এশিয়ায় সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে মিয়ানমার। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন সেনাবাহিনীর হাতে। প্রতি বছর বাড়ছে সামরিক বাজেট। এরইমধ্যে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের অধিকারী হয়েছে দেশটি। মিয়ানমারের কাছে রয়েছে চীন, রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়ার তৈরি শক্তিশালী এয়ার টু এয়ার, সারফেস টু এয়ার মিসাইল। তাছাড়া দেশটি নিজে মাঝারি পাল্লার মিসাইল তৈরি করতেও সক্ষম। মিয়ানমারের কাছে রয়েছে চীন ও রাশিয়ার তৈরি শক্তিশালী যুদ্ধবিমান এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর তথ্য অনুসারে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে মিয়ানমারের অবস্থান ৩৮তম। মিয়ানমারের মোট সৈন্য সংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজার। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সৈন্য ৪ লাখ ৫ হাজার। প্যারা মিলিটারি ১ লাখ ১০ হাজার।
সেনা সংখ্যার দিক দিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনামের পর মিয়ানমারের অবস্থান। মিয়ানমারের কাছে চীন ও রাশিয়ার তৈরি শক্তিশালী যুদ্ধবিমান ছাড়াও বিপুল পরিমাণ মিসাইলের মজুদ রয়েছে । চীন, রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে পাওয়া মিসাইল ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কারণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে একটি বিপজ্জনক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমার আর্মি বিরামহীনভাবে বিভিন্ন রাজ্যে জাতিগত ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ মোকাবিলা করে আসছে। মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে রয়েছে রাখাইনসহ বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপকভিত্তিক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগ।
মিয়ানমার বিমান বাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ২৮৭টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৬০টি। সামরিক পরিবহন বিমান ২৭টি। প্রশিক্ষণ বিমান ৮৮টি। হেলিকপ্টার ৮৬টি।
মিয়ানমার বিমানবাহিনীতে রাশিয়ার তৈরি বহুমুখী মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান রয়েছে ৩১টি। এছাড়া রাশিয়ার শক্তিশালী ১২টি এসইউ-৩০ বিমান যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে পর্যায়ক্রমে। চীনের তৈরি ন্যানচ্যাং কিউ-৫ অ্যাটাক বিমান রয়েছে ২১টি। চেংদু জে-৭ ফাইটার রয়েছে ২১টি। চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জেএফ থান্ডার ফাইটার রয়েছে ৭টি। আরো ৯টি সংগ্রহের পথে রয়েছে। চীনা ভার্সন মিগ-১৯ রয়েছে ১টি। এ ছাড়া চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি শক্তিশালী চেংদু বিমান মিয়ানমার সংগ্রহ করছে মর্মে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। মিয়ানমারের কাছে রাশিয়ার তৈরি মিল এমআই, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ইউএইচ অ্যাটাক ও ইউটিলিটি হেলিকপ্টার রয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কয়েক হাজার মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ গড়ে তুলছে। মিয়ানমার আর্মির কাছে চীন ও উত্তর কোরিয়ার তৈরি বিপুল সংখ্যক ব্যালিস্টিক মিসাইল মজুদ রয়েছে। এসব মিসাইলের আওতা ৩শ থেকে ৭শ কিলোমিটার পর্যন্ত। দেশটির কছে কী পরিমান ব্যালেস্টিক মিসাইল রয়েছে সে তথ্য মিয়ানমার আর্মি প্রকাশ করে না। অপর দিকে উত্তর কোরিয়া ২০০৮ সালে মিয়ানমারের কাছে হসং-৫ ট্যাকটিক্যাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের প্রযুক্তি হস্তান্তর করে। মিয়ানমার বর্তমানে মাঝারি পাল্লার সারফেস টু এয়ার মিসাইল তৈরিতে সক্ষম।
মিয়ানমারের কাছে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি দীর্ঘ পাল্লার সারফেস টু এয়ার মিসাইল। এসব মিসাইল মিয়ানমার সংগ্রহ করেছে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে। এর নাম ৫ভি-২১। তবে ঠিক কী পরিমান এ মিসাইল রয়েছে মিয়ানমারের কাছে তা অজানা। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব মিসাইল তৈরি করে দীর্ঘ এলাকা জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক বোমারু বিমান হামলা প্রতিহত করতে।
