বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বোমার বিস্তার রোধে কাজ করছে এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অতিসম্প্রতি স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে একটি ভয়ঙ্কর তথ্যের সন্ধান পেয়েছে। এমন বেশ কিছু ছবি ও তথ্য এসে পৌঁছেছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে, বিগত এক যুগের মধ্যে এই প্রথম ইসরাইল দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ডিমোনায় স্থাপিত পারমাণবিক স্থাপনায় নতুন করে বেশ কিছু নির্মাণকাজ শুরু করেছে। ডিমোনা পারমাণবিক প্রকল্পটি বেশ পুরনো। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করার পরই ইসরাইলি নীতিনির্ধারকেরা ৮০ বছর আগে, অর্থাৎ ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই ডিমোনা পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করে।
ডিমোনা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহর যা নেগেভ মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত। বীরসেবা থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে এবং ডেড-সি থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এই পারমাণবিক কেন্দ্রটির অবস্থান। এখান থেকে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করা হয় যা ইসরাইলের ৮০ টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের জন্য জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইসরাইলি সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র থাকার কথা কখনও স্বীকার করা হয়নি। আবার পারমাণবিক অস্ত্র আছে তা অস্বীকার করেনি। তবে ধারণা করা হয়, ইসরাইলের হাতে অনেক বছর আগে থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়ে গেছে। ২০০২ সালে মার্কিন ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় নতুন কিছু তথ্য ও নথিপত্র প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, ইসরাইলের পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে প্রচলিত অনেক তথ্যই অতিরঞ্জিত। এসব কাগজপত্র থেকে ইসরাইলের হাতে ৮০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি দেশটির হাতে এই ওয়ারহেডগুলো বহন করার মতো মিসাইল, বিমান এবং সমুদ্র থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ক্রুজ মিসাইলও আছে।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এপিকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে ওয়াশিংটনভিত্তিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আর্মস কন্ট্রোল এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল কিমবাল জানিয়েছেন, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের জন্য আরেকটি উপকরণও খুবই গুরুত্বপূর্ন আর এটি হলো ট্রিটিয়াম। ট্রিটিয়াম হলো এক ধরনের হাইড্রোজেন আইসোটোপ যা দিয়ে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের স্থায়ীত্ব ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া কোথাও এই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরন ঘটানোর প্রয়োজন হলে সেই বিস্ফোরনটা অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক করার জন্যও ট্রিটিয়ামের প্রয়োজন হয়। ট্রিটিয়াম ব্যবহার করলে প্লুটোনিয়ামের অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হবে।
যেকোনো অস্ত্র এমনকী ছোটখাটো ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরন সক্ষমতাকে কয়েকগুন বৃদ্ধি করে ট্রিটিয়াম। নিউট্রন বোমা তৈরির কাজেও ট্রিট্রিয়াম বোমা ব্যবহার করা হয়। নিউট্রন বোমা হলো মানবইতিহাসের অন্যতম ধ্বংসাত্মক বোমা-যা অল্প এলাকাজুড়ে বিস্ফোরিত হলেও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করতে পারে। ড্যারিল কিমবাল মনে করছেন ইসরাইল হয়তো ট্রিটিয়ামের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্যই আবার ডিমোনায় কাজ শুরু করেছে। কারণ ট্রিটিয়ামের ব্যবহার রেডিওএ্যাকটিভ বাইপ্রোডাক্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে ওয়ারহেডগুলোকে আরো অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ হতে সাহায্য করবে।
প্লুটোনিয়ামসহ অন্য আরো যেসব উপাদান ও উপকরণ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ তৈরি করা হয়, ট্রিটিয়াম তার মধ্যে একটি। নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টর ব্যবহার করেই ট্রিটিয়াম তৈরি করা হয়। লিথিয়াম ধাতুর পর বাড়তি আলোর বিকিরণ ঘটিয়েও ট্রিটিয়াম উৎপাদন করা যায়। তবে ট্রিটিয়ামের আইসোপোটগুলো প্লুটোনিয়ামের তুলনায় কম স্থিতিশীল হওয়ায় নিউক্লিয়ার আর্সেনালে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ট্রিটিয়ামের চুল্লি বারবার খালি হয়ে যায়। এবং তাই একে বার বার পূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হয়।
প্রখ্যাত পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ আভনার কোহেন আশংকা করছেন, ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রের পুরনো রিএ্যাক্টরটি বেশি পুরনো হওয়ায় এর কার্যকারিতা কমে গেছে। ট্রিটিয়াম উৎপাদন কার্যক্রম অব্যহত রাখার জন্য ইসরাইলকে নতুন করে রিএ্যাক্টর তৈরির কাজ করতে হচ্ছে।
স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই ইসরাইলিরা ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রে নতুন করে বেশ কিছু স্থাপনার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের শেষ বা ২০১৯ সালের শুরু থেকেই এ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় দুই বছর যাবত কাজটি চলমান রয়েছে।
সম্প্রতি যে ছবিগুলো পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এখনো ডিমোনায় শুধু খোড়াখুড়ি চলছে, নির্মাণাধীন কোনো কাঠামো ছবিতে ধরা পড়েনি। প্রশ্ন হলো, দুই বছর ধরে যদি নির্মান কাজ শুরু হয়, তাহলে এখনো কোনো কাঠামোই কেন পূর্নাঙ্গ বা আংশিক রূপ পেলো না ?
