ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র


  • মোতালেব জামালী
  • ১৬ মার্চ ২০২১, ১২:৫৩

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নানা দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নামে পরিচিত। এ অঞ্চলটি বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬০ ভাগের অংশীদার। বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দুই তৃতীয়াংশ অবদান এই অঞ্চলের। অঞ্চলটি পরাশক্তিগুলোর সামরিক শক্তি প্রদর্শনের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় উত্তেজনাও বেড়ে চলেছে।

আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস হবে। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির দুই তৃতীয়াংশেরই মালিকানা থাকবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের হাতে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল মুক্ত ও উন্মুক্ত থাকার কারণে চীনসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর সমৃদ্ধি বাড়ছে। এ কারণে এই অঞ্চলে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে সব দেশই এই নৌপথ ব্যবহার করে বাণিজ্য করতে পারে। বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান একই সঙ্গে সুশাসন, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যই ইন্দো-প্যাসিফিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯০ এর দশক থেকেই মার্কিন সরকারগুলো এই অঞ্চলে তাদের জোরালো সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়ে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বড় যে ৫টি নিরাপত্তা ঝুকি চিহ্নিত করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা দফতর তার চারটিই এই অঞ্চলে। এগুলো হচ্ছে- চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও চরমপন্থি’ সশস্ত্র কিছু সংগঠন। কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব হারাচ্ছে। কেননা এখানে যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা কৌশলগত সমরাস্ত্রের সংখ্যা কমে আসছে।

অন্যদিকে চীন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর তার সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় জোর চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে যে কোন সময় চীন তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একতরফা পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে বর্তমান স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে, পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে চলে যাবে। তখন মার্কিন বাহিনী চীনের পদক্ষেপের উপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম হবেনা। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ ও ঝুকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের অধিনায়ক অ্যাডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসন সম্প্রতি সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির শুনানীতে এ সতর্কবানী উচচারন করেছেন। অ্যাডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসন বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন তার সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। তারা যে কোন সময় আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি চীন জানিয়েছে, তারা চলতি বছর তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়াবে।

জেনারেল ডেভিডসন বলেন, চীন দ্রুততার সাথে তার নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তারা তিনটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করতে সক্ষম হবে। তিনি সিনেট কমিটির সদস্যদের সামনে যে তালিকা তুলে ধরেন তাতে দেখা যায় যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের সম্পদের পরিমান অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে।

তাইওয়ানের চারপাশে চীন যখন আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে অ্যাডমিরাল ডেভিডসন সিনেট কমিটির কাছে তার এই রির্পোট তুলে ধরলেন।

বর্তমান এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’র নীতি পরিবর্তন করা উচিত কিনা এবং চীন তাইওয়ান আক্রমন করলে যুক্তরাষ্ট্রের কি করা উচিত জানতে চাইলে অ্যাডমিরাল ডেভিডসন বলেন, এখন এটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।

গত ৪০ বছর ধরে অনুসৃত ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’র নীতি তাইওয়ানকে তার বর্তমান অবস্থায় টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। একটা নীতিকে সব সময়ই পর্যালোচনার মধ্যে রাখতে হয়। তবে আমি সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার উপর জোর দিতে চাই। অ্যাডমিরাল ডেভিডসনের একজন মুখপাত্র বলেন, ডেভিডসন সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ একটি আলোচনা করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি পরিবর্তনের উপর কোন গুরুত্ব দেননি।

তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে ও চীন যুদ্ধে জড়াবে কিনা জানতে চাইলে ডেভিডসন বলেন, চীন গত দুই দশকে তার পারমানবিক সক্ষমতার মাত্রা কয়েক গুন বাড়িয়েছে। যদি তাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩০ সালে মধ্যে পারমানবিক অস্ত্রের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন।

আরকানসাস থেকে নির্বাচিত সিনেটর টম কটন বলেছেন, নিউ ষ্টার্ট আমর্স কন্ট্রোল চুক্তির সাম্প্রতি সংযোজিত নতুন শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ৮০০ পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। কিন্তু চীন অস্ত্র মোতায়েনের ক্ষেত্রে কোন নিয়ন্ত্রণ বা সীমারেখার মধ্যে নেই। যদি তারা তাদের অস্ত্রের মজুদ তিন বা চারগুন বৃদ্ধি করে তাহলে তা ঠেকানোর উপায় নেই। তখন এই দশক শেষ হবার আগেই চীন পরমানু অস্ত্রের সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন বিশ্লেষক।

