মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক দিক দিয়ে রহস্যময় এক দেশ ইরান। দেশটি এরই মধ্যে কামান-টোয়েন্টি টু নামের ড্রোন উদ্বোধন করেছে, যা আমেরিকার তৈরি এমকিউ-ওয়ান প্রিডেটরের আলোকেই তৈরি করা হয়েছে। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর ড্রোন এমকিউ-নাইনের দিকে ঝুঁকছে দেশটি। তবে মার্কিনিদের সহায়তায় নয়, বরং নিজস্ব অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও কাঠামো দিয়েই এ ড্রোনটি নির্মাণের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে দেশটি। ধারণা করা হচ্ছে, কামান-টোয়েন্টি টু নামের আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল বা ইউএভি ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা খাতকে অনেকটাই শক্তিশালী করবে।
এখন থেকে ৪ বছর আগে ইরানের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত ইউএভি ধরা পড়ে। ইরানিয়ান সেনাবাহিনী অবশ্য ড্রোনটি পাওয়ার পর দাবি করেছিল যে, এটি একটি এমকিউ-ওয়ানসি প্রজাতির গ্রে-ইগল ইউএভি। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, ইরানীদের হাতে জব্দ হওয়া ড্রোনটি গ্রে ইগল নয় বরং অন্য কিছু। অবশ্য ড্রোনটি পাওয়ার পরপরই তার অনুকরণে ইরান নিজেদের মতো করে ড্রোন নির্মাণ শুরু করে এবং ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নতুন ধরনের ড্রোনও ইরান তৈরি করেছে।
বর্তমানে ইরানের হাতে অবশ্য কামার-টুয়েলভ নামক ড্রোন রয়েছে। কামান-টোয়েন্টি টু এরই উন্নত সংস্করণ বলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে।
কামান-টোয়েন্টি টু ড্রোনটি এর পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিডেটর এমকিউ-ওয়ান এবং রিপার এমকিউ-নাইনের সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রিডেটর আর রিপার এমকিউ-নাইন- এ দুটো ড্রোনই নির্মাণ করেছে আমেরিকান এনার্জি এন্ড ডিফেন্স কর্পোরেশন, জেনারেল এটোমিক্স জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এমকিউ ওয়ান প্রিডেটর হলো দূর থেকে পরিচালিত একটি বিমান যা মার্কিন বিমান বাহিনী এবং দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নিয়মিতই ব্যবহার করে থাকে। মূলত আকাশপথে অস্ত্র সরবরাহ, নজরদারি করার জন্য এ ড্রোনটি নির্র্মিত হয়েছিল। বর্তমানে অবশ্য ড্রোনটি ক্যামেরা এবং সেন্সর বহন করার মধ্য দিয়ে নিয়মিতভাবে নানা মিশনে অংশ নিচ্ছে।
এমকিউ ওয়ানের উন্নত সংস্করণ হলো এমকিউ গ্রে ইগল ড্রোন। এগুলো মধ্য উচ্চতায় দীর্ঘ সময় বাতাসে ভাসতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীতে যত ধরনের ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে এর মধ্যে এমকিউ গ্রে ইগল ড্রোনকে অন্যতম কার্যকর ড্রোন হিসেবে গন্য করা হয়। এই ড্রোনগুলো গোয়েন্দাবৃত্তি, নজরদারি, অস্ত্র ও বোমা সরবরাহ, ছোটখাটো মিসাইল ও অন্যান্য বোমা বহনের কাজ করা হয়।
এছাড়া এ ড্রোনগুলো শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমন চালাতেও বেশ সহায়ক। এমকিউ গ্রে ইগল ড্রোনগুলো লম্বায় ২৮ ফুট। এটি নির্মাণ করেছে জেনারেল এটোমিক্স এ্যারোনটিকাল সিস্টেম বা জিএএএসআই। এ ড্রোনগুলো সর্বোচ্চ ২৫ ঘন্টা ভাসতে পারে এবং সর্বোচ্চ ১৬৭ কেটিএএস গতিতেও চলমান থাকে। এই ড্রোনগুলো ২৯ হাজার ফিট দিয়ে উড়তে পারে এবং উড়ন্ত অবস্থায় ৪৮৮ কিলোগ্রাম ওজনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পে-লোড বহন করতে পারে।
ইরানের কামান-টোয়েন্টি টু ড্রোনটির কাজ কতটুকু অগ্রসর হয়েছে সেই বিষয়ে খুব বেশি তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে ইরানের প্রতিরক্ষা বিষয়ক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন , এ ড্রোনটি একদিনেরও বেশি সময় ভাসতে পারবে এবং উড়ন্ত অবস্থায় ১ হাজার ৮শ ৬০ মাইলের বেশি পথ অতিক্রম করতে পারবে। কামান টোয়েন্টি টু ড্রোনগুলো সব ধরনের পেলোড নিয়ে লম্বা দূরত্বে যেতে পারবে। এ ড্রোনগুলো টার্গেট সনাক্ত, নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ এবং দূর থেকে সম্ভাব্য টার্গেটের ছবিও তুলতে সক্ষম।
মার্কিন বিমান বাহিনী অবশ্য বলছে যে, তাদের প্রিডেটরগুলো সর্বোচ্চ ৭৭০ মাইল পথ পেরুতে পারে। একারণেই তারা আরো এডভান্সড প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন রিপার ড্রোনের ক্ষেত্রে। ফলে রিপার ড্রোনগুলো ১১৫০ মাইল পথও যেতে পারে। দীর্ঘ উচ্চতায় লম্বা পথ উড়তে সক্ষম হওয়ায় এম-কিউ নাইন রিপার ড্রোনগুলোকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও অগ্রসর ড্রোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রিপার ড্রোনগুলোকে দূর থেকে রিমোটের মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়। একইসঙ্গে এ ড্রোনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেও মিশন চালাতে পারে।
অন্যদিকে, ইরানের কামান টোয়েন্ট টু ড্রোনগুলো ৩শ কেজি ওজনের বোমা ও গোলাবারুদ বহন করতে পারবে। ইরান এরই মধ্যে এই ড্রোনগুলোকে দিয়ে তাদের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষন দিতে শুরু করেছে। যাতে নিকট ভবিষ্যতের যেকোনো সমর অভিযানেই তারা ড্রোনগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। কামান টোয়েন্টি টু ড্রোনগুলোতে একটি পুশার ধরনের প্রোপেলার পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
ইরানের এ ড্রোনে কোন ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। মার্কিনীদের তৈরি প্রিডেটর ড্রোনগুলো অবশ্য চারটি সিলিন্ডার সম্পন্ন পিস্টন ইঞ্জিন দিয়ে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, রিপার ড্রোনগুলোতে টার্বোপ্রোপ ব্যবহার করা হয়। সেদিক থেকে ইরানের ড্রোনগুলোতে অবশ্য সোজা আকৃতির ডানা ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া এ ড্রোনগুলোতে উইপন হার্ডপয়েন্ট এবং ছোট আকৃতির ডানা, ভি-আকৃতির লেজ এবং অঙ্কীয় পাখনাও ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানের ড্রোন সক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা চলছে। আগে থেকেই ধারনা করা হয়েছিলো ইরানের ঘনিষ্ট মিত্র চীনের সহায়তায় দেশটি ড্রোনের ভালো সক্ষমতা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ইরানের হাতে ধরা পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সে সময় আশঙ্কা করেছিলো এই ড্রোনটির প্রযুক্তিগত ধারনা শেষ পর্যন্ত চীনের কাছে যেতে পারে। এমনকি রাশিয়ার সাথেও ইরানের রয়েছে কৌশলগত সর্ম্পক। এখন দেখা যাচ্ছে ইরান নিজেরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি থেকে ড্রোন নির্মানের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যদিও ইরান বেশ আগে ড্রোন নির্মান করেছে।
ইয়েমেনে হুথি যোদ্ধাদের কাছে ইরানের ড্রোন রয়েছে বলে ধারনা করা হয়। সৌদি আরবের তেল ক্ষেত্রে হুথি বিদ্রোহীরা যে ড্রোন হামলা চালিয়েছিলো সেগুলো ইরানের তৈরি বলে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিলো। এখন রিপার ড্রোনের মতো শক্তিশালী ড্রোন যদি ইরান নির্মান করতে সক্ষম হয় তা শুধু আরব দেশগুলোর জন্য ইসরাইলের জন্য উদ্বেগের কারন হয়ে দেখা দিতে পারে।
অবশ্য অনেক বিশ্লেষক বলছেন ইরানের ড্রোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর তা এখনও প্রমাণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোনগুলো আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সক্ষমতা দেখিয়েছে। চীনে নির্মিত ড্রোন লিবিয়া যুদ্ধে আরব আমিরাত ব্যবহার করেছে। এমনকি তুরস্কের বেয়ারকতার ড্রোন আর্মেনিয়া- আজারবাইজান যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ইরানের ড্রোনের সক্ষমতা ভবিষ্যতে যে কোনো যুদ্ধে স্পষ্ট হবে।