ইরানের জুজুর ভয় দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবল সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে সৌদি আরবে নতুন ঘাঁটি তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে দেশটি।
লোহিত সাগরের একটি বন্দর এবং দুটি বিমানঘাঁটিতে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যেই সৌদি আরবের সঙ্গে প্রাথমিক একটি চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড বা সেন্টকমের কর্মকর্তারা ওই চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। তবে এটাকে ‘কন্টিজেন্সি’ বা আপাতকালীন পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন তারা। তবে মার্কিন সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যেই ইয়ানবু বন্দরটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছে। এই বন্দরটি পবিত্র মদিনা নগরী থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
মার্কিন সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা তাবুকে কিং ফয়সাল বিমানঘাঁটির সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখছে। এই ঘাঁটিটি জর্ডানের সঙ্গে সৌদি সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আরেকটি হচ্ছে তায়েফে কিং ফাহাদ বিমানঘাঁটি। এটি পবিত্র মক্কা থেকে ৬০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
মার্কিন সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই সৌদি আরবের ইয়ানবু বন্দর থেকে মালামাল পরিবহন সুবিধা পরীক্ষা করে দেখেছেন। ইয়ানবু বন্দরটিতে রয়েছে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেল পাইপলাইন টার্মিনাল।
ইয়ানবুর পাশাপাশি লোহিত সাগরের তাবুক ও তায়েফ বিমানঘাটি ব্যবহারের ফলে মার্কিন সেনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্র পথকে কাজে লাগাতে পারবে। ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা এখানে মাঝে মাঝেই মাইন ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে।
তবে এমন সময় এ ঘোষণা এলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার বিচার করার অঙ্গীকার এবং ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। সৌদিতে অস্ত্র রফতানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
এসব সত্ত্বেও ইসলামের পবিত্রভূমি সৌদি আরবে আরেকটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে হামলার জন্য নতুন মার্কিন সামরিক ঘাঁটির খবরে উগ্রপন্থীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
সেন্টকমের মুখপাত্র মার্কিন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন বিল আরবান বলেছেন, এসব ঘাঁটি ও বন্দর ব্যবহারের জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদির তেলখনির ওপর ভয়াবহ হামলার পর তারা একাজে মনযোগী হয়। ওই হামলার পর সৌদির তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। এরফলে বিশ^বাজারে তেলের দামও বেড়ে যায়।
তেল স্থাপনায় হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র । তবে তেহরান তা অস্বীকার করেছে। হুথিরা হামলার দায় স্বীকার করেছে। তদন্তে হামলার জন্য ইরানি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। সেই হামলার জন্য ব্যবহৃত ড্রোন ছিল ইরানের তৈরি।
ইরানে হামলার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘদিন ছক কষেছিল। বিশেষ করে ট্রাম্পের বিদায়ের আগ মুহূর্তে ইরানের ওপর একদফা হামলা প্রায় নিশ্চিত ছিল বলে খবর বের হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলার পর ট্রাম্প অভিশংসনের মুখে পড়লে সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায় বলে মনে করা হচ্ছে।
ইরানকে সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে দেশটির শাসকরা। সৌদি প্রতিরক্ষানীতির কেন্দ্রে রয়েছে তাই ইরানকে মোকাবিলা করা।
ক্যাপ্টেন আরবান বলেছেন, আপতকালীন প্রয়োজনে এসব ঘাঁটি সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া সামরিক দূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ। তার দাবি, এটা উসকানিমূলক কোনো পদক্ষেপ নয়। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণভাবে এই অঞ্চলে কিংবা বিশেষভাবে সৌদিতে সামরিক উপস্থিতি সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছে না।
তিনি জানান, এসব ঘাঁটির জন্য সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রকে টাকা দিয়েছে। প্রয়োজনে আরও ঘাঁটি ব্যবহার করা হবে এবং সৌদি টাকা দেবে। তাবুকে রয়েছে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল সামরিক ঘাঁটি। তায়েফে রয়েছে কিং ফাহাদ বিমান ঘাঁটি।
সেন্টকমের প্রধান জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি সম্প্রতি ইয়ানবু সফর করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরানের সঙ্গে কোনও সংঘাত শুরু হলে নতুন এই তিন ঘাঁটি থেকে সৈন্যদের সহজে আনা-নেয়া করা যাবে। তিনি বলেন, ইরানের সঙ্গে কোনও সশস্ত্র সংঘাত হলে যেকোনো পরিস্থিতিতে আরব উপসাগর প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই কোন জায়গা থেকে সেনাদের মোতায়েন করা যায় সেটাই আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।