বিশ্লেষকদের এই অনুমান সঠিক কিনা তা অ্যাডমিরাল ডেভিডসনের কাছে জানতে চান সিনেটর টিম কটন। জবাবে অ্যাডমিরাল ডেভিডসন বলেন, যদি চীন তার পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ কয়েক গুন বৃদ্ধি করে তাহলে সেটা সম্ভব হতে পারে। কয়েকজন বিশ্লেষক এই হিসাবের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পরমানু অস্ত্রের দিক দিয়ে সব সময়ই চীন থেকে এগিয়ে থাকবে। সেন্টার ফর ষ্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ষ্টাডিজ এর চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বোনি গ্লাসার মনে করেন , চীন যদি তার পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ কয়েকগুর বাড়িয়েও থাকে তাহলেও তা ৯০০ অতিক্রম করবেনা। এই সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক কম।

নতুন ষ্টার্ট চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ১৫৫০টি পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশটির কাছে পরমানু অস্ত্রের মজুদ আছে ৩৮০০টি। কাজেই চীন পরমানু অস্ত্রর মজুদের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।

চীন তাইওয়ান এবং দক্ষিন ওপূর্ব চীন সাগরকে কেন্দ্র করে তার সামরিক তৎপরতা অনেক বৃদ্ধি করার কারণে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কড়া ভাষায় চীনের সমালোচনা করেছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কিভাবে চীনের মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে তিনি গত শুক্রবার চতুষ্টয়ের অপর তিন সদস্য দেশ জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতের সাথে আলোচনা করেছেন।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি বিমানবাহী রণতরী দক্ষিন চীন সাগরে প্রশিক্ষন মহড়া দিয়েছে। ২০১২ সালের পর এই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের এটি দ্বিতীয় মহড়া। চীনের যুদ্ধ ও বোমারু বিমানগুলো মার্কিন রনতরী ইউএসএস থিওডর রুজভেল্ট লক্ষ্য করে হামলা চালানোর ভঙ্গি করে উড়ে যাওয়ার পর মার্কিন রণতরীগুলো তাইওয়ান প্রণালীতেও প্রবেশ করে।

মার্কিন বাহিনীর ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের গোয়েন্দা প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাইকেল ষ্টুডম্যান বলেছেন, চীন স্প্রাটলি দ্বীপসহ দক্ষিন চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ দ্বীপগুলোকে ব্যাপক সামরিকীকরণ করছে। একইসঙ্গে তারা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করছে।

স্প্রাটলি দ্বীপে চীন যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করবে বলেও জানান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাইকেল ষ্টুডম্যান। তিনি বলেন, অথচ ২০১৫ সালে প্রেসিন্টে মি জিন পিং দক্ষিন চীন সাগরে দ্বীপ গুলোকে অস্ত্র সজ্জিত না করার অঙ্গিকার করেছিলেন। কিন্তু এখন তারা সেখানে যুদ্ধ বিমানও মোতায়েন করছে।

ষ্টুডম্যান মনে করেন, সেখানে প্রথমে চীন অল্প কয়েকটি যুদ্ধ বিমান নিয়ে যাবে। এর পর তারা ঐ এলাকাকে দুর্গে পরিণত করবে। সেখানে তারা যত খুশি সমরাস্ত্র মোতায়েন করবে। এর বিপরীতে আমরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিতে তেমন কিছুই করছিনা।

তবে অ্যাডমিরাল ডেভিডসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক তৎপরতার মোকাবেলায় প্যাসিফিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ বা প্যাসিফিক প্রতিরক্ষা উদ্যোগ গ্রহনের উপর জোর দেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলেছে একটি জোট।

অ্যাডমিরাল ডেভিডসন জানান, এটি কেবল একটি সামরিক জোটই হবেনা, তারা বিশ্ব অর্থনীতি, টেলিযোগাযোগ ও ফাইভ জি সহ জটিল প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক নানা সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রেও পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করবে। এই জোট শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সমগ্র বিশ্বের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্যও কাজ করে যাবে বলে জানান অ্যাডমিরাল ডেভিডসন।