ছোট ড্রোন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিপাকে মার্কিন বাহিনী


  • আহমাদ আব্দুুল্লাহ
  • ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৩৩

বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন থাকা মার্কিন সেনারা সবচেয়ে বড় যে হুমকি মোকাবিলা করছে, তাহলো ছোট ছোট সামরিক ড্রোন। এ ড্রোনগুলোর শত্রুপক্ষের চোখের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কিনিথ ম্যাকেনজি জুনিয়র এমনটাই মনে করছেন। তিনি বলেন, সস্তা দামের ছোট ড্রোনগুলোর ব্যবহার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত সেনাসদস্যদের জন্য বড় উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণে পরিণত হয়েছে।

সেন্ট্রাল কমান্ড হলো মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের ১১টি সমন্বিত ও চৌকস যুদ্ধরত কমান্ড বাহিনীর মধ্যে একটি। এই কমান্ডের প্রধান জেনারেল ম্যাকেনজি মনে করেন, ইরাকে বিগত বছরগুলোতে যেসব নতুন ধরনের অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ভাবিত হয়েছে তার মধ্যে ছোট ও সস্তা ড্রোনগুলোই মার্কিন বাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নতুন এ ড্রোনগুলোকে প্রতিপক্ষের সবচেয়ে উদ্বেগজনক কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে গন্য করছেন জেনারেল ম্যাকেনজি। মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী ও আরো যেসব মিলিশিয়া বাহিনী নানা এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে তারা সকলেই মার্কিন সেনাদেরকে কাবু করার জন্য এ ধরনের ড্রোনকে ব্যবহার করছে।

জেনারেল ম্যাকেনজি মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন ফোর স্টার জেনারেল। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রথাগত ড্রোন ঠেকানোর মতো নানা প্রযুক্তি ও সিস্টেম থাকলেও ছোটখাটো ড্রোনকে আটকানোর মতো কোনো প্রযুক্তি এখনো আসেনি। মনুষ্যবিহীন যেসব বিমান বা ড্রোন আছে যেগুলোর স্বাভাবিক আকৃতি ফাইটার জেটের সমান, সেগুলো আমরা দেখতে পাই। সাধারণ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিয়ে তা মোকাবেলাও করা যায়। কিন্তু আমরা এখন সেই ড্রোনগুলোকে নিয়ে বিপদে আছি যেগুলো যে কেউ চাইলেই মাত্র ১ হাজার ডলার দিয়ে কিনে নিতে পারেন।

মাত্র কয়েক বছর আগেও, নির্দিষ্ট কয়েকটি সেক্টর ছাড়া আর কোথাও ড্রোনের সেই অর্থে কোনো ব্যবহারই ছিল না। কিন্তু গেল দু-তিন বছরে এ খাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার কারণে ড্রোন সেক্টরটি অগ্রসর হয়েছে। পাশাপাশি ছোটখাটো এই উড়ন্ত ড্রোনের একটি বড়ো বাজারও গড়ে উঠেছে। বর্তমানে যেসব সেক্টর ড্রোন ব্যবহার করছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ক্রেতা হলো বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী।

প্রতিরক্ষা খাতের নীতি নির্ধারকরা মনে করেন যে, নজরদারি এবং পাহাড়া দেয়ার মতো কাজগুলো আকাশে ভাসমান ড্রোন দিয়েই বেশি ভালোভাবে করা যায়। পাশাপাশি, সৈন্যদের জীবনকে মৃত্যুঝুঁকিতে না ফেলে যে কোনো সামরিক অভিযানের সময় প্রতিপক্ষের টার্গেটে হামলা চালানোর জন্যও ড্রোন খুবই কার্যকরী একটি সমরাস্ত্র।

বিগত কয়েক বছর ধরেই সামরিক ড্রোন প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। যমন মার্কিন বিমান বাহিনীর হান্টার কিলার এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোনের কথা বলা যায়। মার্কিন বিমান বাহিনী এই ড্রোনটি ব্যবহার করেই আফগানিস্তান ও আফ্রিকায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তুরস্ক, ইসরাইল ও যুক্তরাজ্য এ খাতে অনেকটা অগ্রসর হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া প্রভাব কমে আসছে।

বেশ কয়েকটি দেশ সামরিক ড্রোন অর্জন এবং বিদ্যমান ড্রোনগুলোর উন্নত সংস্করণ আবিস্কার করার জন্য বড়ো অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি, বানিজ্যিকভাবেও ড্রোনের ব্যবহার ও উন্নয়ন অনেকটা বেড়েছে। এই ড্রোনগুলো সামরিক ড্রোনের তুলনায় বেশ সস্তা আর এগুলো চালানোও বেশ সহজ। এ কারণে বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং মিলিশিয়া গোষ্টী উভয় পক্ষই ইউএভি বা মনুষ্যবিহীন ড্রোনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ইরাক, সিরিয়া, আজারবাইজান এবং ইউক্রেনের মতো দেশগুলো শুধুমাত্র ড্রোন ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

ড্রোনের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে আছে কল ফর ফায়ার মিশনের জন্য স্কাউটিং করা এবং টার্গেট করা অবস্থানে বোমা নিক্ষেপ করা। জেনারেল ম্যাকেনজি বলছেন, সস্তা দামে এ ড্রোনগুলো এখন সহজলভ্য হওয়ায় আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এখন আক্রমনকারী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তুলনামূলক সুবিধাজনক জায়গায় আছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের এ ড্রোন ভিত্তিক আগ্রাসন দমন করার জন্য মার্কিনীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে একাধিক প্রযুক্তির সংযোজন শুরু করেছে।

বর্তমানে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে যেসব প্রযুক্তি ও কৌশল রয়েছে তার মধ্যে ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম একটি। পাশাপাশি লেজার রশ্মি ব্যবহার এবং মাইক্রোওয়েভ প্রয়োগ করে ড্রোন এবং এর নিয়ন্ত্রক মহলের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেও মার্কিনীরা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। এসব পদ্ধতিতে প্রথাগত ড্রোনকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারলেও ছোট ড্রোনগুলো মোকাবেলা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমীরাতের আবুধাবীতে আইডেক্স টোয়েন্টি টুয়েন্টিওয়ান শুরু হয়েছে। রাশিয়া এ প্রদর্শনীতে তাদের সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০, ভাইংকিং এবং টর-ইটু, আর্মাতা যুদ্ধট্যাংক, এস-ইউ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান, কর্ড, একে-নাইনটিন এ্যাসল্ট রাইফেল, কুপোল প্রো কাউন্টার ড্রোন সিস্টেমসহ নতুন আরো অনেকগুলো সমরাস্ত্র ও সমর প্রযুক্তি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে।

আবুধাবী ন্যাশনাল এক্সিবিশন কোম্পানী আমীরাতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়, আমীরাত আর্মড ফোর্সের জেনারেল কমান্ডের সাথে মিলে যৌথভাবে এ্যাডনেক এই আইডেক্স এবং নাভাল ডিফেন্স এন্ড মেরিটাইম সিকিউরিটি এক্সিবিশন তথা নাভডেক্স এর আয়োজন করছে। অন্যান্য অনেক দেশের সাথে ইসরাইল, পুর্তুগাল, লুক্সেমবার্গ এবং উত্তর মেসিডোনিয়া প্রথমবারের মতো এই প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছে।

এবারের প্রদর্শনীতে রাশিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে দেশটির অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রসটেক স্টেট কর্পোরেশনের মহাপরিচালক সার্গেই চেমেজভ বলেন, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড়ো অস্ত্রের বাজার। সারা বিশ্বে যত অস্ত্র প্রতি বছর বিক্রি হচ্ছে তার এক-তৃতীয়াংশই কিনছে এই দুই অঞ্চলের দেশগুলো।

