তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রস্তুত প্রথম একটি মানববিহীন আক্রমণে সক্ষম নৌযান ইউলাক উন্মুক্ত করেছে। তুরস্কের এরেস শিপইয়ার্ড এবং মেসেকসান ডিফেন্স মিলে যৌথভাবে সম্পূর্ণ সশস্ত্র মানববিহীন সারফেইস ভেহিকল বা ইউএসভি তৈরি করেছে। এরইমধ্যে নতুন উদ্ভাবিত এ নৌযানটি সমুদ্রে সফলভাবে ট্রায়ালেও অংশ নিয়েছে। খুব শিগগির এ নৌযান দিয়ে গাইডেড মিসাইল টেস্টও পরিচালনা করা হবে।
নতুন প্রযুক্তির এ ইউএসভিটি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এটি হবে বেরাকতার ড্রোনের পর তুরস্কের আরেকটি চমক। এর আগে ড্রোন দিয়ে নাগারনো-কারাবাখ ও সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্ক বিরাট সফলতা পেয়েছে। নতুন এ ইউএসভিটি তুরস্ক প্রতিরক্ষা খাতকে আরো একধাপ এগিয়ে দেবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে এ নৌযানটির নির্মাণ শুরু হয় এরেস শিপইয়ার্ডে। এরেসে দ্রুতগতির পেট্রোল বোট নির্মানের খ্যাতি রয়েছে। অন্যদিকে, মেটেকসান ডিফেন্স মূলত ইএভি এবং উন্নত সমরাস্ত্র ও সমর প্রযুক্তি নির্মানে যথেষ্ট দক্ষ। নৌযানটি উদ্বোধনের পর নির্মাতা দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মনুষ্যবিহীন সারফেইস ভেইকল বা ইউএসভি সেক্টরে তুরস্ক এখন গর্বিত এক অংশীদার রাষ্ট্র। পৃথিবীতে তুরস্কই প্রথম ইউলাক সিরিজের একটি ইএসভি চালু করতে সক্ষম হয়েছে। এর সফল পরীক্ষাও হয়েছে।
খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সমুদ্রে অন্যান্য ট্রায়ালগুলোও সফলভাবে আয়োজন করা হবে। একইসঙ্গে গাইডেড মিসাইল ফায়ারিং টেস্টও পরিচালনা করবে। গত বছরের অক্টোবরে তুরস্ক প্রথম এ নৌযানটি নির্মানের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছিল। এরপর প্রোটোটাইপ ধরনের এই নৌযানটির নকশা প্রনয়ন করা হয় গত আগস্টে আর এর কাঠামোগত নির্মাণ শেষ হয়েছে ৬ মাসের মধ্যেই। এরপরই দেশীয় প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত এ নৌযানটির উদ্বোধন করা হয়। নির্মাতা প্রতিষ্টানের কর্মকর্তার জানিয়েছেন, ইউলাক তৈরির ঘোষণার সাথে সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা ছাড়াও আনুষাঙ্গিক বেশ কিছু খাত এবং এর মিত্রদেশগুলো এ নৌযানের বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
নতুন এ নৌযানটির একটি ভিডিওচিত্র প্রচার করা হয় যাতে দেখা যায় এ নৌযানটি একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধোপকরণ, দুটো এল-ইউএমটিএএস এন্টি ট্যাংক মিসাইল, চারটি ৭০ মিলিমিটারের সিরিত এন্টিট্যাংক অথবা এন্টিপারসোনেল মিসাইল বহণ করতে পারবে। এ মিসাইলগুলো সরবরাহ করছে তুরস্কের মিসাইল সিস্টেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রকেটসান।
সিরিত হলো লেজার গাইডেড একটি ৭০ মিলিমিটার মিসাইল সিস্টেম যা রকেটসান তৈরি করেছে। এ মিসাইলটি ৮কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শত্রুপক্ষের টার্গেটের ওপর হামলা চালাতে পারে। টেস্ট পরীক্ষায় দেখা গেছে নির্ধারিত রেঞ্জের মধ্যে এ মিসাইলের টার্গেটে হিট করা সম্ভাবনা শতভাগ। অন্যদিকে এল-ইউএমটিএএস হলো রকেটসান নির্মিত একটি দূরপাল্লার লেসার গাইডেড এন্টি ট্যাংক মিসাইল যা প্রাথমিকভাবে মূলত হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে আক্রমন চালানোর জন্য তৈরি করা হয়।
এই মিসাইলগুলোতে লেজার গাইডেন্স এবং উন্নত ওয়ারহেড ফিচার থাকায় এগুলো স্টেশনারী এবং চলন্ত- উভয় টার্গেটের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে আঘাত হানতে পারে। এ মিসাইল নিক্ষেপের আগেই টার্গেট বরাবর লকও করে দেয়া যায়।
ইউলাক নৌযানটি তৈরি করা হয়েছে এডভান্সড কম্পোসিট ধরনের উপকরণ থেকে। এ নৌযানটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটার স্পিডে ছুটতে পারে। নৌযানটিতে আধুনিক ইলেক্ট্রো অপটিকাল বা ইনফ্রারেড সেন্সরও যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এ যানটি দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমন চালানোর পাশাপাশি নজরদারি ও পরিদর্শন কার্যক্রমও পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
একইসঙ্গে এ নৌযানে এনক্রিপটেড কম্যুনিকেশন উপযোগী কাঠামো সংযুক্ত করা হয়েছে যেগুলো দিয়ে সারফেইস ওয়ারফেয়ার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য এসকর্ট পরিচালনা এবং কৌশলগত অবকাঠামো নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে।যেকোনো চলন্ত বা গতিশীল যানবাহন থেকেও এ নৌযানটিকে পরিচালনা করা যাবে। পাশাপাশি বিমান বহনকারী ক্যারিয়ার বা এরকম ধরনের কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল শিপস, বা রনতরী থেকে এ নৌযান অপারেট করা যাবে।
প্রাথমিকভাবে ৪শ কিলোমিটার পর্যন্ত সীমানাতে এ নৌযানগুলো কাজ করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি কাঠামোগতভাবে প্রোটোটাইপ ধরনের। নৌযানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে পারবে কেননা এতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স উপযোগী এ্যালগোরিদম দিয়ে এর বোর্ডে প্রয়োজনীয় কম্পিউটার যুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, এতে ম্যানুয়াল অপারেশনের যাবতীয় উপকরণও রয়েছে।
ইউলাকে সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমও সংযুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যত যুদ্ধক্ষেত্রের যাবতীয় প্রয়োজনীয়তা ও উদ্ভুত পরিস্থিতির ভিন্নধর্মী চাহিদা পূরণে এ নৌযানটি যেন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্যই এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নতুন এ নৌযানটি আশপাশে থাকা অন্যন্য জাহাজ এবং সহায়ক ইউএভি ও ইএসভি’র সাথে সমন্বয় করেও কাজ করতে সক্ষম।
সামরিকখাতে এখন বিশ্বজুড়েই মনুষ্যবিহীন সারফেইস ভেইকলের বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইউএভি এবং সোয়ার্ম ড্রোনের পাশাপাশি ইউএসভির চাহিদাও অনেকটা বেড়েছে। মনুষ্যবিহীন এসব প্রযুক্তি দিয়ে খুবই সফলতার সাথে প্রতিপক্ষের টার্গেট সনাক্তকরন এবং নজরদারি করা সম্ভব হয়। এ প্রযুক্তি একদিকে যেমন কার্যকরী আর অন্যদিকে মানুষ না থাকায় এ ধরনের সিস্টেম ব্যবহারে সৈনিকদের মৃত্যুঝুঁকিও অনেকটা কমে যায়।
ইউএসভিগুলো বড়ো জাহাজগুলোকে পণ্য ও অস্ত্র সরবরাহ করতেও কাজে লাগে। জলদস্যুপ্রবণ এলাকায় বড়ো জাহাজগুলো কাজ করতে গিয়ে যেসব ঝুঁকির মুখোমুখি হয়, ইউএসভিগুলো সেক্ষেত্রে অনেকটা নিরাপদেই কাজ করে আসতে পারে। ইউএসভি থাকলে নৌবাহিনীর এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারও শক্তিশালী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে সি হান্টার নামের একটি ইউএসভি নির্মাণের চেষ্টা করছে।
ইউলাক নৌযানে কম্যুনিকেশন এবং ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের নানা কৌশলও যোগ করা হয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইউলাক জ্যাম সৃষ্টি করতে পারে এবং যেকোনো প্রয়োজনে ইলেক্টনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমকেও ব্যবহার করতে পারে। অন্যান্য ইউএভি, এইউএভি এবং টিইউএভির মতো ইউলাকও যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম।
রিমোট দিয়ে ইউলাককে কন্ট্রোল করা যাবে না। তবে স্বয়ংক্রিয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি থাকায় নৌযানটি নিজের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মনুষ্যবিহীন এ নৌযানগুলো উপকূল ভিত্তিক ভেসেল যেমন ফ্রিগেট দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা যাবে। বতর্মানে ইউলাকের যে সংস্করণটি নির্মিত হয়েছে তা ২শ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে ডাটা ট্রান্সফার করতে পারবে। ভবিষ্যতে একে স্যাটকমের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
তুরস্ক নৌবাহিনী শক্তিশালী করার দিকে এখন অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ছয়টি সাবমেরিন যুক্ত হতে যাচ্ছে তুরস্ক নৌবাহিনীতে। ২০২২ থেকে ২০২৭ সালে প্রতি বছর একটি করে এ নতুন সাবমেরিণ পাবে তুরস্কের নৌবাহিনী। অন্যান্য যুদ্ধ উপকরনের মতো সাবমেরিন গুলো তুরস্কের নিজেদের তৈরি। অপর দিকে তুরস্কের তৈরি এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ জাহাজ বা বিমানবাহী রণতরী এ বছরের শেষ দিকে যুক্ত হতে যাচ্ছে তুরস্ক নৌবাহিনীতে। মনুষ্যবিহীন নৌযান তুরস্কের নৌশক্তিকে নতুন মাত্রা দেবে।
নৌ-শক্তিতে গুরুত্ব প্রদানের বিষয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর বলেছেন, ইতিহাস আমাদের দেখায় যে, যে দেশ নৌশক্তিতে শক্তিশালী সে দেশ সর্বদা সর্বোচ্চ শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। আর যে দেশের নৌ-শক্তি নেই সে দেশ দুর্বল। আরো আগে আমাদের এ শক্তি অর্জন করা দরকার ছিল। কিন্তু এখন আমরা এই শক্তি অর্জন করতে যাচ্ছি। আগামি দিনে এই নৌশক্তি আরো সমৃদ্ধ করা হবে।