যে কারণে লাদাখ থেকে সৈন্য সরাল চীন ও ভারত


  • মেহেদী হাসান
  • ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:০৪

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চীন ও ভারত লাদাখে ব্যাপক সৈন্য আর অস্ত্র সমাবেশ ঘটাতে থাকে। জুন মাসে লাদাখের গালওয়ান রিভার ভ্যালিতে দুই দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে লাদাখ ঘিরে গত ৯ মাস ধরে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে উভয় দেশের মধ্যে। উভয় দেশ লাদাখ সীমান্তে সৈন্য ও সমরাস্ত্র বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপক অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আকস্মিক এক ঘোষণায় জানানো হয়, লাদাখের প্যানগং লেক থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চীন-ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে উভয় পক্ষ সৈন্য ও অস্ত্র প্রত্যাহার শুরু করে।

লাদাখ থেকে উভয় দেশ সৈন্য সরাতে রাজি হয়েছে মূলত তীব্র শীতের কারণে। বরফ ঢাকা লাদাখে উভয় দেশের সৈন্য ও সমরাস্ত্র গত ৯ মাস ধরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে, যা আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

লাদাখ প্যানগং অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কারণ নিয়ে ভারতের দি ওয়াইর ম্যাগাজিন বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে তীব্র শীতকে লাদাখে সবচেয়ে বড় জেনারেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জেনারেল শীত চীন এবং ভারত উভয়কে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত বিষয়ের পাশপাশি শীত সেখানে দু পক্ষের কাছে শক্তিশালী এক জেনারেলের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে।

লাদাখের শীতল পরিবেশ ক্ষমাহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জেনারেল শীতের সিদ্ধান্তই সেখানে চূড়ান্ত। শীতের কাছে সবাই কাবু। সৈন্যসহ আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ সবই শীতের কাছে বিপর্যস্ত আর অকার্যকর হয়ে পড়ছিল। সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অচল হয়ে পড়ছিল দুই পক্ষেরই অস্ত্রশস্ত্র। ফলে নয় মাস মুখোমুখি অবস্থানের পর প্যানগং অঞ্চল থেকে চীন ও ভারত সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

গত অক্টোবর থেকে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল বরাবর সৈন্য মোতায়েনের পর উভয় দেশের আর্মি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে কোনো কোনো স্থানে তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এমন অনেক জায়গায় ২০২০ সালের মে মাস থেকে মোতায়েন রয়েছে সৈন্য, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, হাউইজার এবং ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিক্যালস। ৩০ ডিগ্রি মাইনাস তাপমাত্রার মধ্যে কখনো কখনো শুরু হয় শীতল ঝড়। তখন ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। এ অবস্থায় সৈন্যদের দক্ষতা যেমন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় তেমনি অচল হয়ে পড়ে যন্ত্রপাতি ।

ভারতের অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের মতে, হিমালয় অঞ্চলে শীতল প্রতিকুল পরিবেশে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে ভারতের। অপর দিকে চীনের রয়েছে উন্নত অবকাঠামো আর অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু তারপরও দুই পক্ষই তাদের শোডাউনের কারণে বরফে ঢাকা এ অঞ্চলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের ভূমিকা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছিল। ইন্ডিয়ান আর্মির একজন টু স্টার অফিসার বলেন, ভারত বা চীন কোনো পক্ষই এ সমস্যার কথা অস্বীকার করতে পারে না।

উঁচু অঞ্চল আর তীব্র শীতের কারণে ভারতীয় আর্মির কতজন মারা গেছে এবং অসুস্থ হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই। পরেও এ সংখ্যা প্রচার হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর ভারতীয় আর্মি থেকে সামান্য দূরে মোতায়েন রয়েছে চীনা আর্মি তাই স্বাভাবিকভাবে তাদের আর্মিরও একই পরিণতি হওয়ার কথা। এই ঘটনার এক ভিডিও প্রকাশ করে চীন অবশ্য দাবি করেছে তাদের ৪ জন সৈন্য সে সময় মারা গিয়েছিলো।

সৈনিক মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য জানা না গেলেও বরফ ঢাকা শীতে ট্যাঙ্ক, হাউইজার, ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভিহিক্যালস কি পরিমান অকার্যকর হয়েছে তা সহজে অনুমান করা যায়। ভারতীয় অধিকাংশ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক রাশিয়ার তৈরি যা সাইবেরিয়ার শীত সহ্য করতে সক্ষম। সেটিও এখানে কী পরিমান ক্ষতির মুখে পড়েছে তাও ভারতের জন্য শিক্ষনীয়।

আরমারড কর্পস অফিসার সাবেক মেজর জেনারেল এপি সিং ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের বিরুদ্ধে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলে লজিস্টিক অপারেশন এবং সৈন্য সমাবেশের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এপি সিং এর মতে হিমালয়ের বরফ ঢাকা অঞ্চলে চীন ভারত উভয় পক্ষের মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এবং ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভিহিক্যালস এর জ্বালানি তেল জমে যায়। ফলে ডিজেল এবং অন্যান্য লুব্রিক্যান্ট প্রবাহিত হতে পারে না। সাব-জিরো তাপমাত্রায় উভয় দেশের মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কে লুব্রিক্যান্ট প্রবাহের ব্যবস্থা রাখা হলেও দুই থেকে তিন ঘন্টা পরপর ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত ট্যাঙ্ক ও সাজোয়া যান চালিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে এগুলো আর চালু করা যায় না।

