প্রধান যুদ্ধাস্ত্র হতে যাচ্ছে মানববিহীন ড্রোন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৪:৫৭

২০২০ সালের নভেম্বরে শেষ হওয়া নাগরনো-কারাবাখের যুদ্ধে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া মিসাইল, ড্রোন ও রকেট আর্টিলারি ব্যবহার করে। ৪৪ দিন ধরে চলা এ যুদ্ধে রাশিয়ান, তুর্কি, ইসরাইলি ও অজানা সূত্র থেকে পাওয়া আরো কিছু ড্রোন ব্যবহার হয়। এ ড্রোনগুলোর ওপর ভর করে উভয় বাহিনী তাদের প্রচলিত আর্টিলারি ও আক্রমণ মিশনগুলো পরিচালনা করে। যুদ্ধে আজারবাইজান জয়ী হয়, কিন্তু তার খুঁটির মূল জোর ছিল তুরস্কের সরবরাহ করা মানববিহীন ড্রোন। আর তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে ড্রোনের কদর হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।

মানববিহীন আকাশযান বা ইউএভি দিয়ে হামলা চালিয়ে ভারী গ্রাউন্ড ইউনিট বিশেষ করে টি-সেভেন্টি টু ট্যাংক এবং অ্যাডভান্সড এস-থ্রি হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করে দেওয়া যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে একটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের নিরাপত্তা সেক্টরের শীর্ষ নীতি নির্ধারক মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানীকে হত্যা করে। সোলাইমানী তখন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আব্দুল মাহদির সাথে সাক্ষাত করার জন্য বাগদাদে যাচ্ছিলেন।

সোলাইমানী ছিলেন ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার। কুদস ফোর্স হলো ইরানের ইসলামিক রিভোলিউশনারি গার্ড কারোর ৫টি শাখার মধ্যে একটি শাখা। কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে সোলাইমানীকে বরাবরই ইরানের দ্বিতীয় শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। তিনি সরাসরি ইরানের শীর্ষস্থানীয় আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামনেয়ীর আদেশে কাজ করতেন। এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ড্রোন ব্যবহার করেই সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরামকো তেল স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। সৌদি আরবের পূবাঞ্চলীয় শহর আবকাইক এবং খুরাইসে থাকা তেল স্থাপনাগুলো এ যাত্রায় হামলার শিকার হয়। ইয়েমেনের হুথিরা এ হামলাগুলোর দায় স্বীকার করে। এর বাইরে ২০০৪ থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালিবান ও টার্গেট ব্যক্তিদেরকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্যবার ড্রোন হামলা পরিচালনা করে।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েক ধরনের ইউএভিকে বিভিন্ন কমব্যাট অপারেশনে ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে অপারেশন ডেজার্ট স্টোর্মে ইউএভির প্রয়োগ ও কার্যকারিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সে সময়ে যেসব ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে দ্য পাইওনিয়ার, দ্য পয়েন্টার, দ্য হান্টার, দ্য প্রিডেটর, দ্য গ্লোবাল হক, দ্য ড্রাগন আই, দ্য ডেজার্ট হক এবং দ্য শ্যাডো। কমব্যাট অপারেশনে ইউএভিগুলো হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার, পরিদর্শন, টার্গেট সনাক্ত ও হামলা এবং আকাশ থেকে ভূমিতে হামলার মতো গুরুত্বপূর্ন কাজগুলো করে থাকে।

মানবচালিত বিমানে পাওয়া যায় না- এমন কিছু বাড়তি সুবিধাও ইউএভি থেকে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো, ড্রোন অপারেশনে মানুষের জীবনের কোনো ঝুঁকি থাকে না। কেননা, ড্রোন অপারেশনে মানুষের অংশগ্রহনই থাকে না। পাশাপাশি, অপারেশনের খরচও বেশ কমে যায়। তাছাড়া ড্রোন অপারেশনে রিয়েল টাইম সেন্সর ফ্লো সবসময় জারি থাকে যার ফলে সেন্সর থেকে শুটার সময়ের ব্যবধানও কমিয়ে নিয়ে আসে। যে জায়গায় অন্য কোনো বিমান দিয়ে পৌঁছানো যায় না অথবা যেসব স্থানে ঝুঁকি বেশি সেখানে ড্রোন ব্যবহারে খুবই ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়।

