তু দেশটি পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের দেশে একেবারেই নিজস্ব প্রযুক্তিতে অস্ত্র নির্মাণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাফল্য অর্জন করছে।
তুরস্ককে বিমান ও ট্যাংক নির্মাণে প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন সরবরাহ করতে অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। এবার তাদের জন্য বড়ো আকারের একটি সুসংবাদ এসেছে। তুরস্কের বাণিজ্যিক ও সামরিকযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএমসি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে নতুন ইঞ্জিন পাওয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানটি তুরস্কের নির্মিতব্য দেশীয় প্রযুক্তির আলতেই ট্যাঙ্কের জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন সরবরাহ করবে।
বিএমসির একটি শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান দোসান এবং এস এন্ড টি ডাইনামিক্সের সাথে দেশীয় আলতেই ট্যাঙ্কের জন্য ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশন সিস্টেম সরবরাহের চুক্তি সাক্ষর করেছে। দীর্ঘদিনের সমঝোতা সংলাপ ও আলোচনার ভিত্তিতে এ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আলতেই হলো একটি মূলধারার যুদ্ধ ট্যাঙ্ক যা কে-টু ব্ল্যাক প্যানথারের চেসিসের ওপর নির্মাণ করা হবে। যা কে-টু ব্ল্যাক প্যানথার হলো দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে থাকা আগামী প্রজন্মের একটি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক। দক্ষিণ কোরিয়ার ডিফেন্স ডেভোলপমেন্ট এজেন্সী এই ট্যাঙ্কের নকশা প্রনয়ণ করে। আর ট্যাঙ্কটি নির্মাণ করেছে হুন্দাই রোতেম।
তুরস্কের আলতেই ট্যাঙ্কের নামকরণটি করা হয়েছে তুরস্ক সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল ফাহরেত্তিন আলতেই’র নামে, যিনি তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পঞ্চম ক্যাভালরি কর্পস এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রতিটি আলতেই ট্যাঙ্ক নির্মাণে খরচ পড়বে ১৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আলতেইকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলতেই ট্যাঙ্ক নির্মাণ কার্যক্রমটি বেশ কয়েকবার পিছিয়েছে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না পাওয়ার জন্য। বিশেষ করে ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন এবং আর্মার পাওয়া নিয়ে অনেকদিন থেকেই বেশ জটিলতা দেখা দিয়েছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের অফিস পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সামরিক বাহিনীর নতুন আবিস্কারের তালিকায় দেশীয় প্রযুক্তির এই আলতেই ট্যাঙ্কটির নাম সবার আগে অন্তর্ভুক্ত করে। এরই মধ্যে এ ট্যাঙ্কটির নির্মাণ ও পরীক্ষার দায়িত্ব তুরস্কের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
কোরিয়ার সাথে এই চুক্তিটি হয়ে যাওয়ায় তুরস্কের সেনাবাহিনী পদাতিক যুদ্ধেও অনেকটা এগিয়ে যাবে। আগামী বছরই আলতেই ট্যাঙ্কটিকে অপারেশনে দেখা যাবে বলেও কর্তৃপক্ষ আশা করছেন। এই ট্যাঙ্কটিতে ১২০ মিলিমিটার দীর্ঘ স্মুথবোর বন্দুক রয়েছে। আরো থাকছে সিবিআরএন প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি, যা এই ট্যাঙ্ককে সব ধরনের রাসায়নিক, জৈবিক, রেডিওলোজিকাল এবং পারমানবিক অস্ত্র থেকে নিরাপদে রাখবে।
তুরস্কের সামরিক কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে, এই ট্যাঙ্কটিতে তারা জার্মানীর তৈরি এমটিইউ ইঞ্জিন এবং রেংক ট্রান্সমিশন সংযোজন করতে পারবে। কিন্তু জার্মানীর সাথে আলোচনা ব্যর্থ হয়। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া তুরস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারন দেশটির বহুল আলোচিত কে-টু ব্ল্যাক প্যানথার ট্যাঙ্ক বানানোর সময়ে একই ধরনের জটিলতায় পড়েছিল। তারাও তখন কারও কাছ থেকে ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশনের বিষয়ে সহযোগিতা পায়নি।
কে-টু ব্ল্যাক প্যানথার ট্যাঙ্কগুলোর প্রথম একশটি নির্মিত হয়েছিল পনেরশ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দিয়ে এবং তখন এস এন্ডটি ডায়নামিক্স এর অটোমেটিক ট্রান্সমিশন সংযুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্যাঙ্ক নির্মাণের সময়, প্রথম কিছু ট্যাঙ্ক ২০১৬ সালের শেষ দিকেও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এস এন্ডটির ডায়নামিকসটি ডিউরেবিলিটি টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা ঘোষণা করে যে, তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের কে-টু ব্ল্যাক প্যানথার ট্যাঙ্কগুলোতে হাইব্রিড পাওয়ার প্যাক সংযোজন করবে । যেখানে দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত ইঞ্জিন থাকলেও ট্রান্সমিশন সিস্টেমটি থাকবে জার্মানীর।