জেনারেল ম্যাকেঞ্জি আরও বলেন, এর ফলে আমাদের হাতে অনেকগুলো অপশন থাকবে। আর একজন কমান্ডারের কাছে অপশন থাকা সবসময়ই ভালো বিষয়। সৌদি কর্মকর্তারা নতুন মার্কিন ঘাটি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
সৌদি আরব ছাড়াও উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাটি। ১৯৯১ সালে মার্কিন মিত্র বাহিনী এসব ঘাটি ব্যবহার করে কুয়েত থেকে ইরাককে বহিস্কার করে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে এবং ২০০৩ সালে ইরাকে হামলায় এসব ঘাঁটি ব্যবহার করে।
নাইন ইলেভেনের হামলার পর সৌদি থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়। সৌদিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতির প্রতিশোধ হিসেবে ওই হামলার চালানো হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন ওসামা বিন লাদেন।
তবে ইরানের আশপাশের ১১ দেশে ঘাঁটি গেঁড়ে আছে ৭০ হাজার মার্কিন সেনা। কাতারে রয়েছে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার। মার্কিন নৌবাহিনীর ফিফথ ফ্লিট বাইরাইনে থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কুয়েতেও আছে সেন্ট্রাল কমান্ডের ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার। আমিরাতে আছে আমেরিকার পাইলট ও নাবিকরা।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কত সৈন্য রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে গ্রিন জোন, বাগদাদের কূটনৈতিক এলাকা, আল আসাদ বিমান ঘাঁটিতে বর্তমানে দেশটির সেনাসদস্যরা রয়েছে। এই সংখ্যা আনুমানিক ছয় হাজার। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র কুয়েতে রয়েছে বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটি। যেখানে রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার মার্কিন সৈন্য। সিরিয়ার কোথায় যুক্তরাষ্ট্রের কত সংখ্যক সৈন্য রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। ২০১৯ সালেও দেশটিতে প্রায় ২০০০ সৈন্য ছিল।
ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল ও আর সৌদি আরবের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে জর্ডানের। কৌশলগত দিক থেকে তাই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান এটি। দেশটির মুভাফফাক ছালটি বিমান ঘাঁটি থেকে সিরিয়ায় আইএস বিরোধী হামলা চালানো হয়েছে।
বাহরাইনে বর্তমানে সাত হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে। ওমানে বর্তমানে সেখানে ৬০০ মার্কিন সৈন্য। সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঁচ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে পেন্টাগন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি কাতারের আল উদিদে। বর্তমানে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য রয়েছে তুরস্কেও। দেশটির ইনজিরলিক বিমান ঘাঁটিসহ বেশ কিছু জায়গায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। এর বাইরে আফগানিস্তানেও আছে মার্কিন সেনা। তবে তা সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানের সঙ্গে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর সৌদি আরবে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। নাইন ইলেভেনের হামলার পর তখনই প্রথম সেনা মোতায়েন করা হয় সৌদিতে। তখন রাজধানী রিয়াদের কাছে প্রিন্স সুলতান বিমান ঘাঁটিতে আড়াই হাজার মার্কিন সেনার পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় জঙ্গিবিমান ও প্যাট্রিয়ট মিসাইল ব্যাটারি। এসব সেনা মোতায়েনের জন্য সৌদি আরব আমেরিকাকে ১০০ কোটি ডলার দিয়েছে বলে তখন জানিয়েছিলেন ট্রাম্প।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন সৌদি আরবে এবার মার্কিন সেনারা হয়তো স্থায়ীভাবে থাকবে না। পরে তাদেরকে অন্যান্য মার্কিন ঘাটিতে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। নতুন করে সেনা মোতায়েন নিয়ে সৌদি সরকার কোনো মন্তব্য করতে চায়নি।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একতরফাভাবে ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে সরে দাড়ান। পরে একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় পর্যুদস্ত করেন ইরানকে। তবে এসবের জন্য ইরানের উসকানি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বড় করণ ছিল ট্রাম্পের নির্লজ্জ ইসরাইলপ্রীতি। তিনি ইসরাইলের সুরক্ষার জন্য ইরানকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন।
এমনকি কোনো উসকানি ছাড়াই বিদায়ের আগ মুহূর্তে তিনি ইরানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। সৌদিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয় মূলত সেই লক্ষ্য থেকেই।
জাতিসংঘে ইরানের মুখপাত্র আলিরেজা মিরইউসেফি সৌদিতে মার্কিন ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রই মধ্যপ্রাচ্যে অরাজকতা ও নিরাপত্তাহীনতা জিইয়ে রাখছে। কোনো দেশ ইরানে আগ্রাসন চালালে তেহরান নিজেকে সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর।
আমেরিকার অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা সৌদি আরব ও আরব দেশগুলো। ইরানের হুমকি মোকাবিলা করে হরমুজ প্রণালী দিয়ে আরব দেশগুলো তাদের তেল পরিবহনের জন্যও আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল।