মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন এখনই পঞ্চম প্রযুক্তির এফ-থার্টি ফাইভ স্টেলথ যুদ্ধবিমানে পারমাণবিক বোমা বহনের সুযোগ সংযোজন করতে যাচ্ছে। ব্লক ফোর আপগ্রেডের আওতায় ট্যাকটিকাল পারমাণবিক বোমার এই অপশনটি যুক্ত হচ্ছে। এর আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল , মার্কিন এফ থার্টি ফাইভ-এ লাইটনিং দ্য সেকেন্ড সংস্করণের একটি বিমান বি সিক্সটি ওয়ান-টুয়েলভ পারমাণবিক বোমা বহন করে পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন চালিয়েছিল। নেভাদার সান্দিয়া ন্যাশনাল ল্যাবোরেটরিস টোনোফাহ টেস্ট রেঞ্জে এ পরীক্ষাটি চালানো হয়।
আগামীতে এফ-৩৫ বিমানের যে নয়া সংস্করণটি আসতে যাচ্ছে, তাতে নতুন অনেকগুলো প্রযুক্তি ও সুবিধা সংযোজন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব সংযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এফ-থার্টি ফাইভের পারদর্শিতা বৃদ্ধি করা। এরই অংশ হিসেবে নতুন এ যুদ্ধবিমানগুলোতে বি-সিক্সটিওয়ান মোড টুয়েলভ নিউক্লিয়ার গ্রাভিটি বোমাও যুক্ত করা হবে।
পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারলে ফ্রন্টলাইনে এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমানগুলোর সমর দক্ষতা ও পারদর্শিতা বেড়ে যাবে। এফ থার্টি ফাইভ এমনিতেও একটি সমাদৃত বিমান। স্টেলথ প্রযুক্তির কারণে শত্রুপক্ষের সীমানায় কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই বিমানটি প্রবেশ করতে পারে। আর এর সংগে পারমাণবিক বোমা বহন করার মতো সুযোগ থাকলে প্রতিপক্ষের জন্য তা রীতিমতো আতংকের কারণ হয়ে উঠবে।
ফাইটার জেট বিমানের পর এখনো পৃথিবীতে সবচেয়ে আকাঙ্খিত বিমানটাই হলো এফ থার্টি ফাইভ বিমান। সিংগেল সিট, সিংগেল ইঞ্জিন এবং শীত গ্রীষ্ম বর্ষাসহ সব ধরনের আবহাওয়ায় কর্মক্ষম এই এফ থার্টি ফাইভ বিমানটি বর্তমানে ৯টি দেশ ব্যবহার করছে। এ বিমানের ওপর ভর করে এ দেশগুলোর আকাশপথের আধিপত্যও অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি আকাশ থেকে শত্রু সীমানায় আক্রমন চালানোর সুযোগও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এফ সিরিজের প্রথম যে বিমানটি নির্মিত হয়েছিল তা ছিল এফ-টুয়েন্টি টু র্যাপটর। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এর উন্নতি হয়েছে। আর বর্তমানে বিমানের যে সংস্করনটি সক্রিয় রয়েছে, তা খুব ভালোভাবেই ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। পাশাপাশি নজরদারি এবং একের পর এক আক্রমন পরিচালনায়ও এ বিমানের জুড়ি মেলা ভার।
এফ সিরিজের বিমান আবিস্কারের পর থেকে একটানা ২০ বছর একই নকশায় বিমানগুলো চলেছে। এখন বিমানটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিমানটিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করছে। লকহিড এমন সব সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করতে চাইছে যাতে এ বিমানটি দিয়েই আগামীতে আরো এক থেকে দুই দশক সেবা পাওয়া সম্ভব হয়। এরই অংশ হিসেবে বর্তমানে এফ থার্টি ফাইভ বিমানের ব্লক ফোর আপগ্রেডেশন চলছে। আপগ্রেডের অংশ হিসেবে নতুন নতুন বেশ কিছু অস্ত্র প্রযুক্তিকে যুক্ত করার কথা রয়েছে। এ অস্ত্রগুলো যুক্ত হলে শুধু আকাশপথে নয়, বরং নৌ পথেও এ বিমানের উপকারিতা পাওয়া যাবে। এছাড়া আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে আকাশে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের পারদর্শিতা বেড়ে যাবে।
