বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে পারমাণবিক হামলা চালাতে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম। নিজের ভূখণ্ড থেকেই এই মিসাইলের সাহায্যে হামলা করা যায় বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। এটি এমন এক অস্ত্র, যা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের পক্ষেও প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব।
সবচেয়ে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইলকে বলা হয় আইসিবিএম বা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল। আন্তঃ মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর পাল্লা হয় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি। এর সর্বোচ্চ পাল্লার কোনো সীমারেখা নেই। নিজেদের প্রয়োজন ও সামর্থ অনুযায়ী এর পাল্লা তৈরি করে নির্মাতারা। মূলত বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে আঘাত হানার লক্ষ্যেই আইসিবিএম তৈরি করা হয়। শত্রুর অবস্থান যত দূরেই হোক, সেখানে পারমাণবিক বোমা ফেলতে এই মিসাইল সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার। যে কারণে উত্তর কোরিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আঘাত হানার হুমকি দিতে পারে।
রাশিয়ার আরএস-টুয়েন্টি এইট সরমাট আইসিবিএম ২৫ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারে। এই মিসাইলটি ২৪টি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে।এবং প্রতিটি ওয়ারহেড কয়েকশো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছড়ে পড়তে পারে ভূমিতে। তবে এই মিসাইলটি এখনো ডেভলপমেন্টের পর্যায়ে রয়েছে। ২০২১ সালে এই সরমাটকে সার্ভিসে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়ার। তাই শুধুমাত্র এই মূহুর্তে সার্ভিসে রয়েছে এমন সেরা ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলোকে নিয়ে আমাদের এই ভিডিও।
যুক্তরাষ্ট্রর ও ব্রিটেনের কাছে আছে ট্রাইডেন্ট টু আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম। ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক লকহিড মার্টিন স্পেস কর্পোরেশনের তৈরি মিসাইলটি সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণ যোগ্য। এর সর্বোচ্চ পাল্লা ১২ হাজার কিলোমিটার। পুরো নাম ইউএমজি-ওয়ান ডাবল থ্রি ট্রাইডেন্ট টু। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রগুলোর একটি এই ব্যালেস্টিক মিসাইল। ১৯৯০ সালে এটি প্রথম মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র।একই বছর এটি দেয়া হয়েছে ইউরোপের তাদের প্রধান মিত্র ব্রিটেনকেও।
মার্কিন নেভি ও ব্রিটিশ রয়াল নেভির সাবমেরিনগুলো ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্র নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় সমুদ্রের তলদেশে। যুক্তরাষ্ট্র নৌ বাহিনীর ১৪টি ওহিও ক্লাস সাবমেরিনে মোতয়েন রয়েছে ট্রাইডেন্ট টু ব্যালেস্টিক মিসাইল। প্রতিটি সাবমেরিনে আছে এর ২৪টি করে। এছাড়া দুটি কলম্বিয়া ক্লাস সাবমেরিনেও এই মিসাইল যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। আর ব্রিটিশ নেভির ৪টি ভ্যানগার্ড ক্লাস সাবমেরিনে যুক্ত করা হয়েছে ট্রাইডেন্ট টু। তাদের প্রতিটি সাবমেরিনে আছে এর ১৬টি করে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেও সর্বশেষ এই মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০৪২ সাল পর্যন্ত একটি সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের।প্রতিটি ট্রাইডেন্ট টু মিসাইল বহন করতে পারে ১৪টি পারমাণবিক ওয়ারহেড। যার প্রতিটির ধ্বংস ক্ষমতা ৫৫ কিলোটন টিএনটি’র সমতুল্য।
