মালদ্বীপে ভারতের ঘাঁটি, কী করবে চীন?


  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ মার্চ ২০২১, ১৬:০৯

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি মালদ্বীপ সফর করেছেন। এই সফরে তিনি মালদ্বীপের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে একটি চুক্তি করেন। এ চুক্তি অনুযায়ী মালদ্বীপের একটি দ্বীপে কোস্টগার্ড হারবার, ডকইয়ার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ করবে ভারত। এছাড়া মালদ্বীপের সাথে ৫০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন জয়শঙ্কর। এ চুক্তিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে নয়াদিল্লির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ কোস্টগার্ড বন্দরটি ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদে পরিণত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মালদ্বীপের বিরোধী রাজনৈতিক মহলে এ চুক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তারে চীনের সাথে ভারতের প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রায় যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মালদ্বীপের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছে, যে দ্বীপটিতে ভারতের বন্দর, ডকইয়ার্ড ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, ওই দ্বীপটি ভবিষ্যতে ভারতের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হবে। ভবিষ্যতে ভারতীয় আর্মি সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থানের সুযোগ পাবে। বিরোধীদের অভিযোগ, এ চুক্তির মাধ্যমে ইব্রাহিম সালেহ সরকার মালদ্বীপকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।

মালদ্বীপের রাজধানী মালের খুব কাছে অবস্থিত উথুরু থিলা ফালহু দ্বীপে ভারত কোস্টগার্ড হারবার ও ডকইয়ার্ড নির্মাণের চুক্তি করেছে। ইতোমধ্যে ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদী ও ইব্রাহীম সালেহ সেখানে উদ্বোধন করেছেন কোস্টাল সার্ভিলেন্স রাডার সিস্টেম।

উথুরু দ্বীপে প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে ভারতের ডেকান হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের জন্য কোস্ট গার্ড হারবারটি নির্মাণ করা হলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি ভারতের জন্য একটি মূল্যবান কৌশগত সম্পদে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে চীন কোনঠাসা হয়ে গেল। বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপে প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইব্রাহিম সালেহ ক্ষমতায় আসার পর সেটা নস্যাত হয়ে গেছে। মালের কাছে অবস্থিত উথুরু থিলা ফালহু দ্বীপ কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে মালের প্রধান বন্দরে আসা যাওয়া সমস্ত নৌযান পর্যবক্ষেন করা যায়।

২১ ফেব্রুয়ারি জয়শঙ্কর এক টুইট বার্তায় বলেন, মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মারিয়া দিদির সাথে উথুরু বন্দর প্রকল্প চুক্তি সাক্ষর করতে পেরে তিনি আনন্দিত। এ টুইট বার্তায় জয়শঙ্কর মালদ্বীপকে ভারতের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

চুক্তির পর মালদ্বীপের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিরোধী রাজনীতিবিদরা অভিযোগ করে আসছেন, দ্বীপটি ভবিষ্যতে ভারতের সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হবে। মালদ্বীপের সেনা প্রধানের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ নাকচ করা হলেও চুক্তিটি এখনও প্রকাশ করা হয়নি। বিরোধী সংসদ সদস্যরা উথুরু প্রকল্প চুক্তি এবং ঋন চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।

ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে এই চুক্তির পর যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয় ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদ হাসানের সময় মালদ্বীপের পক্ষ থেকে উথুরু দ্বীপের প্রকল্পে ভারতের সহায়তা চাওয়া হয় । মালদ্বীপ ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী শক্তিশালী এবং দক্ষতা বৃদ্ধি, সমুদ্র সীমায় মালদ্বীপের অধিকার চর্চা এবং মেরিটাইম সার্ভিল্যান্সের জন্য ভারতীয় সহযোগিত চায়। একই ধরনের অনুরোধ ভারতের কাছে করা হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৬ সালের মার্চে। এ প্রেক্ষিতে ভারত-মালদ্বীপ চুক্তি সাক্ষরিত হলো।