কাজের গতি এতটাই ধীর দেখে বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুরনো রিএ্যাক্টর বন্ধ করা নিয়ে নীতি নির্ধারনী মহলে সিদ্ধান্তহীনতা অথবা অর্থ সংস্থানের সংকটের কারণে কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।
এমন প্রশ্নও উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থাটি এই ছবি প্রকাশ করার জন্য এই সময়টাকেই কেন বেছে নিলো? বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের সাথে পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসনের সময়ে করা চুক্তিকে নিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন কাজ শুরু করেছেন। যা নিয়ে ইসরাইলের নীতি নির্ধারকদের সাথে বাইডেনের কিছুটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায়, ছবিগুলো প্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বার্তাই দিতে চাইছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শুধু ইরানই নয়, বরং ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক কর্মকান্ডও ভয়াবহ বিপর্যয় ও সংকটের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
যদি ইসরাইলের চলমান নির্মাণ কার্যক্রম শুধুমাত্র ট্রিটিয়াম উৎপাদনের জন্যই হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, ইসরাইল হয়তো এখনি হাইপারসনিকের মতো নতুন প্রযুক্তির কোনো অস্ত্র তৈরিতে আগ্রহী নয়। শুধু ট্রিটিয়াম উৎপাদন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বুঝতে হবে যে, ইসরাইল মূলত তার বর্তমান পারমাণবিক অস্ত্র কাঠামোকেই আরো মজবুত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা বিশ্ব মোড়লদের পরিহাসের আরেকটি দৃষ্টান্ত। ইসরাইল কী কারণে এই নির্মান কাজ করছে, ট্রিট্রিয়াম উৎপাদন না অন্য কিছু তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। অথচ ইসরাইলের আদৌ এই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ বা পারমাণবিক কেন্দ্রে গোপনে কাজ চালানোর কোনো সুযোগ আছে কিনা- সেই নৈতিক প্রশ্ন কেউ তুলছেন না। অথচ যদি মুসলিম কোনো দেশে এক কনা ইউরেনিয়াম বেশি রফতানি হতো অথবা ইউরেনিয়াম উৎপাদনের জন্য কেউ যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো তাহলে গোটা বিশ্ব তার বিরুদ্ধে কথা বলতো।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের এই দ্বৈত অবস্থানই বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া যাবতীয় সংকটের মূল কারণ। ইসরাইলের যদি পারমাণবিক কোনো প্রকল্প চালু করার প্রয়োজন থাকে তাহলে তারা তা করতেই পারে। অথচ ইরান কিংবা অন্য কোনো মুসলিম দেশ এই পথে অগ্রসর হলেই পশ্চিমা শক্তি যেন আতংকিত হয়ে পড়ছে। এমন ধারনা দেয়ার চেষ্টা করে মুসলিমরা এই বোমা ফাটিয়ে সারা বিশ্বকেই ধ্বংস করে দেবে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক প্রকল্প গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা পৃথিবীর জন্যই অশনি সংকেত হয়ে উঠতে পারে।
পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ আভনার কোহেন ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের পর সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বোমামুখী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ডেভিন বেন গুরিয়ন ইসরাইলের পক্ষে প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প চালু করেছিলেন। কেন ইসরাইলের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকা প্রয়োজন তা নিয়ে দফায় দফায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। নেতানিয়াহু ঠিক একই পথে অগ্রসর হচ্ছেন। নেতানিয়াহুর মতে ইসরাইলের ভূ-রাজনৈতিক যে অবস্থান তা বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য পারমাণবিক প্রকল্পের জগতে ইসরাইলের আধিপত্য সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
ইসরাইল শুধু নিজেদের জন্য পারমাণবিক বোমা বানাবার কথা বলেনা। বরং আশপাশের দেশগুলোতে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাও ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এর আগে ইসরাইলের সাবেক এক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এহুদ ওলমার্টও সিরিয়ার পারমাণবিক প্রকল্পের রিএ্যাক্টরে হামলা চালানোর জন্য তার দেশের সেনাবাহিনীকে আদেশ দিয়েছিলেন। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সবসময়ই ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে আমেরিকাসহ বিশ্ব মোড়লদেরকে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করছেন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধে তারা যেন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।