জেনারেল ওয়্যারকে জানান, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের ওপর ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রভাব ছিল আরো মারাত্মক। কারণ এগুলোর ফায়ারিং পিন এবং কুকিং থাম্ব ছিল দুর্বল। প্রচন্ড ঠান্ডায় এগুলো ফেটে যায়। যদিও ভারতীয় আর্মির তুলনায় চীনা আর্মির মেইনব্যাটল ট্যাঙ্কসহ অন্যান্য সমরাস্ত্র রক্ষানবেক্ষন ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো ভাল কিন্তু আবহাওয়া এতই খারাপ যে, তারা ভারতের তুলনায় তেমন একটা সুরক্ষা পয়নি বলে মনে হয়।

ভারতীয় আর্মি লাদাখের প্যানগং অঞ্চলে অজেয় এবং ভিস্ম মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছে। এগুলোর ইঞ্জিন রাশিয়ার তৈরি। সৈন্য প্রত্যাহারের পর সেখানে মোতায়েন করা ১২০ থেকে ১৩০টি মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হবে। তীব্র ঠান্ডায় এসব ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্যানগং সীমান্তে চীনা আর্মি মোতায়েন করেছিল টাইপ-১৫ হালকা ট্যাঙ্ক। এসব ট্যাঙ্কা চীনের তৈরি। একেকটি ট্যাঙ্ক ১ হাজার হর্স পাওয়ারের সমান শক্তিশালী। ডিজেল চালিত এসব ট্যাঙ্ক ইলেকট্রনিক্যালী নিয়ন্ত্রিত এবং পূর্ণ অটোমেটিক ট্রান্সমিশন। এসব ট্যাঙ্ক চীনা আর্মিতে যুক্ত হয়েছে ২০১৮ সালে। এ ছাড়া চীন তাদের নতুন পিসিএল-১৯১ হাউইজার এবং টাইপ ৮৬ ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিক্যাল মোতায়েন করেছে ভারতের বিরুদ্ধে।

তীব্র শীতে ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান, হাউইজার এবং ক্ষুদ্রস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত গোলাবারুদ ঠিকমত কাজ করে না । যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে তীব্র শীতে সামরিক সরঞ্জাম অকার্যকর হয়ে যায়। কারণ লুব্রিক্যান্টস জমে যায় আর টিউব আর্টিলারির ব্যারেল ফেটে যায়। তা ছাড়া অতি উচুতে সৈন্যদের দৃষ্টিশক্তিরও পরিবর্তন ঘটে। অতি উচুতে বাতাসের চাপ কম থাকে। এতে চোখের কর্ণিয়া বিকৃতি ঘটায়। এরফলে দৃষ্টি বিভ্রম ঘটে। যা সৈনিকদের পারফরমেন্স কমিয়ে দেয়।

গত বছর জুন এবং অক্টোবরে শীতকালীন সৈন্য মোতায়েনের পর সৈনিকদের বসবাসের জন্য উষ্ণ আবাসন তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এছাড়া মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিক্যাল এবং হাউইজার রাখার জন্য অনেক বড় শেড নির্মান দরকার। জেনারেল সিং মনে করেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দুই পক্ষই কোনো বিতর্ক ছাড়া প্যানগং লেক থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছে।

সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা ভারতের পক্ষ থেকে খুবই সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা এবং আর্মি উভয় পক্ষ থেকে এ ঘটনায় অনেক খুসী। আবার চীনের মত শক্তিধর দেশের প্যানগং থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা ভারতে নানাভাবে বিশ্লেষন করা হচ্ছে। দিল্লি মনে করে তারা চীনের সম্প্রসারনবাদী এবং আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ থাকার কারণেই শেষ পর্যন্ত চীন এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বন্ধে সামরিক পদক্ষেপের পাশপাশি দিল্লির পক্ষ থেকে ব্যাকচ্যানেলে কূটননৈতিক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান অস্ট্রেলিয়ার কুয়াদ জোটের কারণে চীন এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

সৈন্য প্রত্যাহার চুক্তি অনুযায়ী চীন ফিঙ্গার-৮ মাউনটেইন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে। অপর দিকে ভারত ফিরে আসবে ১০ কিলোমিটার দূরে ফিঙ্গার-৩ এর কাছে ধান সিং থাপা পোস্টে। এ দুই পোস্টের মাঝখানের জায়গা হবে বাফার জোন অথবা নো গো জোন। এ ছাড়া গোগরা হট স্প্রিং এবং ডেসপাং প্লেইনস থেকেও সৈন্য প্রত্যাহার বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাবে দুই দেশ।

উনিশ শতকের শুরুতে জেনারেল উইন্টার রাশিয়াকে সাহায্য করেছিল নেপোলিয়ান বেনাপোর্টের উন্নত ফরাসী আর্মিকে পরাজিত করতে। আবার ১২৯ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেনারেল উইন্টার রাশিয়াকে সহায়াতে করেছিল উন্নত জার্মান আর্মিকে বিধ্বস্ত করতে। এবার হিমালয় অঞ্চলে জেনারেল ইউন্টার পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশ চীন ও ভারতের মধ্যে অচলাবস্থা এবং ভবিষ্যত সংঘাতের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।