পাকিস্তানের সাথে মিলে যৌথভাবে যুদ্ধবিমান ও মিসাইল তৈরির জন্য তুরস্ক বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান চীনের সাথেও সমরাস্ত্র নির্মাণ ও বিনিময় প্রক্রিয়ার আওতায় রয়েছে। এবার এ প্রক্রিয়ায় তুরস্কও যুক্ত হওয়ায় তিন দেশের মধ্যে সামরিক খাতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার সাথেও ঘনিষ্ট সামরিক সর্ম্পক বাড়াতে চায় পকিস্তান। যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তুরস্ক ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত জানুয়ারি মাসে বেশ কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। তারা পাকিস্তানের সাথে মিলে সামরিক হার্ডওয়্যার নির্মাণের বিষয়ে একমত হন।
ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র তুরস্কের সাথে চীনের ব্যবহৃত অস্ত্র প্রযুক্তির বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। পাকিস্তান এরই মধ্যে চীনের সহযোগিতায় জেএফ-সেভেনটিন যুদ্ধবিমান তৈরি করেছে এবং দাবি করছে, শাহীন ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্মাণেও তারা চীনের নকশা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান পারমানবিক শক্তি সম্পন্ন দেশ হওয়ায় তুরস্ক পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করছে। পাকিস্তানের সাথে মিলে তুরস্ক দূরপাল্লার মিসাইল প্রকল্প এবং টিএফ-এক্স যুদ্ধ বিমান নির্মাণেও অনেকটা অগ্রসর হয়েছে।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ চীনের সমরাস্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন। কয়েকটি দেশে চীনের অস্ত্র রফতানির ওপর বেশ কিছু বিধি নিষেধও আরোপ করেছে।
অন্যদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান পাকিস্তানের সাথে সমন্বিত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিয়া মুহাম্মাদ হিলাল হুসেইন গত ডিসেম্বরে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হুলুসি আকারের সাথেও বৈঠক করেন। এ সময় তারা প্রতিরক্ষা শিল্পখাতের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর নানা উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। এর আগে গত বছর পাকিস্তানে এরদোয়ানের সফরের সময়ও হুলুসি আকার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান ও তুরস্ক তাদের যৌথ সামরিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে এরই মাঝে বেশ কিছু সমরাস্ত্র বিনিময় করেছেন। তুরস্ক পাকিস্তানের কাছে একাধিক যুদ্ধ জাহাজও বিক্রি করেছে।
পাকিস্তান-তুরস্ক সামরিক সর্ম্পক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে চীনের সম্পৃক্ততার কারণে। বহু বছর ধরে চীন থেকে সমরখাতের নানা নকশা ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের বেশ কিছু সমরাস্ত্রও সেই আদলে নির্মিত হয়েছে। এখন পাকিস্তানের কাছ থেকে তুরস্ক আবার সেগুলো সংগ্রহ করায় পাকিস্তানের কাছ থেকে তুরস্ক আসলে চীনের সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে মার্কিন আপত্তি অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার নিরাপত্তা সিস্টেম ক্রয় করায় তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে দু দেশের মধ্যে অনেকটা দূরত্বও তৈরি হয়েছে। এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নির্মাণ সংক্রান্ত যৌথ প্রকল্প থেকেও তুরস্ককে বাদ দেয়া হয়েছে। মার্কিনীরা আশংকা করছে, এত কিছুর পরও তুরস্ক যদি আবার চীনের প্রযুক্তির দিকে বেশি ঝুঁকে যায় তাহলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় বরং গোটা পশ্চিমা সামরিক জোট থেকেই তুরস্ক ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে। তুরস্ব ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছে, আগামী সময়ের বহুমাত্রিক বিশ্বে তুরস্ক অন্যতম খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আর সেই প্রত্যাশা পূরণে নিজেদেরকে সামরিকভাবে অগ্রসর করার জন্য যা করতে হয় তুরস্ক তা করতে মোটেও কার্পন্য করবে না।
আংকারা এর আগে চীন থেকে একটি ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু মার্কিনীরা চীন থেকে ডিফেন্স সিস্টেম না কেনার জন্য প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করলে তুরস্ক তা থেকে সরে আসে। এর দুই বছর পর রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে তুরস্ককে এই জন্য শায়েস্তা করতে চাইছে তারপরও জানা গেছে যে তুরস্ক দ্বিতীয় আরেকটি এস-ফোর হান্ড্রেড ডিফেন্স সিস্টেম নির্মাণের জন্য মস্কোর সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ আংকারা কোনো এক অজানা কারণে তাদের প্যাট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কিনতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে তুরস্ক বলছে তারা আমেরিকার কাছে এই ডিফেন্স সিস্টেমের প্রযুক্তিটি শেয়ার করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আমেরিকা বাড়তি কোনো তথ্য জানাতে রাজি না হওয়ায় তুরস্কও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