মিয়ানমার ২০০৮ সালে ২৫০টি সারফেস টু এয়ার মিসাইল সংগ্রহ করে রাশিয়ার কাছ থেকে। এসব মিসাইল আকাশে অতি উচুতে অবস্থানরত বিমানে আক্রমন করতে সক্ষম।
মিয়ানমার ২০০৯ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে হসং-৫ ও হসং-৬ ব্যালিস্টিক মিসাইল সংগ্রহ করে। উত্তর কোরিয়ার এসব মিসাইল মূলত রাশিয়ার আর-১৭ এলব্রাস মিসাইলের অনুকরনে তৈরি করা হয়। ন্যাটো এসব মিসাইলের নাম দিয়েছে স্কাড । মিয়ানমারের কাছে থাকা উত্তর কোরিয়ার হসং-৬ মিসাইলের আওতা ৭০০ কিলোমিটার।
অপরদিকে মিয়ানমারের কাছে থাকা চীনের তৈরি বিপি-১২এ স্বল্প পাল্লার ট্যাকটিক্যাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের আওতা ৪০০ কিলোমিটার।
মিয়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে ২৮৫টি আর-৭৩ এবং ১০০টি আর-২৭ মিসাইল সংগ্রহ করে। এসব মিসাইল মিগ-২৯ বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য এসব বিমান মিয়ানমার ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সংগ্রহ করে।
আর-২৭ মাঝারি পাল্লার এয়ার টু এয়ার ট্যাকটিক্যাল মিসাইল। এর আওতা ১৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছাড়াও সর্বশেষ ইয়েমেনে হামলায় সৌদি নেতৃত্বধীন জোট ব্যবহার করেছে এ মিসাইল।
মিয়ানমারের কাছে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এর নাম এস-২০০ দুবনা। তবে মিয়ানমারের কাছে ঠিক কতটি এ সিস্টেম রয়েছে তা অজানা। তবে রাশিয়ার তৈরি মাঝারি পাল্লার সারফেস টু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং বেলারুশের তৈরি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মাঝারি পাল্লার সারফেস টু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে মিয়ানমারের কাছে।
লিংক-৩
মিয়ানমার মাঝারি পাল্লার সারফেস টু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম। ২০১৬ সালে প্যারেডে তারা নিজেদের তৈরি একটি সারফেস টু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম প্রদর্শন করে। এর নাম কেএস-১এম। ২০২০ সালের মধ্যে তাদের এ ধরনের ১২টি ব্যাটারি তৈরির কথা।
মিয়ানমারের কাছে পিএল-২ মিসাইল রয়েছে ৩৪০টি। পিএল-২ মিসাইল ফাইটার জেট এবং বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য। পিএল-২ মিসাইল চীনের তৈরি এবং ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে এসব মিসাইল সংগ্রহ করেছে মিয়ানমার আর্মি।
মিয়ানমারের কাছে চীনের তৈরি পিএল-৫ মিসাইল রয়েছে ২০০টি। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে চীন থেকে ১০০টি পিএল-৫ মিসাইল সংগ্রহ করে। এসব মিসাইল এফ-৭এম এবং জেএফ-১৭ ফাইটার থেকে নিক্ষেপযোগ্য।
মিয়ানমার ২০১৯ সালে চীনের কাছ থেকে ৬০টি পিএল-১২ মিসাইল সংগ্রহ করে। এসব মিসাইলও জেএফ-১৭ ফাইটার থেকে নিক্ষেপযোগ্য । পিএল-১২ মাঝারি পাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল। এর আওতা ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
মিয়ানমারের কাছে চীনের তৈরি ৩০টি ওয়াইজে-৮৩ এন্টিশিপ মিসাইল রয়েছে। এটি সাবমেরিন এন্টি শিপ ক্রুজ মিসাইল। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে মিয়ানবমার সংগ্রহ করে এসব মিসাইল। মিসাইল ছাড়া মিয়ানমারের কাছে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং মিয়ানমারের নিজস্ব তৈরি বিপুল সংখ্যক বহুমুখী রকেট লাঞ্চার মজুদ রয়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় মিয়ানমার চীন থেকে সংগ্রহ করছে ব্যালিস্টিক মিসাইল। এর নাম এসওয়াই-৪০০ মিসাইল সিস্টেম। বহুমুখী ক্ষমতাসম্পন্ন এ মিসাইল বহন করতে পারে বিভিন্ন ধরনের ভারী আর শক্তিশালী বোমা। গাইডেড এ মিসাইলের লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ কিলোমিটার হলেও এর আওতা বাড়ানো এবং কমানো যায়। মিয়ানমার এর আগে রাশিয়ার কাছ থেকে শক্তিশালী ৬টি এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান ক্রয় চুক্তি এবং চীনের কাছ থেকে জে-১৭বি যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করে।
