এবার যুক্তরাষ্ট্রে এফ-৩৫ কর্মসূচি বাতিলের দাবি


  • মেহেদী হাসান
  • ১৪ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৭

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র কর্মসূচি হলো এফ-৩৫। ২০৪৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজারের বেশি এফ-৩৫ বিমান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ৬০ বছর। ৬০ বছর ধরে এসব বিমান পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রকে খরচ করতে হবে ১ দশমিক ৭০ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

এফ-৩৫ এর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। ভবিষ্যতে এর পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে তাতে উদ্বিগ্ন দেশটির অনেক নীতিনির্ধারক। বর্তমানে একটি এফ-৩৫ বিমান আকাশে এক ঘন্টা অবস্থান করলে খরচ হয় ৩৬ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এমন ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমান কর্মসূচি বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।

হাউস অব আর্মড সার্ভিসেস কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান এডাম স্মিথ এ দাবি জানিয়ে বলেছেন, সংখ্যা নয় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে দক্ষতার ওপর। তিনি বলেন, আমাদের ইদুরের গর্তে অর্থ ঢালা বন্ধ করতে হবে। এফ-৩৫ বিমান কেনা বন্ধ করে এফ-১৫ ইএক্স এর প্রতি অধিক মনোযোগী হবার আহবান জানিয়েছেন এডাম স্মিথ।

এফ-৩৫ এর পেছনে ভবিষ্যতে যে ১ দশমিক সাত শূন্য ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে তা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে ট্যাক্স বাবদ। ব্যয়বহুল এফ-৩৫ বিমান কর্মসূচি নিয়ে অনেক বিরোধিতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রাট রিপাবলিকান উভয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে।

এফ-৩৫ একটি জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার প্রজেক্ট। এ প্রকল্পে বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা. তুরস্ক, ইতালি, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডসসহ আরো বিভিন্ন দেশ। তুরস্কের ১২০টি এফ-৩৫ সংগ্রহ করার কথা ছিল। কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম ক্রয়ের কারনে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বের করে দিয়েছে।

এফ-৩৫ বিমান প্রথম যুদ্ধে ব্যবহার করে ইসরাইল ২০১৮ সালে। ২০৭০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নেভি, এয়ারফোর্স এবং মেরিন কর্পস এ বিমান সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনা করছে । বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, ইতালী, জাপান, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে এবং দক্ষিন কোরিয়ার কাছে এ বিমান রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামরিক ব্যয় । কংগ্রেসে এটা এখন একটি হট ইস্যু। ডেমোক্রেট রিপাবলিকান উভয় সদস্যদের অনেক দিন ধরে আপত্তি রয়েছে সামরিক খাতের ব্যয়বহুল বিভিন্ন কর্মসূচি বিষয়ে।

চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র নেভি চাচ্ছে ৫০০ রণতরীর একটি বহর গড়ে তুলতে। শত্রুর ড্রোন ভূপাতিত করতে নেভি চাচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তির অনেক আনম্যানড ভেসেল। বিমানবাহিনীর এফ-৩৫ কর্মসূচি নিয়ে যখন নানা ধরনের সমালোচনা চলছে তখন সামনে আসছে আরেক ব্যয়বহুল কর্মসূচি বি-২১ স্কাই রেইডার বোমারু বিমান নির্মাণ কর্মসূচি। দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত বি-২১ এর চলতি বছরই ফ্লাইট টেস্টের কথা রয়েছে। এর খরচ হতে পারে ৫শ থেকে ৬শ মিলিয়ন ডলার।

অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির রয়েছে সমরাস্ত্র আধুনিকায়নের অনেক কর্মসূচি। রয়েছে পারমানবিক অস্ত্র ডেলিভারি সিস্টেম এবং অবকাঠামো উন্নয়নের পেছনে শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। আরো রয়েছে হাইপারসনিক মিসাইল, মহাকাশ ফোর্সের পেছনে খরচ। এভাবে যদি তালিকা করা হয় তাহলে প্রতিরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর খরচের হিসাবে অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে।

হাউস অব আর্মড সার্ভিসেস কমিটির চেয়ারম্যান এডাম স্মিথ, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট ফোরামে বলেছেন, এফ-৩৫ বিমান প্রকল্প বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, ইউএস এয়ারফোর্সের এ বিমান অন্য সব শাখার জন্য একটি মডেল হতে পারে। আমাদের মূল্যবান অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর নৌ বহরের রণতরীর সংখ্যায় আপ্লুত হলে চলবে না। অপচয় করার মত অর্থ আমাদের কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্র যেমন রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিন স্লাযুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল চীনের সাথে সেরকম কোনো যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এডাম স্মিথ। চীন, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক উত্তেজনাকর পর্যায়ে যাতে না যায় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনা এবং কূটনৈতিক উদ্যোগের পরামর্শ দেন তিনি।

