কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরা অনলাইন ভারতীয় আর্মি এবং তাদের ভবিষ্যৎ সমর কৌশল বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে উত্তরে হিমালয় অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণে সমুদ্রে এক সাথে চীন এবং পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে ভারত। আর সবচেয়ে খারাপ এ পরিস্থিতি সামনে রেখে ভারত তাদের সামরিক কৌশল গ্রহণ করেছে এবং সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। লাদাখ সংঘাত এবং চীনের সাথে সম্পর্কের অবনতির পর শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের সমরকৌশল কেন্দ্রীভূত হতে থাকে চীনকে সামনে রেখে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে ভারতীয় আর্মির বিদ্যমান দুর্বলতার পাশপাশি তাদের সুবিধাজনক কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে চীন এবং পাকিস্তানের বিপরীতে ভারতীয় আর্মির তুলনামূলক আলোচনাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। চীন ও পাকিস্তানের সাথে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ মোকাবিলায় ভারত সমর প্রস্তুতির পাশপাশি গ্রহণ করেছে কূটনৈতিক উদ্যোগ। চীন যেমন ভারতের মোকাবিলায় পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে এগোচ্ছে, তেমনি ভারতও তাদের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে পাশে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে ভবিষ্যৎ সংঘাতের ক্ষেত্রে।
আলজাজিরার প্রতিবেদন বলা হয়েছে ভারতের সামরিক কৌশলগত অবস্থানে নাটকীয় পরিবতন আনা হয়েছে। ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তান আর পাকিস্তান ঘিরেই নিবদ্ধ ছিল এতদিন পর্যন্ত তাদের কৌশলগত অবস্থান ও পরিকল্পনা। তবে ভারতের এখন আসল মাথা ব্যাথার কারন চীন। চীনা আর্মির দ্রুত আধুনিকায়নে উদ্বিগ্ন ভারত।
আলজাজিরার প্রতিবেদনের শুরুতেই ভারতীয় আর্মি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভারতের বিমান বাহিনী দুর্বল। আর সেনাবাহিনী গত শতাব্দীর কৌশলগত ধারণার মধ্যে আটকে আছে এখনও। নৌবাহিনী কাগজে কলমে বেশ শক্তিশালী কিন্তু বাস্তবে তা চীনের ধারেকাছেও নেই।
তবে ভারত তার নিজের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে। গত বছর লাদাখ সীমান্তে দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ভারত ক্রাশ প্রগ্রাম ঘোষনা করেছে। এর উদ্দেশ্য ভারতীয় আর্মির দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা এবং বর্তমানে বিদ্যমান সুবিধাগুলির উপযুক্ত ব্যবহার করা।
ভারতের প্রতিরক্ষা কোল্ড স্টার্ট ডকট্রিন ব্যবহার করে শক টেকটিকস নির্ভর। সাজোয়া হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সংক্ষিপ্ত তীক্ষè আক্রমন করে দ্রুত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে ফেলা যাতে প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিকৃয়া দেখানোর সুযোগ না পায়।
চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ কৌশল হবে ভিন্ন বিষয়। কারন বরফ আচ্ছাদিত হিমলায় অঞ্চলে সাজোয়া হামলা অকার্যকর। মোবাইল আর্টিলারি, হিমলায় অঞ্চলে যুদ্ধ করার মত বিশেষ বাহিনী, এবং প্রিসিশন স্ট্রাইক করার মত অস্ত্র অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে বিমান শক্তিই হবে মূল ফোর্স। আর সেটিও হতে হবে খারাপ আবহাওয়া এবং উচুতে অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম।
তবে এর মধ্যেও ভারতীয় আর্মির বেশ কিছু সুবিধার দিক রয়েছে। দেশটি ২১টি স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের অধিকারী। এর মধ্যে অর্ধেক নিয়োজিত রয়েছে ছবি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজে। এর মাধ্যমে ভারত জানতে পারছে হিমালয় অঞ্চলে কি ঘটছে।
