ফ্রান্সের এয়ার অ্যান্ড স্পেস আর্মি প্রথমবারের মতো রাফালে জেটবিমানে একটি মিটিওর বা উল্কা নামের মিসাইল সংযোজন করে তা দিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে। বর্তমানে রাফালে বিমানের যে এফথ্রিআর এয়ারফ্রেম সংস্করণটি আছে, তার থেকে উন্নত একটি সংস্করণ নিয়ে আসার প্রত্যাশা থেকে রাফালে এই অভিযানটি পরিচালনা করে। মিটিওর বা উল্কা হলো উন্নত প্রযুক্তির মিসাইল, যা চোখের সীমানার বাইরে বড় দূরত্বে এয়ার টু এয়ার পদ্ধতিতে নিক্ষেপ করা হয়।
ফ্রেঞ্চ এয়ারফোর্স একটি টুইটারে এ অভিযানের কথা জানিয়েছে। টুইট বার্তায় বলা হয়, রাফালের এফ-থ্রি বিমানটি একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিমান। আমাদের এয়ার অ্যান্ড স্পেস আর্মি সম্প্রতি মিটিওর মিসাইলকে সংযুক্ত করে তাদের প্রথম অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। আরেকটি টুইট বার্তায় বলা হয়, এই অভিযানটি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, রাফালের এ বিমানগুলো ভালোভাবেই অস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
মিটিওর নামের এই বহুল আলোচিত মিসাইলটি তৈরি করেছে এমবিডিএ। মিটিওর হলো সক্রিয় রাডার পরিচালিত বিভিআর এয়ার টু এয়ার মিসাইল। যা একইসাথে বেশ কয়েকবার নিক্ষেপ করা যায়। এ মিসাইলটি দিয়ে জেট বিমান কিংবা মনুষ্যবিহীন ড্রোন বা ইউএভি এবং ক্রুজ মিসাইলকে এর ভারী ইলেক্ট্রনিক কাউন্টার মেইজারের মাধ্যমে টার্গেট করতে পারে। এ মিসাইলগুলো ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। ফরাসী বিমান বাহিনী দাবি করছে, এখন থেকে এয়ার এন্ড স্পেস আর্মি এর প্রথাগত এবং পারমানবিক প্রতিরক্ষা মিশন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এয়ার বা এয়ার মিসাইল সংক্রান্ত সক্ষমতাও বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে।
রাফালের উন্নত সংস্করন নিয়ে কাজ করতে হলে মিসাইলের সংযোজন অপরিহার্য। তেলচালিত একটি রামজেট মোটর দিয়ে মিসাইলগুলোকে ম্যাক-ফোর গতিতে নিক্ষেপ করা হয়। এ গতিতে অগ্রসর হলে যে কোনো মাঝারি আকৃতির টার্গেটে মিসাইলগুলো আক্রমন বা ইন্টারসেপট করতে পারবে। দ্বিমুখী ডাটালিংক থাকায় বিমান থেকে মিড কোর্স টার্গেট সম্পর্কে তথ্য দিয়ে দেয়া যায় অথবা টার্গেটকে প্রয়োজনে নতুন করে সনাক্তও করা যায়।
ডাটালিংকগুলো দিয়ে মিসাইল সংক্রান্তে যেকোনো তথ্য বিশেষ করে ফাংশনাল এবং কিনেম্যাটিক স্ট্যাটাস, একাধিক টার্গেট বিষয়ক তথ্য, এবং টার্গেটের কাছে পৌঁছানোর পর নোটিফিকেশন পাওয়াসহ আরো প্রয়োজনীয় সব তথ্যই সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
রাফালের দেয়া তথ্যনুযায়ী মিটিওর এখন মিসাইলের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও কার্যকরী। গোটা বিশ্বেই মিটিওরের চাহিদা রয়েছে। ফ্রান্স, ভারত, যুক্তরাজ্য, স্পেন, সুইডেন ও ইতালিসহ অনেক দেশই এ মিসাইলটি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করছে। ফ্রান্সের বিমান বাহিনী মিটিওর মিসাইলটিকে গেম চেঞ্জার হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে যে, মিটিওর সংযোজিত হওয়ায় রাফালের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। রাফালের জন্য এটি যুগান্তকারী ঘটনা।
