পাকিস্তান-তুরস্ক সামরিক মহড়া ও নৌ-সহযোগিতা


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:২৭

পাকিস্তান ও তুরস্ক ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে কমান্ডো ও স্পেশাল ফোর্সের সেনাদেরকে দিয়ে একটি যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলের তেরবেলা নামের এলাকায় দুই সপ্তাহের এ মহড়াটি হচ্ছে। এ মহড়ার নাম দেয়া হয়েছে ‘আতাতুর্ক এক্সারসাইজ ২০২১’। তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এবারের এই মহড়ার উদ্দেশ্য হলো দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আন্তঃসর্ম্পক বাড়ানো।

তুরস্কের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান তার্কিশ জেনারেল স্টাফের সেনারাও এই ওয়ার ড্রিলে অংশ নিচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট কমান্ডো ও স্পেশাল ফোর্সের সৈন্যদের এ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পাকিস্তান ও তুরস্ক আগে থেকেই দ্বিপাক্ষিক নানা ইস্যুতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক কার্যক্রম ও সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। পাশাপাশি, আঞ্চলিক বিভিন্ন সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতেও দুই দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করে। গ্রিসকে মোকাবিলায় এবং নাগরনো-কারাবাখের যুদ্ধকালীন আজারবাইজানের পৃষ্ঠপোষকতায় তুরস্ককে নৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন দিয়েছে পাকিস্তান। অপরদিকে কাশ্মীরসহ আঞ্চলিক নানা সংকটেও তুরস্ক বরাবরই পাকিস্তানের পাশে থেকেছে।

সামরিক সহযোগিতার দিক থেকে আঙ্কারার প্রতি ইসলামাবাদের সমর্থন বেশ দৃশ্যমান হয় যখন পাকিস্তানি ফ্রিগেট আলমগীর এবং আরও বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সর্বশেষ মহড়ায় অংশ নেয়। পাকিস্তান যখন এ মহড়ায় অংশ নেয়, তখন তুরস্কের সাথে এথেন্সের উত্তেজনা চলছিল।

তুরস্ক ও পাকিস্তান- দুটোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং সামরিক খাতে যেভাবে এ দুটি দেশ ঘনিষ্ঠ ও পারস্পরিক নির্ভর শীল হয়ে উঠছে তা বিশ্ব রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

দুই দেশের মধ্যকার এ সম্পর্কের বিষয়ে পাকিস্তানের বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মুজাহিদ আনওয়ার খান সম্প্রতি আনাদুলু এজেন্সিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, তুরস্কের সাথে সম্পর্কটি ব্যতিক্রম এবং খুবই আন্তরিক। শুধু পাকিস্তানই তুরস্ককে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করে তাই নয়। বরং বিশ্ববাসীও এখন তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ককে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক হিসেবেই বিবেচনা করে।

মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একটি গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা নাগরনো-কারাবাখের যুদ্ধে সরাসরি আর্মেনিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পরই পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্য সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আসে। এ গবেষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান এই খবরের সত্যতাকে পরবর্তীতে অস্বীকার করেছিল। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান রাশিয়ার গনমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে স্পষ্ট করেই দাবি করেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা কারাবাখের যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল।

পাকিস্তান বহু বছর আগে থেকেই পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্র। বর্তমানে তুরস্কও পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য নানা কারণে পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করতে চাইছে। আর এ কারণেই তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তান ক্রমশই গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে। যদিও পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার বিষয়ে এরদোয়ানের অভিপ্রায় খুব সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বহু আগে থেকেই বিমান খাত, অস্ত্র প্রযুক্তি বিনিময় এবং যৌথ মহড়া আয়োজনের মতো বিষয়ে তুরস্ক ও পাকিস্তান একসাথে কাজ করে আসছে।

পাকিস্তান বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নেয়ার কারণে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে চীন বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরব থেকে নেয়া একটি বড়ো অংকের ঋন পরিশোধ করে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে। অন্যদিকে, চীন ও তুরস্ক মিত্রদেশ হিসেবে বরাবরই পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা খাতকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর চাপ অব্যহত রেখেছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্যেও মধ্য প্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ পাকিস্তানকে রীতিমতো কোনঠাসা করে রাখারও চেষ্টা করেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে চীন সম্প্রতি সাংহাইতে পাকিস্তানের জন্য নির্মিত দ্বিতীয় যুদ্ধজাহাজটির উদ্বোধন করেছে। চীনের এ যুদ্ধজাহাজটি হলো জিরো ফাইভ ফোর ধরনের একটি যুদ্ধজাহাজ। এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় হুডোং-ঝোংহুয়া শিপইয়ার্ডে। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা দাবি করেন নতুন এ যুদ্ধজাহাজটি তাদের বহরে সংযুক্ত হলে পাকিস্তানের নৌ ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং শত্রুকে মোকাবেলার করার সক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যাবে।

জিরো ফাইভ ফোর ধরনের প্রথম যুদ্ধজাহাজটি গত বছরের আগষ্টে উদ্বোধন করে পাকিস্তানের হাতে হস্তান্তর করা হয়। নির্মিত দ্বিতীয় যুদ্ধজাহাজটি আগেরটার তুলনায় আরো অত্যাধুনিক ও বাড়তি কিছু সুবিধাযুক্ত। এই জাহাজে সারফেইস, সাব-সারফেইস, এন্ডি ওয়ার উইপন, যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি এবং সেন্সরের মান উন্নত করা হয়েছে। নতুন এ যুদ্ধজাহাজটি পাওয়ায় পাকিস্তান নৌ বাহিনীর সমর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