নতুন যেসব অস্ত্র প্রযুক্তি এফ থার্টি ফাইভে সংযোজন করার কথা রয়েছে তার মধ্যে আছে জিবিইউ-ফিফটি ফোর - বি স্ট্রোম ব্রেকার, যা স্মল ডায়ামিটার বোমার দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবেও পরিচিত। স্ট্রোমবেকারের ওজন প্রায় ২০৮ পাউন্ড এবং মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিওন এটি নির্মান করেছে। বর্তমানে এফ থার্টি ফাইভে জিবিইউ-থার্টি নাইন এসডিবি সংযুক্ত রয়েছে। এবার এর চেয়েও উন্নত সংস্করনের স্ট্রোমব্রেকারটি যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
স্ট্রোমব্রেকারগুলোর ডায়ামিটার মাত্র ৬-৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। সেই হিসেবে এফ থার্টি ফাইভের আভ্যন্তরিন উইপন বেতে ৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের বোমা বহন করা সম্ভব হয়। এই স্ট্রোম ব্রেকার ছাড়াও ব্লক ফোর আপগ্রেডেশনের আওতায় এফ থার্টি ফাইভে প্রথমবারের মতো এজিএম-ওয়ান ফাইভ ফোর জেএসজিরোডব্লিউ-সি ওয়ান ধরনের হাজার পাউন্ড ওজনের বিশাল গ্লাইড বোমা যুক্ত করা হবে। মূলত একটি ডাটা লিংক এবং ইনফ্রাড সিকারের মাধ্যমে এ বোমাটি সংযুক্ত হবে। আরো থাকবে টার্মিনাল গাইডেন্স- শত্রুপক্ষের নৌ সীমানায় প্রবেশ এবং শত্রুদের অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য এ গাইডেন্সের দরকার পড়বে। ৭০ মাইল দূর থেকেই নতুন সংস্করনের এফ থার্টি ফাইভগুলো শত্রুপক্ষের টার্গেটকে সনাক্ত করতে সক্ষম হবে।
ব্লক ফোর আপগ্রেডের অংশ হিসেবে যে অস্ত্রগুলো নতুন করে যোগ করার কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে বি-সিক্সটিওয়ান মোড টুয়েলভ নিউক্লিয়ার গ্রাভিটি বোমাই সবচেয়ে ভয়ংকর। এ বোমাটি হলো বি-সিক্সটি ওয়ানের উন্নত সংস্করণ। নতুন প্রযুক্তির এ বোমায় টেইল ফিনস থাকবে যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিপিএস এর সাথে সমন্বয় করে যে কোনো টার্গেটের ওপর আক্রমন করতে পারবে। এ বোমাটিতে শূন্য ৩ দশমিক থেকে ৫ কিলোটন ওজনের একটি পরিসীমা থাকে এবং এটি যে কোনো বাংকারের ভেতরে গিয়েও আঘাত হানতে পারে।
নতুন এ বোমায় টার্গেট সনাক্তকরণে যথার্থতা এবং অনু প্রবেশের যৌথ ক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় এটি প্রতিপক্ষের ঘুম হারাম করে দিতে সক্ষম। শত্রুপক্ষের নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রনক্ষমতা এবং মিসাইল নিক্ষেপস্থলকে নিমিষেই এ বোমা ধ্বংস করে দিতে পারে। ন্যাটো চুক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী, মার্কিন বি-সিক্সটি ওয়ান পারমাণবিক বোমাগুলোকে এফ থার্টি ফাইভ বিমান ন্যাটোর অন্যান্য দেশের জন্যেও মোতায়েন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এই পারমাণবিক বোমাটি ছাড়াও ব্লক ফোর আপগ্রেডের আওতায় নতুন প্রযুক্তিগুলোকে এমনভাবে সংযোজন করা হবে যাতে এফ থার্টি ফাইভ দিয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। বিমানগুলোকে উন্নত করে এর সক্ষমতাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ৬ষ্ঠ প্রজন্মের বিমানকে চালু করা পর্যন্ত তা সার্ভিস দিতে সক্ষম হয় আবার একইসঙ্গে বি-টোয়েন্টি ওয়ান রেইডারের মতো স্টেলথ ড্রোন হিসেবেও কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