রাফালে বিমান হলো ফ্রান্সে নির্মিত একটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান, যাতে ডেলটা উইং থাকছে। ডাসল্ট এভিয়েশন বহুমুখী কাজ করার মতো পরিকল্পনা নিয়েই এ বিমানটি বানিয়েছে। এতে থাকছে নানা ধরনের অস্ত্র। রাফালে দিয়ে আকাশ পথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আকাশে ভাসমান অবস্থায় প্রতিপক্ষের অন্য বিমান মোকাবেলা, ভাসার ক্ষেত্রে অভিনবত্ব, ভূমি থেকে সহযোগিতা, ইন-ডেপথ স্ট্রাইক, যেকোনো জাহাজে আক্রমন, নিউক্লিয়ার ডিফেন্স অপারেশনসহ আরো নানা ধরনের অভিযান চালানোর মতো সক্ষমতা এই বিমানটির আছে।
বর্তমানে ফ্রান্সের এয়ার এন্ড স্পেস আর্মি, হেলেনিক এয়ারফোর্স, ভারতীয় বিমান বাহিনী, মিশরীয় বিমান বাহিনী এবং কাতার বিমান বাহিনী নিয়মিতভাবে রাফালে ব্যবহার করছে।
রাফালে বিমানটি অন্য যেকোনো বিমানের তুলনায় অধিক কার্যকর কারণ এ বিমানগুলো সংগে মিটিওর নামের আলোচিত মিসাইলটি ছাড়াও আরো নানা ধরনের অস্ত্র ও অন্যান্য বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারে। যার মধ্যে আছে মাইকা নামক এয়ার টু এয়ার মিসাইল- যা চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টির বাইরে অনেক লম্বা দূরত্বেও পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমন চালাতে হবে।
শত্রুপক্ষের যেকোনো কমব্যাট এবং সেল্ফ ডিফেন্স মিসাইলকে অকার্যকর করে দিতে পারবে। মাইকা মিসাইলটি স্বল্প দুরত্বের টার্গেটে হামলা করার ক্ষেত্রেও বেশ কার্যকর।
রাফালে হ্যামার মডিউলার নিয়েও ভাসতে পারে। হ্যামার হলো উচ্চ মাত্রার এবং লম্বা পরিসীমায় কাজ করার মতো একটি মডিউলার। সংগে আরো থাকতে পারে স্কালপ নামের দূরপাল্লার স্ট্যান্ড অফ মিসাইল। এএম থার্টি নাইন এক্সোসেট ধরনের এন্টি শিপ মিসাইল। লেজার চালিত বোমা। এই বোমাগুলোর ওয়ারহেড ৫শ এলবিএস থেকে শুরু করে ২ হাজার এলবিএস পর্যন্ত হতে পারে। এগুলোর বাইরে, স্বাভাবিক যে বোমাগুলো আছে, সেগুলোর অধিকাংশই রাফালে দিয়ে বহন করা সম্ভব। পাশাপাশি, নির্মাণের সময় যদি কোনো ক্রেতা রাফালের কাছে বিশেষ কোনো অস্ত্র বা বিস্ফোরক বহন করার মতো জায়গা রাখতে বলে তাহলে রাফালে সেই ব্যবস্থাও করতে সক্ষম।
অস্ত্র ও বিস্ফোরকগুলো রাফালে বিমানের যে স্থানে রাখে তা তৈরি করা হয়েছে মিলস্টেড ওয়ান সেভেন সিক্স জিরো কমপ্লাইন্টের আলোকে। ক্রেতাদের পছন্দমতো যেকোনো অস্ত্রই এখানে রাখা সম্ভব। সব মিলিয়ে রাফালে প্রায় ১০ টন ওজনের মালামাল বহন করতে পারবে। বিমানে ১৪টি হার্ডপয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৫টি ভারী অস্ত্রসস্ত্র ও সরঞ্জামাদি বহন ও নামাতে পারবে। আবার এই ওজনের সমপরিমান পেলোডও বিমানটি বহন করতে পারে।
এই বিমানে ভূমিতে অবতরণ না করে আকাশ থেকেই প্রয়োজনীয় জ্বালানি নেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। রাফালে বিমানটিতে উন্নত এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করায় বিমানটি একই অভিযানে গিয়ে এয়ার টু এয়ার এবং এয়ার টু গ্রাউন্ড ধরনের মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে। অনেক কম উচ্চতায় শত্রুপক্ষের এলাকায় প্রবেশের সময়ও রাফালে থেকে এয়ার টু এয়ার মিসাইল ছুড়তে পারে যা এই বিমানের পারদর্শিতাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