এ চুক্তি সাক্ষরের পরপরই মালদ্বীপে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। বিরোধী সংসদ সদস্য আহমেদ শিয়াম দাবি করেন উথুরু দ্বীপের এ ঘাঁটির আসল উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় আর্মির সেখানে অবস্থান নেয়া। মালদ্বীপের সান পত্রিকাকে তিনি বলেন, জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য কৌশলে ভারতীয় আর্মির পরিবর্তে টেকনিশিয়ান এবং অফিসিয়াল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে এর আড়ালে সেখানে ভারতীয় সৈন্য থাকবে।

মালদ্বীপের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী উমর নাসির অভিযোগ করেন এ চুক্তির মাধ্যমে উথুরু দ্বীবে ভবিষ্যতে অবস্থান করবে ভারতীয় আর্মি। আর এ চুক্তির মাধ্যমে সেখানে ভারতীয় আর্মির রণতরীর অবস্থানের পথ তৈরি হলো।

আট বছর আগে মালদ্বীপের উথুরু থিলা ফালহু নৌ বন্দরে ভারতের এ অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মালদ্বীপে চীনপন্থী সরকার নির্বাচিত হওয়ায় এ প্রকল্পে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এরপর ২০১৮ সালে আবার সেখানে ভারতপন্থী সরকার নির্বাচিত হওয়ায় নতুন করে গতি লাভ করে উথুরু বন্দর প্রকল্প।

উথুরু দ্বীপে ভারতের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণের খবর প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। মালদ্বীপের গণমাধ্যমের খবরে তখন বলা হয় উথুরু দ্বীপের প্রকল্পে আওতায় রয়েছে ডকইয়ার্ড, স্লিপওয়ে, গুদাম এবং বাঙ্কার নির্মাণ।

২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্দুল্লাহ ইয়ামিন। তার সময়ে মালদ্বীপের পলিসি ছিল ইন্ডিয়া ফার্স্ট। এ নীতি সত্ত্বেও আব্দুল্লাহ ইয়ামিন বেইজিংয়ের সাথে ঘণিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন । এ সময় চীনের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পে মালদ্বীপ অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়। ভারতীয় শিবিরে এসময় হতাশা নেমে আসে ।

আব্দুল্লাহ ইয়েমিন ২০১৫ সালে গ্রেফতার করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ এবং তার নিজের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাজিমকে। এরপর সাবেক একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, সাবেক আরেকজন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকেও জেলে ঢোকান আব্দুল্লাহ ইয়ামিন। আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে মালদ্বীপের আভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায় কমনওয়েলথ। পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ মালদ্বীপের জন্য করনীয় একটি দীর্ঘ তালিকা হাজির করে। মালদ্বীপকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেয়া হয়। যে কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপের প্রভাবশালী সদস্য ভারত। কমনওয়েলথ অ্যাকশন গ্রুপের সিদ্ধান্তগ্রহনকারী বৈঠকের আগে আব্দুল্লাহ ইয়ামিন নয়া দিল্লি সফরে যান। উদ্দেশ্য ছিলো তার বিরুদ্ধে কমনওয়েলথ যেন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়।

এ সুযোগ গ্রহণ করে ভারত। আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের এ সফরে মালদ্বীপের সাথে ভারত সাক্ষর করে প্রতিরক্ষা চুক্তি। কোস্টাল সার্ভিলেন্স রাডার থেকে হাইড্রো গ্রাফিক সার্ভে এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডিংসহ অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এ চুক্তিতে । এজন্য গ্রহণ করা হয় অ্যাকশন প্লান অন ডিফেন্স কোঅপারেশন।

অবকাঠামো উন্নয়ন ক্যাটাগরির আওতায় ২০১৬ সালের অ্যাকশন প্লানে বলা হয় ডকইয়ার্ডসহ অন্যান্য বিষয়ে উথুরু দ্বীপ উন্নয়নে মালদ্বীপের অংশীদার ভারত। ভারতীয় নেভি অথবা কোস্টগার্ড প্রশিক্ষনের জন্য এখানকার অবকাঠামো ব্যবহার এবং বিশেষ অর্থনৈতিক জোন পর্যবেক্ষনের সুযোগ পাবে।

