রাশিয়ার এসইউ-৫৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫- কোন যুদ্ধবিমানটি বেশি কার্যকর, তা নিয়ে রয়েছে জোর বির্তক। সম্প্রতি রাশিয়ার একজন খ্যাতিমান পাইলট রাশিয়ার এসইউ-৫৭ যুদ্ধবিমানের কার্যক্ষমতা ও দুর্বলতা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন।
রাশিয়ার সমর ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রশিক্ষক পাইলট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ম্যাগোমেড টোলবোয়েভ সম্প্রতি রাশিয়ার এসইউ-৫৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ লাইটনিং জেট ফাইটার নিয়ে তার মতামত প্রকাশ করেন। রাশিয়ার গণমাধ্যম তাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টোলবোয়েভ বলেন, দুটি বিমানকে যদি সম্মুখযুদ্ধে বা ডগফাইটে নামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে খুব সহজেই রাশিয়ার নির্মিত এসইউ-৫৭ বিমানগুলো এফ-৩৫-কে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে।
রাশিয়ার এই এসইউ-৫৭ বিমানটি মূলত রাশিয়ার পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। তবে টোলবোয়েভের বিবেচনায় এসইউ-৫৭-এর একমাত্র দুর্বলতা হলো এই বিমানগুলোতে যে ইলেকট্রনিক্স সংযুক্ত আছে। তার ফলে সূর্যের আলোকরশ্মিতে এ বিমানটির কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।
টোলবোয়েভ জানান, এসব সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি বরাবরই একটি বিমানের সবকিছু ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে রাখার বিরোধিতা করেন। এসইউ-৫৭ বিমানটিকে ন্যাটো ফেলন নামে অভিহিত করেছে। এ বিমানটি দীর্ঘ সময় ডগফাইটে লিপ্ত থাকতে পারবে বলেও তিনি জানান। তবে টোলবোয়েভ বলেন, আজকের সময়ে এসে শুধুমাত্র ডগফাইটের আর সে অর্থে প্রয়োজন পড়ে না। বরং এক্ষেত্রে সবকিছুই নির্ভর করে অন্যসব উপকরণ ও কৌশলের ওপর।
আজকের সময়টা হলো ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধের। তাই ট্যাকটিকাল ইস্যুতে যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারাই জয়ী হবে।
৭০ বছর বয়সী টোলবোয়েভকে রাশিয়ার একজন সম্মানিত টেস্ট পাইলট হিসেবে গণ্য করা হয়। রাশিয়ান সরকার তাকে হিরো অব রাশিয়া উপাধিতেও ভূষিত করেছেন। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে তিনি প্রায় ৫০ ধরনের নতুন ও পুন:নির্মিত বিমান উড়িয়েছেন যার মধ্যে মিগ টোয়েন্টি নাইন, মিগ থার্টি ওয়ান, এসইউ টোয়েন্টি ফোর এবং এসইউ টোয়েন্টি সেভেন রয়েছে। ৮০’র দশকে টোলবোয়েভ এনার্জিয়া-বুরান স্পেস প্রোগ্রামে অংশ গ্রহন করেছিলেন। এর বাইরে মানুষ্যনির্ভর স্পেস ফ্লাইট এবং বেশ কয়েকটি স্পেসক্রাফটের প্রশিক্ষন প্রকল্পেও তিনি অংশ নেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে তার যেকোনো মূল্যায়নকে রাশিয়ার নীতি নির্ধারকেরা খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন।
ন্যাশনাল রিপোর্ট তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, ম্যাক টু এর থেকেও গতি বেশি হতে যাচ্ছে এসইউ-৫৭-এর। বিমানের অভ্যন্তরে থ্রিডি মানের ভেক্টরিং প্রযুক্তি সংযুক্ত হচ্ছে। বিমানে বিপুল পরিমানের অস্ত্র বহন করার মতো সক্ষমতা রেখে এর নকশা প্রনয়ণ ও কাঠামো নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যা আকাশ থেকে আকাশে মিসাইল নিক্ষেপে অন্য সব বিমানের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