ড্রোন ব্যবহারে বহুমুখি সুবিধার কারণে একদিকে বিভিন্ন দেশে যেমন এর সংখ্যা বাড়ছে ঠিক তেমনি আগের তুলনায় বর্তমান সময়ের ইউএভিগুলোতে নতুন নতুন অনেক ফিচার ও প্রযুক্তিও সংযোজন করা হচ্ছে।

শুধুমাত্র পরিদর্শন, নিরাপত্তা আর প্রতিপক্ষের স্থাপনা নির্নয় ও সনাক্ত করার মাঝেই এখন মানববিহীন বিমানগুলো আর সীমিত নেই। বরং এখন মানববিহীন এরিয়াল সিস্টেম তথা ইউএএস দিয়ে ভারী অনেক কার্যক্রমও পরিচালনা করা হচ্ছে। ওজনদার কার্গো বহন করার মত কঠিন কাজও এখন মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই শুধুমাত্র প্রযুক্তি দিয়েই সম্পাদন করা হচ্ছে।

কয়েক বছর আগেও জেএসএফ এফ-থার্টি ফাইভ লাইটনিং ছিল মানবচালিত বোমারু বিমান যা দিয়ে বোমা বর্ষন করা যেতো। আর এখন মানববিহীন সিস্টেম দিয়ে অহরহ বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। শুধু ইঞ্জিন দিয়েই নয়, বরং সৌরশক্তি দিয়েও এখন ইউএভিগুলোর অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।

বর্তমানে সৌরশক্তি পরিচালিত এয়ারবাস জেফির দিয়ে ইউএভির অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। এ ধরনের ইউএভিগুলো সর্বোচ্চ ২৫দিন আকাশে ভাসতে পারে। আবার এমন ড্রোনও আছে, যা মানববিহীন প্রযুক্তির মাধ্যমে আবার মানুষ দিয়েও পরিচালিত হতে পারে। মার্কিন বিমান বাহিনী এফ- ফোর এবং এফ-সিক্সটিনকেও এমনভাবে পুননির্মাণ করেছে যাতে এ বিমানগুলোকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করা যায়।

দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়ানরা মানববিহীন মিগ-টোয়িন্ট ওয়ান এসকে টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ফ্রান্সে ড্যাসোল্ট কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় মিরেজ টু থাউসেন্ডের আকৃতির ডেল্টা উইং ইউসিএভি নিউরন তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ভবিষ্যতের জন্য যে মানববিহীন প্রকল্প পরিচালনা করছে তার নাম দেয়া হয়েছে তারানিস।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো ইউএভি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিশন সম্পন্ন করছে, এমনকী উড়ন্ত অবস্থাতে এগুলোতে তেল ভরারও ব্যবস্থা থাকে। লকহিড মার্টিন সি ঘস্ট নামের একটি প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে যার আওতায় মার্কিন নৌ বাহিনীর মানববিহীন ড্রোনের চাহিদা পূরণ হবে। মার্কিন নৌ বাহিনী দীর্ঘদিন থেকেই নজরদারি ও হামলা পরিচালনার জন্য মানববিহীন ড্রোন খুঁজে বেড়াচ্ছে। নৌ বাহিনী এমন ড্রোন চাইছে যাতে ফ্লাইং উইং ডিজাইন থাকবে এবং স্টেলথ প্রযুক্তি থাকবে।

মার্কিনীদের হাতে নতুন বোমারু ড্রোনেরও প্রস্তাবনা রয়েছে। নর্র্থপ গ্রুম্যান বি-টোয়েন্টিওয়ান রেইডার নামক যে বোমারু গুলো তৈরি করছে তাতে বিকল্প অপশন হিসেবে মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ারও সুযোগ থাকছে। এছাড়া এমন কিছু মানববিহীন হেলিকপ্টারও তৈরি করা হচ্ছে যা দূরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত সেনাদের কাছে অস্ত্রও পৌঁছে দিতে পারবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা করেছে যে আগামী তিন দশকের মধ্যে তারা সবগুলো ফ্লাইটই মানববিহীন উপায়ে পরিচালনা করবে।

বর্তমানে ড্রোন পরিচালনা প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর প্রয়োগ শুরু হওয়ায় গুচ্ছ ড্রোন উ্ড্ডয়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা যাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত অনেকগুলো ড্রোনই যুদ্ধবিমানের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার এমনও ড্রোন আছে যা বড়ো কোনো শিপ এয়ারক্রাফট থেকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