বর্তমানে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডাসল্ট এভিয়েশন ছাড়াও রাফালে ছাড়াও বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান নির্মানের বিষয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে একটি যৌথ প্রকল্পও আছে, এর আওতায় ফ্রান্স, জার্মানী ও স্পেন মিলে মনুষ্যবিহীন বিমান নির্মানের চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালে ডাসল্টতের সাথে সমন্বয় করে এই তিনটি দেশ এই প্রকল্পটি শুরু করে।
এবার আশা যাক এশিয়ার সামরিক পরাশক্তি চীনের খবরে। চীনের সামরিক বাহিনী দাবি করছে তারা ইসটার নামে একটি সেন্সর সিস্টেমকে সফলতার সাথে ভারতের অরুনাচল প্রদেশ সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করতে চেয়েছে। ইসটার হলো একটি সেন্সর সিস্টেম যা দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তি, নজরদারি, টার্গেট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও দুরত্ব নির্নয় করা যায়।
চীন পূর্ব লাদাখ থেকে নিজেদের মোতায়েনকৃত সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার একমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে নতুন এই তথ্য দিলো। চীন সেন্সর সিস্টেমগুলোকে বলছে, হট আইজ এবং গোল্ডেন আইজ। মূলত প্রতিটি মুহুর্তে প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ন এলাকায় নজর রাখার উদ্দেশ্যেই চীন এই সেন্সর সিস্টেমটির প্রবর্তণ করেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিসিটিভি-সেভেন চ্যানেলের খবরে বলা হয়েছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির পদাতিক সেনারা তিব্বতের পাদদেশে নতুন এই সেন্সর সিস্টেমটির ব্যবহার শুরু করেছে। সেনাবাহিনীর এ অংশটি পিএলএ’র পশ্চিম কমান্ড নিয়ন্ত্রন করছে। চীনের ভূমিতে কর্মরত জিয়াও বর্ডার পোস্টে এই সিস্টেমের ব্যবহারও ভিডিওতে দেখানো হয়। এই এলাকাটি লাইন অব এ্যাকচুয়াল অব কন্ট্রোল বা এলএসি’র একেবারেই নিকটে। এলএসি দিয়েই মূলত ভারত ও চীনের সীমানাকে আলাদা করা হয়। চীনের এই সীমান্ত এলাকাটি শাননান মিলিটারীর অধীন এলাকায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৪শ মিটার উপরে। ১৯৬২ সালে ঠিক এই এলাকা দিয়েই ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সীমান্ত এলাকায় সামরিক শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি করেছে। চীনা সেনারা শুধুমাত্র সেন্সর সিস্টেমই বসায়নি, বরং সেখানে উন্নত ব্যারাকও স্থাপন করেছে। নানা ধরনের ওয়াচডগ এবং সেন্সরও সক্রিয় করেছে। হট আই নামের যে সেন্সরটি চীন এবার ব্যবহার করছে, তা ৩৬০ ডিগ্রী রোটেশনে সব দিকেই নজর রাখতে পারে। অন্যদিকে, গোল্ডেন আই সেন্সর সিস্টেমে মানুষ দ্বারা বহনযোগ্য আইআর ক্যামেরা সংযোজন করা হয়েছে যা ট্রাইপডের ওপর রেখেও কাজ চালানো যাবে। এতে আরো থাকছে ভিউ ফাইন্ডার এবং লেজার চালিত রেঞ্জ ফাইন্ডার। আশপাশের ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার এলাকায় এই সেন্সর সিস্টেমটি কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।