অস্ত্রের বাজারে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রগুলো খুবই পরিচিত এবং এগুলোর ব্যাপক সুনামও আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রাশিয়ার অস্ত্র বেশ কার্যকর বলেই বিগত বছরগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। নৌপথে, স্থলপথে এবং আকাশপথে রাশিয়ার অস্ত্রগুলোর পারদর্শিতা এখন সর্বমহলে স্বীকৃত।

২০২০ সালের শেষে এসে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো রাশিয়ার মাধ্যমেই তাদের ৫০ শতাংশ সমরাস্ত্রের চাহিদা পূরণ করেছে। এ খাতে রফতানি এবং উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া এসব দেশকে টার্গেটে নিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করছে।

২০২১ সালে এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতেও মনে হচ্ছে, এই অঞ্চলে রাশিয়ার সমরাস্ত্রগুলোর ব্যবসা ভালোই চলছে। রাশিয়ার নীতি নির্ধারকেরাও এই দেশগুলোর চাহিদা ও বানিজ্যকে বিবেচনায় নিয়েই নিজেদের অস্ত্র নির্মান ও বাজারজাতকরণ কৌশল প্রনয়ন করছেন।

রাশিয়া আইডেক্সে নেপথ্যে রসটেক কোম্পানীটিই মূল ভূমিকা রাখছে। আবুধাবী ন্যাশনাল এক্সিবিশন সেন্টারের ১২ নং হলে এ প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আর রাশিয়ার বুথগুলো এই হলের ১২শ স্কয়ার মিটারেরও বেশি জায়গা নিয়েই নিজেদের সমরাস্ত্রগুলোকে উপস্থাপন করছে।

নতুন যেসব সিস্টেম এ প্রদর্শনীতে উম্মুক্ত হবে তার মধ্যে আছে আরমড পার্সোনেল কারিয়ার, ইনফ্যান্ট্রি যুদ্ধযান এবং বেশ কয়েকটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এই প্রথমবার টি-ফোরটিন আর্মাটার নতুন ধরনের অস্ত্রগুলো জনসম্মুখে উপস্থাপন করছে। পাশাপাশি কর্ড এ্যাসল্ট রাইফেল, লিবেদেভ পিস্তল, নতুন ধরনের কালাসনিকভ এ্যাসল্ট রাইফেল একে-নাইনটিন, ড্রোনের কয়েকটি সলুউশন এবং ট্রেনিং সিমুলেটর কমপ্লেক্সও প্রথমবারের সামনে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে।

এবারের প্রদর্শনীতে ৪শটি সামরিক প্রযুক্তি ও যুদ্ধাস্ত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি, এভিয়েশন যন্ত্রপাতি বিশেষ করে এসইউ থার্টি ফাইভ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান, এমআই থার্টি এইটটি ট্রান্সপোর্ট এ্যাটাক হেলিকপ্টার, এস-ফোর হান্ড্রেড ট্রিয়াম্প এবং টর-এমটুকেএম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং কুপল প্রো এন্টি ড্রোন কমপ্লেক্স এবং ওরল্যান টেইন ই ইউএভির মক মডেলও এ প্রদর্শনীতে দেখানো হবে।

রফতানীকারকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নৌ সিস্টেম বিশেষ করে পেট্রোল বোট এবং কারাকুর্ট স্মল মিসাইল শিপের মক-আপ মডেলও প্রদর্শনীতে উম্মুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি, বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক ছোট অস্ত্র বিশেষ করে ৭.৬২ এমএম এবং ৫.৪৫ এমএম চেম্বারের কর্ড এসল্টড রাইফেল, লোবায়েভের লম্বা দুরত্বের স্নাইপার রাইফেল, ডিভিএল টেন এম স্যাবোটিয়ার, টিএসভিএল-এইট স্টেলিনগ্রাড এবং ডি-এক্সএল লং স্ট্রাইক এ প্রদর্শনীতে থাকছে। রাশিয়ার সেনারা এরই মধ্যে এ অস্ত্রগুলোর ব্যবহার শুরু করেছে।