বর্তমানে যেসব যুদ্ধবিমানকে হাই প্রোফাইল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে সেগুলোকেও এসইউ-৫৭ বেশ সহজেই কুপোকাত করতে পারবে। এসইউ-৫৭ বিমানগুলোকে এমনভাবে নির্মান করা হচ্ছে যা সহজেই শত্রুর আকাশ সীমানায় প্রবেশ করতে পারবে এবং অতি অল্প সময়ে প্রতিপক্ষের অবকাঠামোগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারবে।
এসইউ-৫৭ বিমানগুলোতে যুদ্ধ করার মতো উন্নতমানের এভিওনিক্স সুইট এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে আকাশপথে এ বিমানগুলো রীতিমতো রাজত্ব করে টিকে থাকতে পারে। এ বিমানগুলোতে স্বচ্ছ লেন্সের ক্যামেরা সংযুক্ত থাকায় অনেক উপর থেকেই বিমানটি যুদ্ধক্ষেত্রের একটি গতিশীল চিত্র ধারন করতে পারবে।
লকহিড মার্টিনের এফ-৩৫ যুদ্ধ করার পাশাপাশি আশপাশে থাকা মিত্রপক্ষের অন্যন্য কাঠামোতেও তথ্য সরবরাহ করতে পারবে। এ কারণে অনেকেই এফ-৩৫ কে ডানাযুক্ত কম্পিউটার হিসেবেও অভিহিত করে। এতসব উন্নত অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরও নানা সময়ে এ বিমানটি মার্কিন নীতি নির্ধারক ও সমর বিশ্লেষকদেরকে হতাশ করেছে।
অনেক সমালোচক বলেছেন এফ-৩৫ মোটেও ভালো পারদর্শিতা করতে পারছে না। তারা এ বিমানটিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রক্তাক্ত নিয়তি হিসেবেও আখ্যা দেন। এমনকী পেন্টাগনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও এ বিমানটিকে ট্রিলিয়ন ডলার মিসটেক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এর স্টেলথ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ বিমানটি হয়তো এসইউ-৫৭-এর সামনে পড়লেও এড়িয়ে চলে যেতে পারবে।
এসইউ-৫৭ বিমানটি অল্পগতিতেও সমান সক্রিয় থাকতে পারে। কোবরা সাপ যেমন নিজের লেজের ওপর অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এসইউ-৫৭-ও তাই। তাছাড়া এ বিমানের আক্রমণ ক্ষমতা এতটাই শক্তিশালী যে, অনেক দূর থেকেও যদি কোনো হুমকি ধরা পড়ে তাহলে সে অনেক দূরে থাকা অবস্থাতেই তাকে আক্রমন করে বসতে পারে। এ কারণেই সমর বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি কোনো অভিজ্ঞ পাইলট এ বিমান চালনায় যুক্ত থাকে তাহলে সে নির্দি¦ধায় এবং বেশ ভালোভাবেই জয়ী হয়ে ফিরতে পারবে।
এসইউ-৫৭ যুদ্ধ বিমানটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে, সহজে বিমানটি চোখে পড়ে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিমানটির কার্যকারিতা কম। বরং বিমানটির পারদর্শিতা সমসাময়িক যেকোনো বিমানের তুলনায় অনেক বেশি।
রাশিয়ার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সুখোই তাদের বিমানগুলোকে এমনভাবে নকশা করে যাতে এর কাঠামো কম দৃশ্যমান হয়। পাশাপাশি তাদের তৈরি বিমানের রাডারের সিগনেচারও কম থাকে। ফলে, এসইউ-৫৭ বিমানগুলো প্রতিপক্ষের বিমানগুলোকে দ্রুত এবং অনেক দূর থেকে সনাক্ত করতে পারলেও এ বিমানগুলোকে সনাক্ত করা অন্যদের জন্য কঠিন। বিশ্লেষকরা বলছেন এসইউ-৫৭-এর ৫টি অনবদ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এ বিমানটিকে অন্য বিমানের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে রাখবে।
বিমানটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দুই পাশে মুখ করা চেক মাউন্টেড রাডার সিস্টেম। এখন পর্যন্ত লকহিড মার্টিন এ প্রযুক্তিকে তাদের বিমানে সংযুক্ত করতে পারেনি। ককপিটের নিচে এ রাডারগুলো থাকে। সবগুলো রাডার মিলে একটি সম্প্রসারিত সেন্সর ব্যবস্থা গড়ে তুলবে যা দিয়ে সম্মুখভাগের ও নীচের গোটা পরিস্থিতিকে ভালোভাবে অবলোকন করা যাবে এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পাইলটের জ্ঞান ও সচেতনতাও অনেকটা বেড়ে যাবে।
এ বিমানে থাকবে তাহলো ইনফ্রাড সার্চ এবং ট্র্যাক অপশন। এসইউ-৫৭-এ একটি উন্নত প্রযুক্তির হান্ড্রেড জিরো ওয়ান কেএস এটল ইনফ্রানড সার্চ ও ট্র্যাক সেন্সর সংযুক্ত থাকছে। বিমানের একেবারে নাকের ডগায়, উইন্ডস্ক্রিনের কাছেই একে ইন্সটল করা হয়েছে। যদিও এই জায়গায় বসানোর কারণে এসইউ-৫৭-এর রাডার সিগনেচারের কাজটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে, আইআরএসটি ধরনের এ প্রযুক্তিটিকে বর্তমানে প্রতিপক্ষের স্টেলথ বিমানগুলো সনাক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই বিমানে থাকছে ইনফ্রাড কাউন্টারমেজার সিস্টেম। এফ-২২ বিমানের মতো এসইউ-৫৭-এও মিসাইল নিক্ষেপের একাধিক ডিটেক্ট রয়েছে। রাশিয়া মূলত এসইউ-৫৭-কে বৃহৎ আকৃতির এন হান্ড্রেড এন্ড ওয়ান ইলেক্ট্রো অপটিকাল সুইট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে যেখানে মিসাইল লঞ্চ করার ডিটেক্টও সিস্টেম থাকবে। পাশাপাশি ককপিটের পেছনে লেজারের মরিচা বোমা নিক্ষেপের মতো আয়োজনও থাকছে।
যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার গতি খুবই গুরুত্বপূর্ন। উচ্চগতির কারণে সব ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা অনেক সময় ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। কিন্তু এসইউ-৫৭-এর গতি অনেব বেশি থাকলেও তাতে অন্যন্য সব প্রযুক্তি ও কৌশল একইভাবে কার্যকর থাকবে। গতি যুদ্ধ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদি বিমানের অন্য প্রযুক্তিগুলো সেভাবে কাজ না করে তাহলে উচ্চগতিই পাইলটের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। এসইউ-৫৭ বিমানগুলো অতি অল্প সময়ে এর গতি বাড়িয়ে প্রতিপক্ষের বিমানগুলোর দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে সক্ষম।
এসইউ-৫৭-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এতে টান্ডিম উইপনস বে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিমানের ভেতর এতটাই জায়গা রাখা হয়েছে যে, বিমানটিতে একই সময়ে কমপক্ষে ৪টি আর সর্বোচ্চ ৬টি এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহন করা সম্ভব হবে। আবার মিসাইলের পরিবর্তে অন্য আরো কিছু অস্ত্রও বহন করা সম্ভব হতে পারে। এমনকী বোমা বা আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপনযোগ্য স্ট্যান্টঅফ মিসাইলও এ বিমানগুলো বহন করতে পারবে।
বর্তমান সময়ে এসে এ্যারোস্পেস এবং অস্ত্র প্রযুক্তি এত দ্রুত উন্নতি করছে যে কার প্রযুক্তি সর্বাধুনিক আর সর্বাধুনিকটাও কত সময় পর্যন্ত আধুনিক থাকবে তাও বলা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এসইউ-৫৭-এ যদিও স্টেলথ প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে তবে সার্বিক বিবেচনায় এ বিমানটিকে নিকট ভবিষ্যতের ত্রাস হিসেবেই সমর বিশেষজ্ঞরা মুল্যায়ন করেছেন।