মিয়ানমারের কাছে থাকা সমস্ত মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক চীন ও রাশিয়ার তৈরি। মায়নমার হালকা ট্যাঙ্ক তৈরি করতে সক্ষম। মিয়ানমার স্থল বাহিনীর কাছে থাকা সমস্ত ধরনের মর্টার আমদানী করা। এছাড়া বিভিন্ন ট্যাঙ্ক উইপনসও মূলত আমদানি নির্ভর। এন্টি এয়ার ক্রাফট গান, রকেট লাঞ্চার, মাইন, কয়েক প্রকার লাইট মেশিন গান, এসল্ট রাইফেল, হাউইজার, ইউটিলিটি ভিক্যিালসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম দেশটি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক সংখ্যা ৫৯৫টি। সাজোয়া যান ১ হাজার ৭০টি। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৪০টি। টাউড আর্টিলারি ১ হাজার ৮৬৯টি। রকেট প্রজেক্টার ৪৯৬টি। এবার জেনে নেই মিয়ানমারের নৌশক্তি সর্ম্পকে কিছু তথ্য
মিয়ানমার নৌবাহিনীর মোট রণতরির সংখ্যা ১৮৭। এর মধ্যে ফ্রিগেট ৫টি, করভেট ৩টি। সাবমেরিন ১টি টহল জাহাজ ৭৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ার ২টি। ২০২০ সালে মিয়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাদের একমাত্র কিলোক্লাস সাবমেরিন। একটি একটি ডিজেল-ইলেকট্রিক এটাক সাবমেরিন।
মিয়ানমারের লিড ফ্রিগেট হলো অং জিয়া ক্লাস। এটি মিয়ানমারের নিজস্ব তৈরি ফ্রিগেট। এটি একটি গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট।
১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত টানা ৫ দশক মিয়ানমার শাসন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ২০১১ সালে দেশটি বেসামরিক শাসনে ফিরলেও তা ছিল মূলত নামে মাত্র। ফলে সেনাবাহিনী নিরবিচ্ছিন্নভাবে সুযোগ পেয়েছে তাদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা তথা সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরনে। এমনকি দেশটি সুচির নেতৃত্বে বাসসামরিক যুগে প্রবেশ করার পরও সেনা খাতে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়। ২০১১ সালের সরকারি গেজেটের তথ্য অনুসারে বাজেটের ২৩ দশমিক ৬ ভাগ বরাদ্দ রাখা হয় প্রতিরক্ষা খাতে।
দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমার বিশাল অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুললেও এর সবই মূলত চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানিকৃত। সেনাবাহিনী দীর্ঘ ৫ দশক দেশটি শাসন করলেও নিজস্ব প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র শিল্প গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের কারনে মিয়ানমার বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। মিয়ানমার শাসক গোষ্ঠী বিশেষ করে মিয়ানমার আর্মির ওপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রন। মিয়ানমারের অর্থনীতিও মূলত চীন নির্ভর। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত বিভিন্ন কারনে মিয়ানমারের ওপর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বর্তমানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন শক্তি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কারনে মিয়ানমার আর্মির মানবতাবিরোধী সকল কর্মকান্ডে প্রতিবেশি শক্তিশালী দেশগুলো সম্পূর্ণ নিরব ভূমিকা পালন করে আসছে । আর এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে মিয়ানমার আর্মি ও অং সান সুচির নেতৃত্বে নামে মাত্র বেসামরিক সরকার।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার আর্মি চেষ্টা করছে দেশটির ওপর থেকে চীনা আধিপত্য কমিয়ে আনার। সে লক্ষ্যে মিয়ানমার আর্মি সম্প্রতি ভারতের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে। চীনও মিয়ানমার আর্মির পরিবর্তে মনোযোগ দেয় সুচি সরকারের প্রতি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে চলছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। ভবিষ্যতে আঞ্চলিক আধিপত্যকেন্দ্রিক রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠতে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ পাহাড় আর গভীর অরণ্যের দেশ মিয়ানমার।