মিসাইল প্রযুক্তির উন্নতি করেই চলেছে বিভিন্ন দেশ। একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাড়িয়ে চলেছে এর পাল্লা। শুধু তাই নয়, এক দেশ থেকে অন্যদের হাতে যাচ্ছে এর প্রযুক্তি। এক সময় সীমিত কয়েকটি দেশের হাতে থাকলেও এখন বিশ্বের অনেকগুলো দেশ, এমনকি মিলিশিয়া গোষ্ঠির হাতেও রয়েছে মিসাইল প্রযুক্তি।
বিশ্ব এখন মিসাইলময়। পাঁচটি দেশ রয়েছে, যারা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে আঘাত হানতে পারে ব্যালেস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে। এই দেশগুলো হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এর বাইরেও অনেক দেশ মিসাইল প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি করে চলেছে। প্রতি বছর মিসাইল যুগে প্রবেশ করছে নতুন নতুন দেশ। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্রাজেটিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর ইয়ান উইলিয়ামস বলেন, আমরা একটি মিসাইল বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছি।
অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন দেশের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে গবেষণা করছেন এই সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, অনেকগুলো দেশ আছে যারা ক্ষেপণাস্ত্রের জগতে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। বিষয়টি এক দিকে যেমন আঞ্চলিক উত্তেজনা তৈরি করবে, অন্যদিকে বাড়িয়ে তুলবে যুদ্ধের সম্ভাবনা। তিনি মনে করেন, নিজেদের মিসাইল কর্মসূচি আক্রান্ত হবে তেমন আশঙ্কা করলেই তারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, এসব দেশগুলোর মিসাইল কর্মসূচির উন্নয়ন হয়েছে বেশির ভাগই অপ্রচলিত বা সেকেলে প্রযুক্তিতে। যার ফলে এগুলোর টার্গেটিং একুরেসি বা নির্ভুলভাবে হামলা করার ক্ষমতা কম। যার ফলে এতে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। এবং একই সাথে এসব মিসাইল মিলিশিয়া বা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এই দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ তাইওয়ান, ইরান, সৌদি আরব। প্রধানত এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো গত দুই দশকে মিসাইল কর্মসূচিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এদের মধ্যে কারো কারো হামলার রেঞ্জ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে অন্য মহাদেশ পর্যন্ত পৌছে গেছে। যেমন উত্তর কোরিয়াই যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার হুমকি দিচ্ছে।
সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হবে এই দেশগুলো তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্যই মিসাইল কর্মসূচিতে এত বিপুল বিনিয়োগ করছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিযোগীতা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। উত্তর কোরিয়া এই বিপদের বড় উদাহরণ। দেশটি ক্রমশই তার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বাড়িয়ে চলছে। ১৯৯০ সালে পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বোচ্চ পাল্লা ছিলো ৭৪৫ মাইল, যা বর্তমানে বেড়ে দাড়িয়েছে ৮ হাজার মাইলের বেশি। যার কারণে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জায়গাকে তাদের হামলার আওতায় আনতে পেরেছে। অন্যদিকে এই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়াও কিছুটা বাড়িয়েছে সক্ষমতা। তারা এখন উত্তর কোরিয়ার যে কোনো জায়গায় হামলা চালাতে পারে।
ইরান, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান- তিনটি দেশই জোরেশোরে মিসাইল কর্মসূচি চালাচ্ছে। এবং এসব দেশের কিছু মিসাইলের মধ্যে এমন সামঞ্জস্যতা রয়েছে, যা দেখলে মনে হয় যে এরা হয়তো একে অন্যের সাথে প্রযুক্তি আদান-প্রদান করেছে। ১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তান তাদের মিসাইল কর্মসূচিতে জোর দেয় এবং ধারণা করা হয় তারা এ বিষয়ে চীনের সহযোগিতা পেয়েছে। আর চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রায় সর্বত্র হামলার সামর্থ অর্জন করে।
পাকিস্তানের চির বৈরী প্রতিবেশী দেশ ভারতও দ্রুত বাড়াচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা। পাকিস্তানের যে কোনো প্রান্তে আঘাত হানতে পারে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র। আরেক আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনেরও অনেক এলাকায় পৌছতে পারে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র। অনেক দিন ধরেই রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে এই সেক্টরে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। তাদের ব্রাহ্মস খুবই উন্নত মানের ক্ষেপণাস্ত্র।
১৯৯০ সালের আগেই ইরানে হামলার সামর্থ অজর্ন করেছে সৌদি আরব ও ইসরাইল; কিন্তু ইরান এখন পাল্টা হামলা চালানোর ক্ষমতা অর্জন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশই এখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়। আর ইরানের হাতে এই প্রযুক্তি এসেছে উত্তর কোরিয়া থেকে।
