আকাশ যুদ্ধসহ আগামী দিনে যে কোনো যুদ্ধে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ড্রোন। যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন মাত্রা আনতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। বদলে যাচ্ছে প্রচলিত যুদ্ধব্যবস্থা। সর্বশেষ কয়েকটি যুদ্ধে ড্রোনের অতি উচ্চমাত্রার সফলতার কারণে সব দেশই তাদের সমরনীতি ও সমর কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছে। নৌ, বিমান আর স্থলবাহিনীর সাথে সমন্বিত বা অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। ড্রোন প্রযুক্তির কারণে প্রচলিত অনেক শক্তিশালী সমরাস্ত্র, বিপুল বিনিয়োগ আর প্রশিক্ষণ অকেজো হয়ে যেতে পারে শীঘ্রই। পাল্টে যেতে পারে আগামী দিনের যুদ্ধের সব হিসাব-নিকাশ।
প্রচিলত অস্ত্র নিয়ে একটি দেশ যতই শক্তিশালী হোক না কেন যুদ্ধে প্রতিপক্ষের ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য। এরইমধ্যে তার নজির দেখা দেখা গেছে। শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার পরও ঠেকাতে পারছে না ড্রোন হামলা। ড্রোন প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির কারণে সামরিক দিক দিয়ে পেছনে থাকা অনেক দেশ উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। শক্তিশালী ও কম শক্তিশালী দেশের মধ্যে দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনতে যাচ্ছে ড্রোন। আগামীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ড্রোন প্রযুক্তি সৃষ্টি করবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে সব দেশেরই প্রথম পছন্দ ড্রোন। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের বাইরে বিভিন্ন শক্তি তথা নন স্টেট গ্রুপ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে সামরিক ও বানিজ্যিক ড্রোন। রাষ্ট্র ও নন স্টেট গ্রুপের সামরিক ড্রোনের ব্যাপকমাত্রায় ব্যবহার এবং এর সহজলভ্যতা অনেক শক্তিশালী দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তাতে অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ড্রোন। ড্রোনের সহজলভ্যতা এবং এর ব্যাপক ব্যবহার নতুন মাত্রা যোগ করেছে বর্তমান যুদ্ধ ব্যবস্থায়।
গত ২০ বছর ধরে টার্গেট কিলিং বা হত্যা মিশনে ব্যবহার করা হচ্ছে সামরিক ড্রোন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা বিরোধী অভিযানে ড্রোন হামলা পরিচালনা করে আসছে। সম্প্রতি কয়েকটি বড় যুদ্ধে ব্যাপকমাত্রায় ড্রোন ব্যবহার করে নজির সৃষ্টি করেছে তুরস্ক। সিরিয়া, লিবিয়া এবং সর্বশেষ আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহারে তুরস্কের সাফল্য সারা বিশ্বে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে প্রচলিত যুদ্ধ ব্যবস্থা বদলে গেছে। কিভাবে আধুনিক যুদ্ধ ব্যবস্থায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ড্রোন।
বিশ্বের সব দেশের সমর পরিকল্পনায় এখন অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে ড্রোন। প্রচলিত ব্যয়বহুল সমরাস্ত্রের পাশপাশি ড্রোন প্রযুক্তির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রচলিত ব্যয়বহুল সমরাস্ত্রের বিপরীতে সস্তা দামের ড্রোন অনেক বেশি কার্যকর। পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে ড্রোন প্রযুক্তি ছাড়া বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধে সাফল্য লাভ অসম্ভব বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে শক্তিশালী দেশের জন্যও। কারণ প্রতিপক্ষের ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য।
অনেক দেশের কাছে উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ প্রতিরক্ষা থাকলেও ড্রোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা অকার্যকর। কারণ এসব শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম অতি উচুতে এবং বড় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। নিচ দিয়ে ওড়া ড্রোনের মত ছোট লক্ষ্যবস্তুর আক্রমণ ঠেকাতে পারে না শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম। আবার অনেক সময় অনেক ড্রোন ধরা পড়ে না প্রতিপক্ষের রাডার ব্যবস্থায়। আবার অনেক ড্রোন তৈরি করা হয় নন মেটাল বিভিন্ন বস্তু দিয়ে।
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবে তেল ক্ষেত্রে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল সিস্টেম । সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান ঘাটিতে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থাকা পরও ড্রোন হামলা ঠেকানো যায়নি। ফলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এখন সব দেশের চিন্তার কারণ ড্রোন হামলা প্রতিহত করা বা এন্টি ড্রোন সিস্টেম উদ্ভাবন।
এন্টি ড্রোন সিস্টেম উদ্ভাবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে যৌথভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল ইতোমধ্যে নতুন একটি এন্টি ড্রোন সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে। এর নাম ড্রোন ডোম। নতুন এ সিস্টেম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ড্রোনকে অকেজো করে দিতে পারে অথবা লেজারের মাধ্যমে তা ধ্বংস করে দিতে পারে। নতুন এ কাউন্টার ড্রোন ছোট ট্রাক, ল্যানড রোভার বা অন্য যানবাহনে বসানো যায়। এ ড্রোনের আওতা তিন কিলোমিটারের বেশি।