বেশ কয়েক দফা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর অবশ্য এর ওয়ারহেড সংখ্যা কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পূর্ণ লোড অবস্থায় এই মিসাইলের পাল্লা কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এটি ট্রাইডেন্ট টু মিসাইলের একটি নেতিবাচক দিক। এর প্রতিটির নির্মাণ খরচ প্রায় ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল রয়েছে যেটির নাম মিনিটম্যান থ্রি। ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ যোগ্য মিসাইলটির পাল্লা ১১ হাজার কিলোমিটার।১৯৭০ সালে এটি সার্ভিসে যুক্ত হয়।
খুব বেশি দিন হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের হুমকি দিতে শুরু করেছে উত্তর কোরিয়া। এমনকি তারা এটাও বলেছে যে, কোনো বাধা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে পারমাণবিক বোমা ফেলতে পারবে। আর কিম জং উনের দেশের এই সাহসের নেপথ্যে রয়েছে তাদের হাসং-ফিফটিন আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল।
দুই স্টেজের তরল জ¦ালানি ইঞ্জিনের মিসাইলটির কথা বিশ^বাসী জানতে পারে ২০১৭ সালে। ওই বছর ২৮ নভেম্বর এটির পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। দেশটি জানায়, মিসাইলটি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় উঠে ৯৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছে ৫৩ মিনিটে।
উত্তর কোরিয়ার আরো অনেক বিষয়ের মতো এই মারণাস্ত্রের বিষয়টিতেও অনেক কিছুইস্পষ্ট জানা যায় না। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের ধারণা হাসং-ফিফটিনের সর্বোচ্চ পাল্লা ১৩ হাজার কিলোমিটার। যার ফলে দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিছু জায়গা ছাড়া- এটি বিশ্বের সর্বত্র আঘাত হানতে পারবে। তবে এই মিসাইলটি- একটি নাকি একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে সেটি নিয়েও মতভেদ রয়েছে।
১৮ চাকার বিশাল এক ট্রাকের ওপর স্থাপিত মিসাইলটির রয়েছে স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমের সহায়তায় একটি ইন্টারনাল গাইডেন্স সিস্টেম। ৭৪ ফুট লম্বা ও প্রায় ৮ ফুট ব্যাসের হাসং-ফিফটিন ব্যালেস্টিক মিসাইলের এখন পর্যন্ত ৫৪টি ইউনিট তৈরি করেছে উত্তর কোরিয়া।
চীনের ডংফেং-ফোরটি ওয়ান বা সংক্ষেপে ডিএফ ফোরটি ওয়ানও ব্যালেস্টিক মিসাইল জগতের আরেক ভয়ঙ্কর নাম। চীনের তৈরি ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে দূর পাল্লার। ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এর পারমাণবিক ওয়ারহেডগুলো।
তিন স্টেজের রকেট ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি সলিড ফুয়েলের ডিএফ ফোরটি ওয়ান বিশ্বের ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্রগুলোর একটি। এই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রটির ম্যাক্সিমাম পে লোড আড়াই হাজার কেজি। এটি বহন করতে পারে ১০টি থার্মেনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। যেগুলোর ধ্বংস ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোটন পর্যন্ত। ওয়ারহেডগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা টার্গেটে আঘাত হানতে পারে। চীনের বেইডু ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমের সহায়তায় এই মিসাইলের রয়েছে একটি অভ্যন্তরীণ নেভিগেশন সিস্টেম।
