যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সখ্যতা গড়ে ভারত সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করছে। প্রতিরক্ষা খাতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তখন ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানও নীরবে বসে নেই। পাকিস্তান সপ্তমবারের মতো আমান-২১ নামের নৌমহড়া আয়োজন করেছে। এবারের মহড়া পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপক ও ব্যয়বহুল। মোট ৪৫টি দেশ তাদের নিজ নিজ নৌযান নিয়ে এ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। ৪৫টি দেশের সারফেইস ও এয়ারস্পেস, স্পেশাল অপারেশন ফোর্স, মেরিটাইম বাহিনী, পর্যবেক্ষক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিলে যৌথভাবে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে।
উত্তর আরব সাগরে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে চারদিনের এই নৌমহড়া শুরু হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এবং নৌ খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ মহড়াটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
নৌ সমরের ইতিহাসে এবারের মহড়াটি খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ। কারণ বিশ্বের সর্ববৃহৎ তিন নৌ পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের নৌ বাহিনীর সমরাস্ত্র এ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। বিগত এক যুগের মধ্যে এই প্রথম রাশিয়া ন্যাটো সদস্যদের সাথে মিলে এ ধরনের একটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিল।
পরাশক্তিদেরকে এরকম একটি মহড়ায় নিয়ে আসতে সক্ষম হওয়ায় বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে পাকিস্তানের জন্য বড় আকারের অর্জন হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে বিশ্বে ভূরাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান যে ক্রমশই গুরুত্বপূর্র্ণ হয়ে উঠছে এ মহড়া তার একটি প্রমাণ। এ মহড়া আরো প্রমাণ করে যে, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই পাকিস্তানের সাথে সামরিকখাতে একসাথে কাজ করতে চাইছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর চীফ অব নাভাল স্টাফ এডমিরাল আমজাদ খান নিয়াজী বলেন, “বড় বড় দেশগুলো পাকিস্তানের সাথে এ মহড়ায় অংশ নেয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা সকলেই পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতার বিষয়ে আস্থাশীল। পাকিস্তানই সর্ব প্রথম প্রাচ্যের ও পশ্চিমা দেশগুলোকে এক কাতারে একটি সামরিক যৌথ মহড়ায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
আমান টোয়েন্টি ওয়ানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অংশ গ্রহণকে দেশটির ভূকৌশলগত পরিবর্তন এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন বার্তা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এ মহড়ায় রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিট ন্যাটোর অন্যান্য দেশগুলোর সাথে অংশ নিচ্ছে যা খুবই তাৎপর্যপূর্র্ণ। এর আগে দীর্ঘ সময় মস্কো পশ্চিমা সামরিক শক্তির সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছিল।
পাকিস্তান আশা করছে, তারা পশ্চিমা দেশগুলোর জোট, রাশিয়া ও চীনকে একসাথে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। দীর্ঘদিন থেকে পাকিস্তান নিজেদেরকে ব্লু ওয়াটার ফোর্সে পরিণত করার জন্য যে স্বপ্ন দেখে আসছে, এ মহড়ার মাধ্যমে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে। পাকিস্তান সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আধুনিকমানের যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন এবং মনুষ্যবিহীন প্রযুক্তি সংগ্রহে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানে নতুন যে গোয়াদার বন্দরটি নির্মিত হয়েছে তা দেশটির ভূকৌশলগত গুরুত্ব অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বন্দরের ওপর ভর করেই বিলিয়ন ডলারের চায়না পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর প্রকল্পের গোটা নকশা ও কর্মসূচী প্রনয়ন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ জাতীয় একটি মহড়ার খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ এ বন্দরটি পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ।
গোয়াদার বন্দরটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল জাহাজগুলোর চলাচলের পথেই অবস্থান করছে। ধারনা করা হচ্ছে যে, আগামী দিনে গোয়াদারকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে একটি ট্রেড হাব প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, আন্তর্জাতিক নানা বন্দর ও রুট থেকে গোয়াদার বন্দরটি ভারতীয় উপকূলের তুলনায় অনেকটাই নিকটবর্তী। তাই গোয়াদারকে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্যে ভারতের তুলনায় পাকিস্তান বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সার্বিকভাবে পাকিস্তান এ মহড়ার মাধ্যমে অনেক বেশি উপকৃত হবে। কেননা, তারা নৌ পরাশক্তিগুলোর সর্বাধুনিক সব সমরযানগুলোকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করার সুযোগ পাবে। পাকিস্তান যেহেতু আগামী সময়ে অন্যতম নৌ পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হতে চায়, তাই এ জাতীয় মহড়ার আয়োজন করে তারা আগেভাগেই বিশ্বকে সে বার্তাটুকু জানিয়ে দিতে চায়।