তুরস্কের সাথে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় ন্যাটোর আরো বেশ কিছু সদস্যরাষ্ট্রের মধ্য সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এই দেশগুলো তুরস্কের সাথে অসহযোগিতা করতে শুরু করেছে। তুরস্ক বর্তমানে দেশীয় প্রযুক্তিতে যেসব বিমান ও ট্যাংক নির্মাণ করতে চাইছে, ন্যাটো দেশগুলো তার জন্য প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন সরবরাহ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তুরস্কের সমরাস্ত্র ক্রয় বিষয়ক এজেন্সি জানিয়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পখাতের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়ার জন্য নানা ধরনের অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তবে তুরস্ক এসব কার্যক্রমে মোটেও চিন্তিত নয়। তুরস্ক তার প্রতিরক্ষা শিল্পখাতকে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পুর্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে।
তুরস্কের মতো পাকিস্তানও নিজেদের মতো করে সমরাস্ত্র ও অন্যন্য কার্যকম চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে তারা যেমন তুরস্কের সাথে মিলে সমরাস্ত্র উন্নয়নের কাজ করছে আবার চীনের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতেও নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে দেশটিকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
পাকিস্তান ও চীন মিলে যে বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেখানেও শ্রীলঙ্কাকে যোগ দেয়ার আহবান জানিয়েছেন ইমরান খান। পাকিস্তানের এ দৃষ্টিভঙ্গিতে চরম অসন্তোষ ও উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। ভারত বুঝতে পারছে, বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ দিয়ে শুধু পাকিস্তান নয় বরং গোটা অঞ্চলেই চীনের আধিপত্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভারত এ বিষয়ে এখনো সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও তারা জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার সাথে পাকিস্তানের এই ক্রমবর্ধমান এই সম্পর্কের ওপর কড়া নজর রাখছে।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন কলম্বো যদি বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মধ্য দিয়ে গোয়াদারকে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে তা ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থকে বিঘ্নিত করতে পারে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সমুদ্র বন্দরে যত পণ্য ওঠানামা করে তার ৭০ শতাংশই আসে ভারত হয়ে। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা চীনের একটি সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজকে নিজেদের বন্দরে নোঙ্গর করার অনুমতি দেয়ার পর ভারত প্রচন্ড আপত্তি জানিয়েছিল।
কুটনীতিক ও মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিব ভাটিয়া মনে করেন, ইমরান খানের শ্রীলঙ্কা সফরের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বার্তা হলো, দক্ষিন এশিয়ার যে অঞ্চলে এতদিন ভারতের একচেটিয়া প্রভাব ও আধিপত্য ছিল, পাকিস্তান সেখানে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে। যদি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান নিজেদের নৌ কার্যক্রমকে চীনের উৎসাহে আরো বেশি বৃদ্ধি করে এবং দুটি দেশ ঘনিষ্ট সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তাহলে ভারতের জন্য তা ভীষণই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমানে ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার বানিজ্যের পরিমান ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বেইজিং কলম্বোর নানা অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
কলম্বোর সাথে বেইজিংয়ের বহু পুরনো সামরিক সম্পর্কও রয়ে গেছে। ভারতের সাথেও শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক বানিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। করোনা মহামারির সময়েও দুদেশ একসাথে কাজ করেছে। এমন সময়ে ইমরান খানের এ সফর ভারতের অনেক হিসেবই যেন পালটে দিচ্ছে।
চীন যেভাবে নানা বিষয়ে কলম্বোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে তা নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। বর্তমানে চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দর পরিচালনা করছে। বিপুল অংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা এই বন্দরটি পরিচালনার ভার চীনের কাছে ছেড়ে দেয়। এর কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড়ো সমুদ্র বন্দর কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার টার্মিনালের একটি শাখার দায়িত্বও চীনের কাছে হস্তান্তর করেছিল শ্রীলঙ্কা।
এসব বিষয়ে ভারতের তীব্র আপত্তি আসায় কলম্বো টার্মিনালের একটি অংশের দায়িত্ব ভারত ও জাপানের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সম্প্রতি দেশটির মন্ত্রীসভা সে সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে। শ্রীলঙ্কা এ টার্মিনালটি ভারতের হাতে না দিয়ে বরং নিজেদের ব্যবস্থাপনাতেই চালাতে চায়। এমন সিদ্ধান্তকে ভারতের পক্ষ থেকে দুর্ভ্যাগজনক হিসাবে উল্লেখ করে আগের সিদ্ধান্ত পুর্নবহালের অনুরোধ করে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা তাতে সাড়া দেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সব মিলিয়ে উপমহাদেশে ভারতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রন ও আধিপত্যের হিসেবে অনেকটাই পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীও এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।