১৬ চাকার একটি সামরিক ট্রাকেটর ওপর স্থাপিত ব্যালেস্টিক মিসাইলটির সবচেয়ে বড় সুবিধা এটি সুবিধামতো যে কোনো জায়গায় নিয়ে স্থাপন ও উৎক্ষেপণ করা যায়। একই কারণে ভূগর্ভস্থ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে শত্রুর পক্ষে এটিকে নিশানা করারও কঠিন।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির রকেট ইউনিটের নিয়ন্ত্রণে থাকা মিসাইলটি ২০১৭ সালে যুক্ত হয়েছে সার্ভিসে। তবে ২০১৯ সালের জাতীয় দিবসের প্যারেডে এটির কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে চীন। এটি তৈরি করেছে চায়না একাডেমি অব লঞ্চ ভেহিকেল টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ৬৯ ফুট লম্বা ও সাড়ে ৭ ফুট ব্যাসের মিসাইলটি ছুটতে পারে ঘণ্টায় ৩০ হাজার ৬২৬ কিলোমিটার গতিতে। আর যে কোনো টার্গেটের একশো মিটারের মধ্যে আঘাত হানতে পারে এর ওয়ারহেড।
এছাড়া চীনের একই সিরিজের আরেকটি মিসাইল রয়েছে যেটির নাম ডিএফ-ফাইভ এ। এই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লাও ১২ হাজার কিলোমিটারের বেশি। ভূগর্ভস্থ চেম্বার থেকে উৎক্ষেপণ যোগ্য মিসাইলটি দুই স্টেজের তরল জ¦ালানি ইঞ্জিন চালিত। এর তিনটি সংস্করণ রয়েছে, যেগুলো ১০টি পর্যন্ত ওয়ারহেড বহন করতে পারে।
বিভিন্ন দেশের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূর পাল্লার রাশিয়ার আর-থার্টি সিক্স এম। মূলত রাশিয়ার আর-থার্টি সিক্স সিরিজের একটি উন্নত সংস্করণ এই আর থার্টিসিক্স এম। ন্যাটো যার কোড নেম দিয়েছে শয়তান।
রাশিয়া ১৯৭৪ সালে প্রথম আর থার্টি-সিক্স ব্যালেস্টিক মিসাইল উদ্ভাবন করে। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্সে এর প্রথমটি মোতায়েন করা হয়। এই সিরিজের প্রতিটি মিসাইলই ব্যাপক ধ্বংস ক্ষমতা সম্পন্ন।
৮.৮ টন ওজনের আর-থার্টি সিক্স এম এই মূহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ভারী ব্যালেস্টিক মিসাইলও। এটির রেঞ্জ ১৬ হাজার কিলোমিটার। এটিরও অনেকগুলো সংস্করণ তৈরি করেছে রাশিয়া। মুড ওয়ান থেকে মুড সিক্স পর্যন্ত- এখন পর্যন্ত ছয়টি পৃথক সংস্করণ এসেছে এর। ১৯৭৫ সালে এর মুড ওয়ান প্রথম মোতায়েন করে মস্কো।
সর্বোচ্চ ১০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে এই মিসাইল। যার প্রত্যেকটির বিস্ফোরণ ক্ষমতা গড়ে ৫৫০ থেকে ৭৫০ কিলোটন টিএনটি’র সমতুল্য। অথবা ২০ মেগাটনের একটি ওয়ারহেডও ছোড়া যায় এর সাহায্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা নগরীতে যে বোমাটি ছুড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেটির মাত্রা ছিলো ১৩ কিলোটন। অর্থাৎ রাশিয়ার এই মারণাস্ত্রটির প্রতিটি ওয়ারহেড হিরোশিমাকে ধ্বংসকারী বোমার চেয়ে কয়েকশো গুণ ক্ষমতা সম্পন্ন। কাজেই এর ১০টি ওয়ারহেড কোনো দেশের ১০টি অঞ্চলে আঘাত হানলে কী ঘটতে পারে সেটি আর বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই। এজন্যই বলা হয় যে, ফ্রান্সের মতো একটি দেশ ধ্বংস করতে- এই মিসাইলের একটি হামলাই যথেষ্ট।
দুই স্টেজের রকেট ইঞ্জিন বিশিষ্ট মিসাইলটি তরল জ¦ালানিতে চলে, যার গতি সেকেন্ডে প্রায় ৮ কিলোমিটার। ভূমিতে স্থাপিত ৩৯ মিটার গভীর একটি চেম্বার থেকে ছোড়া হয় এই মিসাইল। এই মিসাইলটির কারণে রাশিয়াই এখন বিশ্বের সামরিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম।
প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিষয়ে অনেক স্পর্শকাতর তথ্য বেশির ভাগ সময়ই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো প্রকাশ করে না। যে কারণে এসব বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যের মাঝেও গড়মিল দেখা যায়। কাজেই ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্রগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য হয়তো চিরদিন অজানাই থেকে যাবে।