তুরস্কের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার দুই সামরিক প্রতিষ্ঠানদুটো যেভাবে চুক্তি করেছে সেই অনুযায়ী তারা তাদের দেশীয় পাওয়ার প্যাকটাই আলতেই ট্যাঙ্কে সংযোজন করবে। এরপর পরীক্ষা চালানো হবে। যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে আলতেই ট্যাঙ্কগুলোতে দোসানের ইঞ্জিন ও এস এন্ডটির ডায়নামিক্সকে যুক্ত করার মাধ্যমে আগামী ১৮ মাসের মধ্যেই ট্যাঙ্কটির নির্মাণকাজ শেষ হবে।
তুরস্ক ১৯৯০ সাল থেকেই আলতেই ট্যাঙ্কের কথা বলে আসছে। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ঘোষণা আসা পর্যন্ত কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সে বছরই তুর্কী প্রশাসন কয়েক বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিএমসির ওপর অর্পন করে। কোরিয়ার সাথে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী প্রথম দফায় ২৫০টি আলতেই ট্যাঙ্ক নির্মাণ করা হবে।
যতদিন এই ট্যাঙ্কটি ময়দানে কার্যকর থাকবে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ততদিনই এই ট্যাঙ্কগুলোকে লজিস্টিক সেবাও দিয়ে যাবে। চুক্তি অনুযায়ী বিএমসি নতুন ট্যাঙ্কগুলোকে নকশা করবে, উন্নত করবে এবং এর কার্যক্রমও নির্ধারন করবে।
মনুষ্যবিহীন প্রযুক্তিতে গুলি নিক্ষেপ করার ব্যবস্থাও থাকবে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যেই প্রথম আলতেই ট্যাঙ্কটি প্রকাশ্যে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। আলতেই প্রকল্পটি দুটো ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এগুলো হলো টিওয়ান এবং টি-টু। টি-ওয়ান পর্যায়ে ২৫০টি ট্যাঙ্ক আসবে আর টি-টু পর্যায়ে আসবে ট্যাঙ্কটির উন্নত সংস্করণ। তুরস্ক ধাপে ধাপে মোট ১ হাজারটি আলতেই ট্যাঙ্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। পরবর্তীতে আলতেই ট্যাঙ্কের মনুষ্যবিহীন সংস্করণটিও আনতে চায় তুরস্ক।
এদিকে তুরস্কের আলোচিত হিসার ও প্লাস মধ্যমপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটি সফলভাবে একটি পরীক্ষা চালিয়েছে। এ পরীক্ষাটি তুরস্কের সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা দূরত্বে এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা দিয়ে পরিচালিত একটি পরীক্ষা। তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি প্রেসিডেন্সির প্রধান ইসমাইল ডেমির এই পরীক্ষার কথা জানিয়ে বলেন হিসার এ’ সিস্টেমের পর উন্নত সংস্করণ হিসেবে তুরস্ক হিসার এ প্লাস স্বল্পপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম প্রবর্তন করেছিল। আর এবার হিসার ও প্লাস আরো উন্নত সংস্করণটিরও সফল পরীক্ষণ সম্পন্ন হলো।
পরীক্ষার অংশ হিসেবে এ ডিফেন্স সিস্টেমটি সফলভাবে নির্ধারিত টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। সিস্টেমটি নির্মাণের সাথে রয়েছে তুরস্কের সমরাস্ত্র নির্মানকারী প্রতিষ্টান আসেলসান এবং রকেটসান। এই দুটো প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে তুরস্কের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে উন্নত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
হিসার ও প্লাস সিস্টেমটি দেশীয় যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে। তুরস্ক এখন স্তরভিত্তিক এয়ার ডিফেন্স প্রনয়নে চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে দেশটি এই ডিফেন্স সিস্টেমটি পরীক্ষার মাধ্যমে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো।
এই ডিফেন্স সিস্টেম দিয়ে তুরস্ক আরো সফলভাবে নিজেদের স্টেশনারী ফোর্স এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম হবে। মূলত বিমান, হেলিকপ্টার, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন এবং আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণ যোগ্য মিসাইলের মাধ্যমে একটি দেশকে যেভাবে ঝুঁকিতে ফেলার চেষ্টা করা হয়, ডিফেন্স সিস্টেম দিয়েই দেশটি তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
নতুন এই হিসার ও প্লাসে স্টেট অব দ্য আর্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের যেকোনো টার্গেটকে সঠিকভাবে সনাক্ত করা, তাদের গতিপথ নির্নয় করা, কমান্ড ও কন্ট্রোল করা এবং আক্রমন করাসহ যাবতীয় কাজ স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা সম্ভব হবে।
হিসার ও প্লাস সিস্টেমে এয়ার ডিফেন্স অভিযানের পরিকল্পনাও যুক্ত থাকছে। ব্যাটারি ও ব্যাটেলিয়ন উভয় ক্ষেত্রেই এ সিস্টেমটি কার্যকর থাকবে। তথ্য সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রণ এবং বণ্টনের কৌশলও এতে সংযুক্ত থাকবে। আকাশ থেকে ছবি তোলা, শত্রুপক্ষের টার্গেটে আঘাত করা, দিনে ও রাতে ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় জিপিএস এর মাধ্যমে এ সিস্টেমটি সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে, তারের মাধ্যমে অথবা তার ছাড়াই এ সিস্টেমগুলোকে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। মিত্রশক্তির সমরযান আর শত্রুপক্ষের টার্গেটকেও এ সিস্টেম আলাদা আলাদা করে চিনতে পারবে। তুরস্কের সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে এই ডিফেন্স সিস্টেমটির কার্যক্রমকে পরিচালনা করা হবে।