নতুন সংস্করনে স্টেলথ ফাইটারগুলোর সাথে দ্রুতগতির কম্পিউটার, অধিক সংখ্যক মিসাইল, প্যানোরামিক ককপিট ডিসপ্লে, দূর পাল্লার মিসাইল এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পন্ন উইংমেন ব্যবহার করা হবে। এ প্রযুক্তি সংযুক্ত হলে বিমানের পাইলট মিশন চলাকালে তাদের চারিপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন থাকতে পারবে। সেই সাথে তারা বিভিন্ন উৎস থেকে ডাটা সংগ্রহ করতে পারবে এবং সেই আলোকে শত্রুদের বিরুদ্ধে সঠিক আক্রমন কৌশল প্রনয়ন করতে পারবে।
নতুন যে কম্পিউটারগুলো সংযুক্ত করা হচ্ছে তা ব্যবহার করে এফ থার্টি ফাইভ বিমানগুলো ডাটা সংগ্রহ, গোছানো, বিশ্লেষন এবং প্রদর্শন করতে পারবে এবং পাইলটও একটি স্ক্রীনেই এসব সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দেখতে পারবেন।
ব্লক ফোরের মাধ্যমে এ যুদ্ধবিমানগুলো অল ডোমেইন কমান্ড এবং কন্ট্রোল তথা জেএডিসিটু অর্জনের পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। আর তেমনটা হলে যুদ্ধবিমানের তথ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কৌশলের ওপর গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে।
জেএডিসিটু মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটি তাত্ত্বিক ধারণা এবং এর লক্ষ্য হলো সামরিক বাহিনীর সকল শাখা অর্থাৎ বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী, মেরিন কর্পস, নৌ বাহিনী এবং স্পেস ফোর্সের সেন্সরগুলোকে একক একটি নেটওয়ার্কের আওতায় সংযুক্ত করা। জেএডিসিটু প্রযুক্তির নতুন সব চিন্তা ধারাগুলো সেনা বাহিনীর সেবার মানকে বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করেছে। ফলে সেনাবাহিনী এফ থার্টি ফাইভের সফটওয়ারগুলোকে উন্নত করাকে অগ্রাধিকার দিতে পেরেছে।
এফথার্টি ফাইভ বিমানগুলো বি সিক্সটি ওয়ান-টুয়েলভ পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মতো একটি পরীক্ষা চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশ পেয়েছে। নভেম্বরে এ পরীক্ষাটি চালানোর পর এফ থার্টি ফাইভের জয়েন্ট প্রোগ্রাম অফিস এরকম প্রায় এক ডজন ছবি প্রকাশ করেছিল। ছবিগুলোতে দেখা যায়, মার্কিন বিমান বাহিনীর স্টেলথ প্রযুক্তির এ বিমানটি বি সিক্সটি ওয়ান-টুয়েলভ থার্মোনিউক্লিয়ার গ্রাভিটি বোমা মোতায়েনের বিষয়ে একটি পরীক্ষা চালিয়েছিল। এভাবে সর্বোচ্চ ৫০ কিলোটন বিস্ফোরক বহন করা যাবে আর এফ থার্টি ফাইভের ভেতরে যে বোম্ব বে আছে, তার আকৃতির তুলনায় এ পরিমাণ একেবারেই সামান্য।
২০১৯ সালের জুনে প্রথমবারের মতো এ পরীক্ষা চালানো হয় ক্যালিফোর্নিয়ার এডওয়ার্ড এয়ার ফোর্সে । এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রমান হয়েছে এফ থার্টি ফাইভের উইপন বেতে পারমাণবিক বোমা বহন করা সক্ষম। এফ থার্টি ফাইভ নির্দিষ্ট গন্তব্যে এ বোমাকে বহন করে নিয়ে যেতে পারবে। সারা বিশ্বে যেখানে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরনের চেষ্টা চলছে। ইরান ও তুরস্কের মতো দেশগুলোকে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক প্রকল্প থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে সেখানে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলোতে পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত প্রযুক্তি সংযোজন সবাইকে বিস্মিত করেছে।