আবার ভারতও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে সহযোগিতা নিচ্ছে মিসাইল কর্মসূচিতে। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সাবমেরিন থেকে মিসাইল উৎক্ষেপণ বিষয়ে দেশ দুটি যৌথভাবে কাজ করছে। এই লক্ষ্যে সফল হলে দুটি দেশই এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাবে। সাবমেরিন থেকে মিসাইল উৎক্ষেপণের সামর্থ্য থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশটি অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। কারণ শত্রুর হামলায় দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও তখন সমুদ্রের তলদেশ থেকে পাল্টা হামলার সুযোগ থাকে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার ১৪টি ওহিও ক্লাস সাবমেরিনের প্রতিটিতে মোতায়েন রেখেছে ২৪টি করে ট্রাইডেন্ট টু ব্যালেস্টিক মিসাইল। একই কাজ করেছে ব্রিটেনও।
তবে মিসাইল নিয়ে দেশগুলোর এই বেপরোয়া মনোভাব এবং পারস্পারিক সহযোগিতা থেকে এসব প্রযুক্তি সন্ত্রাসী বা মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর হাতে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে যার নজিরও পাওয়া গেছে। সেবার ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা একটি ব্যালেস্টিক মিসাইল ছোড়ে সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে। শিয়া হুথিরা অনেক দিন ধরেই ইয়েমেনের রাজধানীসহ অনেক এলাকা দখলে রেখেছে। আর তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে ইরান ও লেবাননের মিলিশিয়া গোষ্ঠি হিজবুল্লাহ।
এছাড়াও হুথিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময় সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে অনেকগুলো মিসাইল ছুড়েছে হুথিরা। আর তারা যে মিসাইল ব্যবহার করছে সেটি স্কুড মিসাইলেরই একটি পরিবর্তিত রূপ। স্কুড মিসাইল ও এর পরিবর্তিত রূপগুলো এখন বিশ্বে কমন হয়ে গেছে। ১৯৫০ এর দশকে রাশিয়ার তৈরি এই মিসাইলটি গণবিধ্বংসী অস্ত্রবহন করতে পারে।
বর্তমানে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ স্কুড মিসাইলে। আর উত্তর কোরিয়ার মতো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশের হাতে এই মিসাইল যাওয়ার অর্থ এর বিস্তার রোধের আর কোনো উপায় নেই। কয়েক দশকের নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ সত্ত্বেও দেশটি ব্যালেস্টিক মিসাইলের বিরাট পরিবার গড়ে তুলেছে, আর এসব তারা করেছে এই স্কুড মিসাইল থেকে লব্ধ জ্ঞান দ্বারাই। এই স্কুড থেকেই ২০ বছরে ধীরে ধীরে ব্যালেস্টিক মিসাইল পর্যায়ে পৌছে গেছে কিম জং উনের দেশ। কিছু কিছু প্রযুক্তি বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রিও করেছে উত্তর কোরিয়া। অন্তত মার্কিন সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের দাবি তেমনটাই। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক মিডলবুরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক জেফরি লুইস বলেন, সোভিয়েত ও পরবর্তীতে উত্তর কোরীয় স্কুড মিসাইল হচ্ছে মিসাইল জগতে প্রবেশের সবচেয়ে সহজ রাস্তা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশে দেশে এর বিস্তার হচ্ছে।
এখন আর মিসাইল প্রযুক্তির বিস্তার রোধ করা অনেক কঠিন। তার চেয়েও বড় কথা এর ছোট ছোট অংশ যেমন- গাইডেন্স সিস্টেম, ইঞ্জিন এমনকি মানুষের দক্ষতার মতো বিষয়গুলো বিক্রি বন্ধ করা অসম্ভব। একটি কম্পিউটার ড্রাইভে করেই অসংখ্য গোপন তথ্য পাচার করা সম্ভব। কখনো কখনো একটি ছোট যন্ত্রাংশও এক্ষেত্রে অনেক বড় কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি একটি ইঞ্জিন হাতে পাওয়ার পরই উত্তর কোরিয়া তার মিসাইল কর্মসূচিতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে।
ডক্টর লুইস এ প্রসেঙ্গ বলেন, অনেক দেশই এখন রকেটের গোপন বিষয়গুলো শিখছে এবং এর আরো বিপজ্জনক সংস্করণ তৈরির চেষ্টা করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ভারত এমন একটি মিসাইল নিয়ে কাজ করছে বিশ্বের অর্ধেক জায়গা যেটির আওতায় চলে আসবে।
মিসাইল প্রযুক্তি কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার একটি নমুনা দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। যাতে দেখা গেছে ১৯৮০’র দশকে সম্ভবত মিসর থেকে স্কুড বি মিসাইল প্রযুক্তি হাতে পায় উত্তর কোরিয়া। এর এই প্রযুক্তির সহায়তায় তারা উদ্ভাবন করে হাসং ৫, যেটি তারা প্রায় এক ডজন দেশের কাছে রফতানির পরিকল্পনা করে, যার মধ্যে ছিল ইরানও।
ইরান এরপর নিজেরাও স্কুড মিসাইল তৈরি করে এবং সন্দেহ করা হয় যে তাদের মাধ্যমেই সিরিয়ার সরকার ও ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের হাতে পড়েছে এই প্রযুক্তি। আবার উত্তর কোরিয়া তাদের নো ডং মিসাইল পাকিস্তান ও ইরানের কাছে বিক্রি করেছে বলেও শোনা যায়।
এভাবেই একদেশ থেকে অন্যদের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে মিসাইল প্রযুক্তি। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে ইয়েমেনের হুথিদের মতো মিলিশিয়া গোষ্ঠিগুলোর হাতে এসব সমরাস্ত্র প্রযুক্তি গেলে সেটি এক সময় আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন কী সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোও মিসাইল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর সেটি হলে বিশ্ব যে বড় এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।