ইস্তানবুলের নাভাল শিপইয়াডে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্য একটি করভেট নির্মানের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। গত মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইস্তানবুলের নেভাল শিপইয়াডে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্য একটি মিলজেম ধরনের করভেট নির্মানের কাজ উদ্বোধন করেন। তুরস্কের সাথে চুক্তির আওতায় ইস্তানবুলের শিপইয়ার্ডে দুটো করভেট নির্মাণ করবে পরবর্তীতে করাচির শিপইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে আরো দুটি করভেট নির্মানে সহযোগিতা করবে। এরদোয়ান এ অনুষ্ঠানে দুদেশের কৌশলগত সর্ম্পকের ওপর গুরুত্ব দেন। মিলজেম কর্ভেট নির্মান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দু দেশের সামরিক খাতে সহযোগিতা আরো গতিশীল হবে বলে দাবি করেন।

মিলজেম কর্ভেটগুলো খুবই কার্যকরী এতে সামগ্রিক কমব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম একটি নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। পাকিস্তানি নৌ বাহিনী এ কর্ভেট পাওয়াকে বড়ো আকারের অর্জন হিসেবে দেখছে। পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারা বিগত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার আংকারা ও বেইজিং সফর করেছেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এবং ব্যবসায়িক জাহাজগুলোকে এখন নিয়মিতভাবে আংকারায় নোঙ্গর করতে দেখা যায়।

গত অক্টোবরে পাকিস্তানের নৌ বাহিনী তুরস্কের গোলকুক নৌ ঘাটিতে তুরস্কের ফ্লিটগুলোর সদর দফতর পরিদর্শন করেন। একইসঙ্গে তিনি ইস্তানবুলের নেভাল শিপইয়ার্ডও পরিদর্শন করেন। রোমানিয়ার কন্সটান্টায় অবস্থিত ব্ল্যাব সি পোর্টে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্য নির্মিত আরেকটি করভেট গত নভেম্বরে উদ্বোধন হওয়ার পর তুরস্কের আকসাজ বন্দরেও লম্বা সময় অবস্থান করে। নতুন এ করভেটটি ডামেনর ওপিভি নাইন্টিন হান্ড্রেড মডেলের যার নামকরণ করা হয়েছে পিএনএস তাবুক। তুরস্ক হয়ে পাকিস্তানে আসার পথে এ করভেটটি তুরস্কের নৌ বাহিনীর সাথে যৌথভাবে একটি মহড়া ও টহল অভিযানেও অংশ নেয়।

২০২০ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানি নৌ জাহাজ জুলফিকার বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টারসহ তুরস্কের আকসাজ পোর্ট পরিদর্শন করে এবং তুরস্কের নেতৃত্বে বহুজাতিক এন্টি সাবমেরিন মহড়ায় অংশ নেয়। বন্দরে থাকাকালে দুই দেশের কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠকেও মিলিত হন। পাকিস্তানের আরেকটি নৌ যুদ্ধজাহাজ ইয়ারমুক, রোমানিয়ার কন্সটান্টা পোর্টে কমিশন হওয়ার পর তুরস্কের গোলকুক নৌ ঘাটিতে যায় এবং তুরস্ক নৌ বাহিনীর সাথে বেশ কিছু কার্যক্রমেও অংশ নেয়।

শুধু তুরস্ক নয়, চীনও পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোর সহায়তা করে আসছে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকদফায় যৌথ নৌ মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর এসব অগ্রগতির খবরে প্রতিবেশী দেশ ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। গত বছরের শেষ দিকে, ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউয়ে ভারতের নৌ বাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং প্রকল্প পরিচালক কমোডোর রঞ্জিত বি রয় লিখেন, পাকিস্তানের নৌ বাহিনী ক্রমাগতভাবে এর নৌ কাঠামোকে শক্তিশালী করে যাচ্ছে। গোয়াদার থেকে বেশ কয়েকটি বাহিনীও কাজ করছে। গোয়াদারে নিজেদের স্বার্থে চীনও বড়ো আকারের বিনিয়োগ করছে।

মার্কিনীদের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে চীনের সহায়তায় পাকিস্তান যেন ২০২৩ সালের মধ্যে একটি ব্রিগেড আকৃতির নৌ সার্ভিস গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সে লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশই এখন কাজ করছে। একইসঙ্গে, পাকিস্তানে চীন একটি নেটওয়ার্ক নির্ভর এবং সামরিকভাবে সক্ষম স্যাটেলাইট ফিড নির্মানেও সাহায্য করছে। যার ওপর ভর করে ভারত মহাসাগরের ওপর পাকিস্তান ও চীনের নজরদারিমূলক তৎপরতা আরো সংহত হবে। মার্কিন নৌ বাহিনী ভারতের নৌ বাহিনীকে যেভাবে সাহায্য করছে, চীনা নৌ বাহিনীও পাকিস্তানের সাথে একই ধরনের কাজ করছে বলেও কমোডর রঞ্জিত রয় মন্তব্য করেন।