২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের পাশে দাড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্দ্রী নরেন্দ্র মোদী উথুরু দ্বীপের কোষ্টগার্ড প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে এর প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, উথুরু দ্বীপে ভারত এবং মালদ্বীপ যৌথভাবে বন্দর সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়ন করবে।

ভারতের সাথে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা চুক্তির অ্যাকশন প্লানের মধ্যে দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠকও অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এরপরও ভারতীয় কর্মকর্তারা উপলব্ধি করে মালদ্বীপ ইচ্ছাকৃতভাবে উথুরু দ্বীপ প্রকল্পে ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করছে। যার উদ্দেশ্য হলো সেখানে ভারতীয় প্রভাব খর্ব করা। ভারত মনে করে চীনের প্রভাবে ইয়ামিন সরকার এমন নীতি গ্রহন করছে। এই প্রতিরক্ষা চুক্তির মধ্যে আরেকটি শর্ত ছিলো উথুরু দ্বীপে রাডার সিস্টেম স্থাপন করা। কিন্তু ইয়ামিন সরকার ভারতকে রাডার সিস্টেম স্থাপনের অনুমতি দেয়নি।

ভারতের সাথে মালদ্বীপের এ শীতল সম্পর্ক কেটে যায় ২০১৮ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পর। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজয় ঘটে চীন ঘেষা আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের। জয়ী হন ভারতপন্থী হিসাবে পরিচিত ইব্রাহিম সালেহ। ইব্রাহিম সালেহর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইব্রাহিম সালেহ দায়িত্ব গ্রহনের পর মালদ্বীপে এমন আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে, উথুরু দ্বীপ প্রকল্পের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত এটি ভারতের একটি নৌ ঘাঁটিতে পরিণত হবে। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হলে এ সেনা প্রধান মেজর জেনারেল আব্দুল্লাহ শামাল ঘোষণা করেন, মালদ্বীপে কোনো বিদেশি ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।

ইব্রাহিম সালেহ ক্ষমতায় আসার পর উথুরু দ্বীপে আবার কর্মতৎপরতা শুরু হয়। বড় ধরনের অবকাঠামোসহ নতুন অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে । অ্যাকশন প্লানের আওতায় মালদ্বীপকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ডরনিয়ার বিমান দেয় ভারত। যার উদ্দেশ্য হলো বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে পর্যবেক্ষন কার্যক্রম চালানো।

বিরোধী জোট প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপ এবং পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস অভিযোগ করছে ইব্রাহীম সালেহ সরকার মালদ্বীপকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তারা শুরু করেছে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় পর্যবেক্ষন বিমান মালদ্বীপে আসার পর সংসদে বিরোধী এমপিরা প্রতিবাদ আন্দোলন জোরদার করেন। তাদের অভিযোগ ভারতের সৈন্য অবস্থান করছে মালদ্বীপে। আর এটি মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।

মালদ্বীপ সেনাপ্রধান জানান, ভারতের টেকনিশিয়ান এবং টেকনিক্যাল লোকজন মানবিক সহায়তা দিচ্ছে মাত্র। সেনা প্রধানের বরাতে মালদ্বীপের স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয় ভারত থেকে পাওয়া হেলিকপ্টার বিদেশী সৈন্যরা পরিচালনা করছে। কারন স্থানীয় উপযুক্ত পাইলটের অভাব রয়েছে। এসব হেলিকপ্টার রক্ষনাবেক্ষন এবং রিফুয়েলিং বিষয় দেখাশুনা করছে। আরো জানানো হয় ভবিষ্যতের জন্য মালদ্বীপের পাইলটরাও প্রশিক্ষন নিচ্ছে।

মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স এর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন উথুরু প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সেখানে কোনো বিদেশী সৈন্য থাকবে না। আগামী তিন বছরের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ডকইয়ার্ডে টেকনিক্যাল এবং লজিস্টিক সাপোর্টের জন্য ভারতীয় কর্মকর্তরা ১৫ বছর পর্যন্ত সহায়তা করবে। কিন্তু সালেহ সরকারের সেনা কর্মকর্তাদের এসব বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছে না দেশটির সাধারন মানুষ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সোচ্চার হয়ে উঠছে।