তুরস্ক ২০১৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে উচ্চপ্রযুক্তির এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। ভারতও রাশিয়ার কাছ থেকে একই অস্ত্র কেনার জন্য ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে। এ কারণে তুরস্কের মতো ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কি তুরস্কের মতো ভারতের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে?
ওয়াশিংটন সম্প্রতি নয়াদিল্লিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা রাশিয়ার সাথে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের যে চুক্তিটি করেছে, সেজন্য তদেরকে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কাউন্টারিং আমেরিকা’স অ্যাডভারসরিস থ্রো স্যাঙ্কশনস বা সিএএটিএসএ নামে যে আইনটি পাশ করেছে, তা ২০১৭ সালে বলবৎ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী যে কোনো দেশ রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহকারি একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রোসোবরনএক্সপোর্ট’ এর সাথে কোন ‘তাৎপর্যপূর্ণ লেনদেন’ করলে দেশটির উপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ আরোপ করতে বাধ্য থাকবে।
এই আইন অনুযায়ী ভারতের ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিটি একটি ‘তাৎপর্যপূর্ণ লেনদেন’। ফলে ভারতও শিগগিরই তুরস্কের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে যাচ্ছে।
তুরস্ক ২০১৭ সালে অস্ত্র কেনার জন্য রাশিয়ার সাথে ২দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের যে চুক্তি করে তার অংশ হিসেবেই দেশটি এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সরবরাহ করতে বলেছে মস্কোকে। ন্যাটোর সদস্য হচ্ছে তুরস্ক। ন্যাটোর নিয়ম অনযায়ী সংস্থার কোনো সদস্য দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনতে ও তা মোতায়েন করতে পারবে না।
এ কারণে তুরস্ক রাশিয়ার সাথে চুক্তি করার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর পক্ষ থেকে বার বার দেশটিকে চুক্তি বাতিল করতে বলা হয়। কিন্তু তুরস্ক সে কথা শোনেনি। দেশটি যুক্তি দেখাচ্ছে যে, নিজের নিরাপত্তার জন্য এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার ও তা মোতায়েন করার অধিকার তাদের রয়েছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামাদির প্রথম চালানটি গ্রহন করে। এর পরই যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ জয়েন্ট ষ্ট্রাইক ফাইটার প্রোগ্রাম থেকে বাদ দেয়। এছাড়া দেশটি তার বিমান বাহিনীর জন্য ১০০ এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনার যে চুক্তি করেছিল সেটিও বাতিল করা হয়। এর পরের পদক্ষেপ হিসেবে গতবছর ডিসেম্বর মাসে তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন। রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্কের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম কেনার ঘটনা এটাই প্রথম।
অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক দিনের। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ার এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান থেকে শুরু করে টি-৯০ ও টি-৭২ ট্যাঙ্কসহ অনেক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে। নয়া দিল্লি রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তাদের ডিজাইনে এ ধরনের অনেক সমরাস্ত্র নিজেরাই তৈরি করেছে।
ভারত তুরস্কের মতো এফ-৩৫ জেএসএফ প্রোগ্রামের সদস্য নয়। ন্যাটোরও সদস্য নয় দেশটি। এছাড়া আজ পর্যন্ত ভারতকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ষ্টেলথ যুদ্ধ বিমান কেনার অনুমোদনও দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ভারত নানা কারণেই রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।
ষ্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস এট ষ্ট্র্যাটফর এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রজার বাকের মনে করেন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা সীমান্তে প্রতিবেশি দুই দেশ পাকিস্তান ও চীনের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে ভারত। এছাড়া রাশিয়ার সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। কোনো কারণেই ভারত এই সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না। চীনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক চায় ভারত। একই সাথে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ভারত তার ‘কৌশলগত স্বাধীনতাও বজায় রাখতে চায়।
কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবে ভারত কেন এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনবে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন রেসিডেন্ট ফেলো গ্রেগ চ্যাফিন। তিনি মনে করেন , ভারত আঞ্চলিক ভূÑরাজনীতির প্রেক্ষিতে বড় ধরনের চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। ক্ষেপনাত্র ও যুদ্ধ বিমানের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও ভারতের এস-৪০০ দরকার।
ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ফাক-ফোকর বা গ্যাপ রয়েছে। তাদের বিমানবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের অবস্থা লেজেগোবরে। যা এই বাহিনীর জন্য একটি বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। এজন্যই ভারতের শক্তিশালী বিমান ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভারত আশঙ্কা করছে পাকিস্তান ও চীন কৌশলগতভাবে তাদেরকে ঘিরে ফেলবে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেও দিল্লি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায়। প্রয়োজনের সময় রাশিয়া যাতে চীনের দিকে না ঝুকে সে হিসাব-নিকাশও করছে দিল্লি। সেজন্যই তারা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে রাশিয়াকে হাতে রাখতে চাইছে।
দ্য ইকোনোমিষ্ট পত্রিকার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশিও মনে করেন, কোন চাপ বা হুমকির মুখেই ভারত রাশিয়ার এস-৪০০ কেনা থেকে পিছিয়ে আসবে না। কারন ভারতের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা রয়েছে তা পূরণ করবে এস-৪০০। ভারতের উপর অবরোধ আরোপ করা হলে তা গত ২০ বছর ধরে গড়ে উঠা দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্কে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব ফেলবে।
ভারতের ওপর অবরোধ আরোপ করা হলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নির্ভরযোগ্য ও বিশ^স্ত কোনো বন্ধু নয়। এমনকি এতে দুই দেশের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার গতিও শ্লথ হয়ে যাবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যৌথ মহড়া কর্মসূচীর সদস্য না হলেও আরো অনেক ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বল্প পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে পারে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সশস্ত্র ড্রোন ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত।
তবে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে , রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের সাথে দেশটি দীঘমেয়াদি উচ্চ প্রযুক্তির সম্পর্ক করতে চায় সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারতকে এটা বুঝতে হবে যে, তারা যদি রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ কিনে তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের একই ধরনের প্রযুক্তির সমরাস্ত্র সংগ্রহ করার সুযোগ হারাবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির সরবরাহও আর পাবেনা যা ভারতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজন।
ভারত যখন তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পিলার হিসেবে প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে চাইছে সেখানে মার্কিন অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে। সামরিক বিশেষজ্ঞ রজার বাকের মনে করেন, সিএএটিএসএ আইনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না। কারণ গুরুত্বপূর্ণ শরিকদের উপর আইন আইন প্রয়োগের ব্যাপারে তারাও খুবই সতর্ক।
চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোন কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার ভারত। সে কারণেই ওয়াশিংটন তাদের সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের নাম পরিবর্তন করে ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড রেখেছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের অংশিদারিত্বের কিছুটা হলেও প্রতিফলন ঘটেছে।
এছাড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি কিভাবে এড়ানো যায় তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যৌথভাবে কাজ করবে বলেও মনে করেন চ্যাফিন। তিনি বলেন, যেহেতু বারত বাইডেন প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে য”েছ, সেহেতু তারা এমুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করে এমন কোনো বিষয় সামনে আনবে না।
বাইডেন প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করার আগে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ এর কোনো চালান গ্রহন করবেনা বলেও মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এস-৪০০ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস যাতে কোনো কঠোর অবস্থান না নেয় সে ব্যাপারেও ভারত লবিং করে সমস্যার একটি সমাধানে বাাসার চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসনও ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে অন্য কী উপায়ে এই সংকটের সমাধান করা যায় তা নিয়ে ভাববে বলে মনে করা হয়। আর যদি নিষেধাজ্ঞারোপ করার বিষয়টি এড়ানো না যায় এই নিষেধাজ্ঞা হতে পারে খুবই হালকা প্রকৃতির। আসলে এস-৪০০ কেনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয় সংকটে পড়তে যাচ্ছে।