ভারতীয় আর্মি মূলত এখনো ট্যাঙ্কের মত সাজোয়া যান নির্ভর। কিন্তু যুদ্ধ কৌশল যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সে বিষয়ে ভারতের পরিকল্পনাবিদরা এখনো অনেক পেছনে রয়েছেন সচেতন হওয়ার বিষয়ে। বিশেষ করে ভারতের শত্রু রাষ্ট্রগুলো দ্রুত নতুন নতুন যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতীয় শসস্ত্রবাহিনী সাইবার এবং স্পেস এসেটস জোরালোভাবে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে। একই সাথে তারা স্পেশাল ফোর্সেস এবং দীর্ঘ পাল্লার প্রিসিশন হামলার ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
ভারতীয় আর্মির কাছে রয়েছে সাড়ে তিন হাজার মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। এর বিপরীতে পাকিস্তানের কাছে রয়েছে ২ হাজার ৪০০টি মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। ভারতীয় মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের অধিকাংশই রাশিয়ান তৈরি।
ভারত অর্জুন নামে দেশীয় ট্যাঙ্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তা চূড়ান্তরুপে ব্যর্থ হয়েছে। ৩০ বছর ধরে ব্যাপক অর্থ ব্যায় করেছে এ ট্যাঙ্কের পেছনে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে অনেক দেরিতে ভারত যে ট্যাঙ্ক তৈরি করেছে তার খুবই ভারী আর যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান খুসী রাখতে সরকারের চাপে আর্মি ১২৪টি অর্জুন ট্যাঙ্ক ক্রয় করে। বেশ কযেকবার এটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও ভারতীয় আর্মি মূলত রাশিয়ান ট্যাঙ্ক সংগ্রহেই বেশি আগ্রহী। ভারত এখন রাশিয়ার কাছ থেকে টি-১৪ আল্ট্রা মডার্ণ ট্যাঙ্ক ক্রয়ের জন্য আলোচনা শুরু করেছে।
চীনের সাথে সম্পর্ক অবনতির পর ভারতের কৌশলগত অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলার কথা বিবেচনা করে। তবে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মতবাদ এখনো এই পরিবর্তনের সাথে সমন্বয় করা হয়নি।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে চীনের বিপরীতে ভারতীয় আর্মির কয়েকটি সুবিধাজনক দিক তুলে ধরা হয়েছে। এর একটি হলো হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় আর্মির রয়েছে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যা চীনের নেই। চীন সর্বশেষ যুদ্ধ করেছে ভিয়েতনামের সাথে ১৯৭৯ সালে। তবে ভিয়েতনামে অভিযানের তিন সপ্তাহের মাথায় তাদের আবার সরে আসতে হয়েছে। এ অভিযানে চীনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মারা যায় অনেক সৈনিক।
১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সাথে ভারতের বড় আকারের যুদ্ধ ঘটে । এর নাম কারগিল যুদ্ধ। এ যুদ্ধের শিক্ষাকে ভারতীয় হাই কমান্ড আর্মির অনুশীলনে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ধরনের আরো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে ভারত কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেছে। বরফ শীতল আবহাওয়ার উপযুক্ত পোশাক সংগ্রহ করেছে ভারতীয় আর্মি। জোরদার করা হয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। জয়েন্ট সার্ভিস ডিফেন্স স্টাফ সেট করা হয়েছে। আর্মির সব শাখাকে যদি এক সাথে সমন্বিতভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে হয় সে ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় আর্মির জন্য।
ভারতীয় আর্মির রয়েছে বেশ কয়েটি উচ্চ প্রশিক্ষিত ইউনিট। এর মধ্যে একটি হলো ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ বা আইটিবিপি। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৮৯ হাজার ৫০০। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বাহিনী রয়েছে যারা হিমালয় অঞ্চলে এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্যও পারদর্শী।
১২টি পার্বত্য ডিভিশন বর্তমানে মোতায়েন অবস্থায় রয়েছে । যে বিশেষ বাহিনীর কথা বলা হয়েছে তা এর বাইরে। উত্তরে কারাকোরাম পর্বতমালা আর দক্ষিণে জানসকার এর মধ্যে অবস্থিত লাদাখ। এর পশ্চিমে পাকিস্তান এবং পূর্বে চীন সীমান্ত। অঞ্চলটি রুক্ষ পাহাড়ী হলেও কয়েক শত বছর ধরে এটি সিল্ক রুটের অংশ। আর এ অঞ্চল ঘিরে পারস্য, তিব্বত এর রাশিয়ানদের মধ্যে বিভিন্ন সময় যুদ্ধও হয়েছে। আর এ যুদ্ধ হয়েছে পাহাড়ী রুট আর বানিজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য। আর লাদাখের সাথে সীমান্ত রয়েছে কাশ্মীরের।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে ভারতের বিমান বাহিনীর নাজুক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে ।