নৌ পথ থেকে এবার আসা যাক আকাশপথের খবরে। মার্কিন সরকারের ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্টস এজেন্সি বা ডিএআরপি নতুন ড্রোন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিমান ও সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন, জেনারেল এ্যাটোমিক্স এবং নর্থোপ গ্রুম্মানকে নতুন ধরনের একটি কমব্যাট ড্রোন নির্মাণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেছে।
মার্কিন প্রশাসনের লং শট প্রকল্পের আওতায় দেশটির নীতি নির্ধারকরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বোয়িংসহ এ তিনটি সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মার্কিন সামরিক বাহিনীতে সর্বাধিক সংখ্যক অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেছে।
লংশট প্রকল্পের আওতায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন একটি ধারণা নিয়ে কাজ করতে হবে যেখানে বড় আকারের মনুষ্য বিমান থেকে একটি ড্রোন নিক্ষেপ করা হবে। যা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় মিশন পরিচালনা করবে এবং নিজের সাথে বহন করা অস্ত্র দিয়েই প্রতিপক্ষের হুমকিগুলোকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
আকাশ থেকে এ ধরনের এয়ার টু এয়ার কমব্যাট ড্রোন উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য হলো নিক্ষেপের স্থানটিকে আরো প্রসারিত ও বৈচিত্রময় করা। একইসাথে প্রতিপক্ষের আক্রমনের ঝুঁকি কমিয়ে আনা। প্রতিপক্ষের এয়ার ডিফেন্সকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সামরিক উদ্দেশ্য পূরণ করা।
ডিএআরপিএ হলো মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। গত ৮ ফেব্রুয়ারী তারা এই ড্রোন নির্মাণের জন্য সাক্ষরিত এ চুক্তিটি প্রকাশ করে।
ডিএআরপিএ’র প্রকল্প পরিচালক লেফটেনেন্ট কর্নেল পল কলহোওন বলেন, লংশট এ প্রকল্প মনুষ্যবিহিন প্রযুক্তির প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে এয়ার কমব্যাট অপারেশনের ধরনটাই বদলে দেবে। লংশট প্রকল্পটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ পারদর্শিতা অর্জন করায় প্রথাগত অনেক অস্ত্রের কার্যকারিতাই হ্রাস করে দেবে। ডিএআরপিএ দাবি করছে, বর্তমানে আকাশপথে সমরযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের ধারনাটি মূলত এডভান্সড যুদ্ধবিমানের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। এখন পর্যন্ত ফাইটার জেট বিমানকেই শত্রুপক্ষের সীমানায় প্রবেশ করে অস্ত্র সরবরাহ করে আসতে হয়। কিন্তু লংশট প্রকল্পটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যেখানে মনুষ্য প্রযুক্তিকে খারিজ করা হবে না।
পাইলট পরিচালিত বিমানগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত রেঞ্জের বাইরে নিরাপদে রাখা হবে আর ড্রোন দিয়ে ঝুঁকিপূর্র্ণ কাজগুলো করা হবে। এতে বিমান বাহিনীদের জীবন নিরাপত্তা বাড়বে। লংশট প্রকল্পের আওতায় ফাইটার জেটের পরিবর্তে এয়ার টু এয়ার কমব্যাট ড্রোনগুলো প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাবে। এ ড্রোনগুলো স্বল্প দূরত্বের মিসাইলও নিক্ষেপ করতে পারবে। এ কমব্যাট ড্রোন নির্মাণ করার জন্য পেন্টাগন ২০২১ সালের বাজেটে বেশ বড় আকারের অর্থও বরাদ্দ রেখেছে।
ডিএআরপিএ অবশ্য এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ২২ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চেয়েছে। এ অর্থ দিয়ে নতুন ডিজাইনকে উন্নত ও সংশোধন করা হবে। পরবর্তীতে প্রস্তাবিত অস্ত্রযুক্ত আকাশ থেকে নিক্ষেপন যোগ্য ড্রোন নির্মাণে আরো ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। নির্মিতব্য এ ড্রোনটির নাম দেয়া হয়েছে গানস্লিংগার।
যেসব বিমান থেকে ড্রোনগুলো নিক্ষেপ করা হবে সেগুলোকে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য বৈমানিক হুমকি থেকে দূরে রাখার জন্যই গোটা আয়োজনটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মার্কিন বিমান বাহিনীর সমর পারদর্শিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব আরো বেড়ে যাবে বলে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আশা করছেন।
বর্তমানে মার্কিন বিমান ও নৌ বাহিনী যৌথভাবে এইম টু-সিক্সটি নামক দূরপাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল নিয়ে কাজ করছে। এ মিসাইলটি নির্মাণ করেছে লকহিড মার্টিন। মানুষের স্বাভাবিক ভিজুয়াল রেঞ্জের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্বে এ মিসাইলটি গিয়ে শত্রুপক্ষের টার্গেটে হামলা চালাতে পারবে। প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য হুমকিকে নিস্ত্রিয় করে দেয়ার জন্য এ মিসাইলটিকে ব্যবহার করার কথা ভাবছে। একইসঙ্গে মার্কিন বিমান ও নৌ বাহিনী যৌথভাবে বর্তমানে ব্যবহৃত এইম-ওয়ান টোয়েন্টির স্থলে উন্নত সংস্করনের মিসাইল নিয়ে আসার জন্যেও কাজ করে যাচ্ছে।