এডাম স্মিথ বলেন, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মাও সেতুং আর চৌ এন লাই এর সাথে বৈঠক করেছিলেন। আর রোনাল্ড রিগান বৈঠক করেছিলেন মিখাইল গর্ভাচেভের সাথে। এর ফলে ঠান্ডা লড়াই গরম লড়াইয়ে পরিণত হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক বোমার সংখ্যা ৫ হাজারে উন্নীতকরণ এবং পারমানবিক অস্ত্র আধুনিকীকরনের জন্য দেড় লাখ কোটি ডলার খরচের কংগ্রেশনাল আহবান প্রত্যাখ্যান করেছেন এডাম স্মিথ। এফ-৩৫ প্রকল্পকে অনেকে ওয়ান ট্রিলিয়ন ডলার মিসটেক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

নির্মাণের পর থেকে এফ-৩৫ বিমানে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ধরা পড়তে থাকে। এ ছাড়া এ বিমান পরিচালনা এবং রক্ষনাবেক্ষন খরচ এতই বেশি যে, তা নিয়ে অর্থের অপচয় হিসাবে অনেকের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে।

বর্তমানে এফ-৩৫ বিমানে ফাইটার ড্রোন ধারনা যুক্ত করা বিষয়ে গবেষনা করছে যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স। অপর দিকে এয়ারফোর্স রিসার্স ল্যাবরেটরি ২০১৮ সালের মার্চে শুরু করেছে সিক্সথ জেনারেশন ফাইটার জেট এফ- এক্স নির্মাণের কার্যক্রম। এ বিমান প্রতিপক্ষের বিমানের বাধা উপেক্ষ করে শত্রুপক্ষে প্রবেশ করার সক্ষমতা ছাড়াও বহন করতে পারবে হাইপারসনিক অস্ত্র। যদিও এ বিমান উৎপাদনে যাবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত করেনি যুক্তরাষ্ট্র।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট ফোরামে এডাম স্মিথ বলেন, আমাদের কমান্ডারদের চাওয়া অনুযায়ী যত ইচ্ছা তত অর্থ দিতে পারি না। নির্দিষ্ট পরিমান ঠিক করে তাদেরকে বলতে হবে এই তোমাদের বাজেট। এখন এর উপযুক্ত ব্যবহার করো। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে।

বিমানের আবিষ্কারক যুক্তরাষ্ট্র। ফলে প্রায় সব ধরনের যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে আকাশে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে প্রতিপক্ষের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের যে এয়ার সুপেরিয়রিটি রয়েছে তার কারন এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার। যদিও শুরু থেকে এ বিমান নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই।

এফ-৩৫ নিয়ে সমালোচনার মূলে রয়েছে বিপুল অর্থ ব্যয়, দেরিতে ডেলিভারীসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি। তাছাড়া এ বিমানের যেসব দক্ষতা নির্ধারণ করা হয়েছিল শুরুতে তার মাত্র ৬৯ ভাগ অর্জিত হয়েছে। এ বিমান নিয়ে আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি বর্তমান সময়ের মোস্ট এডভান্সড ফাইটার জেট। এর রয়েছে তাক লাগানো অনেক বৈশিষ্ট্য।

এফ-৩৫ বিমানের নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নরথ্রপ গ্রুপ ম্যান এবং বৃটেনের বিএই সিস্টেম এর সহযোগী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

এফ-৩৫ একটি পঞ্চম প্রজম্নের বহুমুখী যুদ্ধবিমান। এটি একটি স্টেলথ ফাইটার অর্থাৎ প্রতিপক্ষের রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এয়ার সুপেরিয়রিটি এবং স্ট্রাইক মিশন উভয় দক্ষতা রয়েছে এ বিমানের। এছাড়া রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইন্টেলিজেন্স, সাভির্লেন্স এবং রকনিসেন্স ক্ষমতা।

এ বিমানের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো হেলিকপ্টারের মত সম্পূর্ণ ভার্টিক্যাল উপায়ে উডডয়ন এবং অবতরণ করতে পারে। ফলে এর অবতরণ ও উডয়নের জন্য কোনো রানওয়ের প্রয়োজন হয়না। দীর্ঘ সময় আকাশে এক স্থানে স্থির হয়ে থাকতে পারে এফ-৩৫ ফাইটার জেট। এমনিক রয়েছে পেছনে চলার ক্ষমতা। টেকনিক্যাল উপায়ে পেছনেও চলতে সক্ষম এ বিমান। সক্ষম ব্যাকওয়ার্ড ল্যান্ডিং করতে ।

এর রয়েছে এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস মিসাইল এবং এন্টি শিপ মিসাইল ক্ষমতা। এফ-৩৫ প্রথম আকাশে ওড়ে ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রথম সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র মেরিন কর্পস এ। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬২০টি নির্মাণ করা হয়েছে এ যুদ্ধবিমান।