আবার ড্রোন প্রতিরোধে নিত্য নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়াই অন্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে আছে। ইসরাইলও বেশ ভালো সফলতা দেখিয়েছে। আবার এমনও তথ্য আছে যে সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী সরকারগুলো নিজেদের স্বার্থে ড্রোনের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে।

চীন এরইমধ্যে আগ্রাসী গতিতে ইউসিএভি ড্রোনের ডিজাইন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। চীনের শেনইয়াং এর ডার্ক সোর্ড হলো স্টেলথ প্রযুক্তির বোয়িং এক্স ফোর্টি ফাইভ। এর বাইরে পাকিস্তান চীনের ইউসিএভির ডিজাইনের আদলে বুরাক তৈরি করেছে। এর আগে ২০১৩ সালেও পাকিস্তান নজরদারি ও টহল দেয়ার জন্য শাপার নামে আরেকটি ড্রোন উদ্ভাবন করেছিল। যেভাবে অনেক দেশ ড্রোন নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে আগামীর সময়টি মানববিহীন প্রযুক্তির এবং এক্ষেত্রে মানববিহীন এরিয়াল সিস্টেমের সমকক্ষ কোনো প্রযুক্তি আর দেখা যাচ্ছে না।

ড্রোনের জনপ্রিয়তা এবং ড্রোনের ওপর নির্ভরশীলতার বড়ো কারণ হলো প্রচলিত কোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিয়েই ড্রোনকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় বা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান বা রাশিয়ান- কারো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমই এক্ষেত্রে খুব সফলতা পায়নি। মার্কিন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম প্যাট্রিয়টের দুর্বলতা এবং রাশিয়ার এস-থ্রি হান্ড্রেড এবং পান্টসির সিস্টেমের একাধিকবার ব্যর্থতা প্রমান করেছে। মানববিহীন উৎকর্ষতার এ সময়ে এই এয়ার সিস্টেমগুলোর নতুন সংস্করণ নিয়ে আসতে হবে।

ইউএভিকে সনাক্ত এবং ছোট আকৃতির মিসাইলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার জন্য যে উচ্চমানের রাডার দরকার তার এখন অনেকটাই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই যদি সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে হয় এবং সামরিক স্থাপনা ও যুদ্ধাস্ত্রগুলোকে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে এ জাতীয় উচ্চ ডেফিনিশনের রাডারের কোনো বিকল্প নেই। রাডারের রেইঞ্জ বাড়ানোর জন্য নিত্য নতুন প্রযুক্তিও সংযোজন করতে হবে। ড্রোনগুলোকে আগে নিয়ন্ত্রন করা হতো জ্যামিং সৃষ্টি করার মাধ্যমে। কিন্তু ইদানিংকালে স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের প্রাচুর্যতা বাড়ায় জ্যামের কার্যকারিতাও কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। তাই শুধুমাত্র রেডিও জ্যাম করে ড্রোন প্রতিরোধে সফল হওয়া যাবে না।

অবশ্য ড্রোনেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যতদিন না পর্যন্ত ড্রোনে নির্ভুল গাইডেন্স সিস্টেম যুক্ত করা না হবে ততদিন পর্যন্ত ড্রোনকে জিপিএস এর ওপরই নির্ভর করতে হবে। নিকট ভবিষ্যতে জিপিএসে জ্যাম তৈরি করে অথবা ভুলেভরা প্যারামিটার প্রদর্শন করেও ড্রোনকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করা হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

সিরিয়ায় স্থাপিত রাশিয়ার খেমেইমিম ঘাটিতে পান্টসির ও এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার সিস্টেম থাকার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। রাশিয়ানরা ক্রাশুখা জ্যামিং সিস্টেমও চালু করেছিল। এসব কিছু দিয়ে তুর্কী ড্রোন বেরাকতার ও ইসরাইলের ড্রোনগুলোকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিছুক্ষেত্রে বেশ ভালো ফল পাওয়া গেলেও অনেকক্ষেত্রে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও জ্যামিং দুটোই ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী সময়ের যুদ্ধে মানববিহীন ড্রোনটাই পরাশক্তিগুলোর কাছে সবচেয়ে আস্থাভাজন হয়ে উঠবে।