এতে বলা হয়েছে, ভারতের আর্মি কৌশলগত অবস্থা মূলত বর্তমানে চীন আর পাকিস্তান ঘিরে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাজেটের বেশির ভাগ যায় আর্মি তথা স্থল বাহিনীতে। বিমান বাহিনী অর্থ সঙ্কটে ভুগছে এবং বর্তমানে এটি বেশ দুর্বল। ৪২টি স্কোয়াড্রনের মধ্যে ৩১টি ফিল্ড করতে সক্ষম।
মিগ-২১ বিমান ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ১৯৬৪ সালে। অনেক বছর আগে এ বিমানের অবসরে পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু এগুলো এখনো আকাশে উড়ছে। বর্তমানে যে কোনো যুদ্ধ বিমান সহজে ধ্বংস করতে পারে এ বিমান।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের সাথে কাশ্মীর সংঘাতের সময় মিগ-২১ এর দুরবস্থার বিষয়টি সামনে আসে। পাকিস্তানের এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ভূ-পাতিত করে একটি মিগ-২১। ধরা পড়ে মিগ-২১ এর পাইলট এবং তাকে দেখানো হয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। চরম বিব্রতকার অবস্থার মুখোমুখি হয় ভারত। এরপর চীনের সাথে লাদাখ সংঘাতের পর ভারত বাধ্য হয় জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধ বিমান সংগ্রহে এবং বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে।
গত বছর জুলাইয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ফ্রান্সের তৈরি ৫টি বহুমুখী রেফালে যুদ্ধ বিমান। ১২টি সুখই এমকেআই-৩০ এবং ২১টি মিগ-২৯ বিমানের অর্ডার করা হয়। সুখই বিমান রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে নির্মান করছে ভারত।
পাকিস্তান এবং চীনের সাথে ভবিষ্যত যে কোনো সংঘাতে ভারতের কাছে থাকা রেফালে বিমান এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক দিন পর ভারতীয় বিমান বাহিনী কয়েকটি শুক্তিশালী যুদ্ধ বিমান পেলেও এ বাহিনী এখনো অনেক পেছনে যা দেশটির জন্য উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারতীয় বিমান বাহিনী শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাথে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করা হয়েছে ৫টি এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সংগ্রহের জন্য। ইসরাইল থেকেও ভারত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ভারতের সাথে যে কোনো দেশের সংঘাতে ভারতের এ সমরসজ্জা গুনগত পরিবর্তন আনবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্প্রতি ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। এর ফলে ভারত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা অর্জন করতে পারবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের জিওস্পাশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সহযোগিতায় ভারত ওভারল্যান্ড রিকনিস্যান্স এয়ারক্রাফট, এটাক হেলিকপ্টার, হেভি লিফট হেলিকপ্টার এবং কৌশলগত পরিবহন বিমান দ্রুত মোতায়েন করতে পারবে সম্ভাব্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
ড্রোনের ক্ষেত্রেও ভারত উন্নতি লাভ করেছে। ভারতকে মূল ড্রোন সরবরাহকারী দেশ হলো ইসরাইল। ইতোমধ্যে ভারত ইসরাইল থেকে ৯০টি হেরন ড্রোন সংগ্রহ করেছে এবং আরো ২০টি আমেরিকান এমকিউ-৯ রিপার আর্মড ড্রোন সংগ্রহের আবেদন করেছে। এসব ড্রোন বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকা থেকে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতে পারে এবং একই সাথে লক্ষ্য বস্তুতে আক্রমন পরিচালনা করতে পারে।
তবে এসব আয়োজন হয়ত লাদাখে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী করবে কিন্তু দুর্গম পাহাড়ী আর দূরবর্তী এলাকায় লজিস্টিক সাপ্লাই পৌঁছানো এখনও ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।