কম শক্তিশালী দেশসহ নন স্টেট গ্রুপের মিলিটারি ড্রোনকে বড় ধরনের হুমকি হিসাবে দেখছে শক্তিশালী দেশগুলো। ফলে তাদের জন্য কাউন্টার ড্রোন সিস্টেম উদ্ভাবন ছাড়া বিকল্প নেই।
ড্রোনকে এখন আর কোনো দেশ শুধুমাত্র পরিদর্শন, গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং নির্দিষ্ট হত্যা মিশন পরিচালনায় সীমাবদ্ধ রাখতে পারছে না। বরং আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক এবং ইনফ্যান্ট্রির সাথে সমন্বিত অংশে পরিণত করা হচ্ছে ড্রোন। ড্রোনের উচ্চ মাত্রার কার্যকারিতা আর অতি কম খরচের কারণে কারো পক্ষে একে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রচলিত যুদ্ধ বিমানের পরিবর্তে সামরিক ড্রোনের সুবিধা হলো এর নির্মান খরচ কম অথচ প্রচলিত শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানেরই কাছাকাছি সুবিধা পাওয়া যায়। তা ছাড়া ড্রোন বিমান শত্রুর আঘাতে বিধ্বস্ত বা ধ্বংস হলে পাইলটের মৃত্যুর প্রশ্ন নেই। আর রক্ষা পাবে অতি ব্যয়বহুল যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের হাত থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বর্তমানে চীন, ইসরাইল এবং তুরস্ক শক্তিশালী সামরিক ড্রোন উৎপাদন করছে। এসব দেশ বিভিন্ন দেশের কাছে ব্যাপকমাত্রায় সামরিক ড্রোন আর ড্রোন প্রযুক্তি রপ্তানি করছে। ২০১৯ সালে সাড়ে দশ বিলিয়ন ডলারের ড্রোন বিক্রি করে বিভিন্ন দেশ। ২০২৭ সালে এটি ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের কাছে প্রায় ৩০ হাজার সামরিক ড্রোন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০১৯ সালে ২০ লাখ ড্রোন তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্ব বাজারে সবচেয়ে বেশি ড্রোন রয়েছে চীনের ডিজেআইয়ের।
ড্রোন প্রযুক্তির ব্যাপক মাত্রার সাফল্যের কারণে অনেকের আশঙ্কা বর্তমানে যেসব দেশ প্রচলিত সমরাস্ত্রে খুবই শক্তিশালী তা অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। সামরিক শক্তির মানদন্ড বিবেচনায় এসব প্রচলিত অস্ত্রের সাথে ড্রোন আর ড্রোন প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ফলে ড্রোনে উন্নতির কারণে সামরিক দিক দিয়ে বর্তমানে অনেক পেছনের দেশও সামনের দিকে চলে আসতে পারে। এভাবে ড্রোন প্রযুক্তি শীঘ্রই সমতা সৃষ্টির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। তৈরি করতে যাচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
অপরদিকে নন স্টেট বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংস্থা হুমকি হয়ে উঠছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য। ইরাক সিরিয়া আর ইয়েমেনে বিভিন্ন গ্রুপের ড্রোন ও রকেট হামলায় অনেক বড় দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ইয়েমেনে সর্বশেষ হুতি গ্রুপ ড্রোন ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে। হুতিদের মত নন স্টেট গ্রুপের বিপরীতে সৌদি আরব অনেক শক্তিশালী দেশ। কিন্তু হুতিরা ড্রোনের মাধ্যমে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম।
নন স্টেট গ্রুপের ড্রোন হামলার হুমকির কারণে সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধের লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছে। ইয়েমেনে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালানোর বিষয়ে শঙ্কিত সৌদি আরব। কারণ সৌদি আরব জানে এটি সে করলে তার ওপরও পাল্টা হামলা আসবে যা সে ঠেকাতে পারবে না।
প্রচলিত অস্ত্র আর প্রচলিত সমর কৌশলের ক্ষেত্রে যেখানে বিপুল বিনিয়োগ আর কঠিন প্রশিক্ষন দরকার সেখানে সস্তা, সহজ আর উচ্চ মাত্রায় কার্যকর ড্রোন প্রযুক্তি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
এখন থেকে ১৫ বছর আগে বিভিন্ন দেশ ও জনবহুল এলাকার জন্য বড় ধরনের হুমকি ছিল ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস। এ ডিভাইস অনেক দূর থেকে শুধু একটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও বিস্ফোরণ ঘটানো যেত। আর এখন ড্রোন প্রযুক্তির কারণে এ ডিভাইস যে কোনো স্থানে উড়িয়ে নেওয়া যায় এবং নিক্ষেপ করা যায়। আর ক্ষুদ্র এ ড্রোন অনেক সময় সনাক্ত করা ও আকাশে ধ্বংস করা কঠিন বিষয়।
ড্রোনের সামরিক, বেসামরিক, বানিজ্যিক ও বিনোদনমূলক ব্যবহারসহ নানা উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে । অনেক দেশই তাদের নিরাপত্তার জন্য সামরিক ও বানিজ্যিক ড্রোনকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। কারণ বাণিজ্যিক ড্রোনকে সহজে মোডিফাই করা যায় এবং বিস্ফোরক যুক্ত করা যায়।
অতি কমদামী এসব ড্রোন এর সাহায্যে সামরিক বেসামরিক স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা পরিচালনা করা যায়।
সামরিক ক্ষেত্রসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ড্রোন। মাত্র একশ ডলারেও কম দামের এ ড্রোন নিয়ে চিন্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সুপার পাওয়ার। চিন্তিত ইসরাইল রাশিয়াসহ অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন প্রচলিত অস্ত্র ব্যবস্থায় অগাধ বিনিয়োগ বন্ধ করে ড্রোন আর হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম এর প্রতি গুরুত্ব আরোপের জন্য।