সামরিক শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলো


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:২৭

সামরিক শক্তিকে কি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব? সামরিক শক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২১ সালের জন্য যে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে, তা দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকা ১৫টি মুসলিম দেশ তাদের অবস্থানের উন্নতি করেছে। তালিকায় আছে আলজেরিয়া, মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর নাম।

সামরিক শক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ৫০টি বিষয়ের ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক শক্তির সূচক তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর পরিধি, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও দক্ষতা, সামরিক বাজেট, বিভিন্ন মিশনে সফলতা, দেশটির ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যা ইত্যাদি। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে এখন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে পাকিস্তান। অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও সামরিক খাতে পাকিস্তানের এই উন্নতি অবাক করার মতো। ক্রমশই সমরাস্ত্র শিল্পে আমদানি-নির্ভরতা কমানোর পথেও হাঁটতে শুরু করেছে দেশটি।

১৩৩টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৫ নম্বর থেকে এক লাফে দশে উঠে এসেছে পাকিস্তান। র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের অবস্থানেরই উন্নতি হয়েছে। এর পরে আছে রাশিয়া ও চীন। ১৫ থেকে এক লাফে ১০- এ উঠে আসার পথে পাকিস্তান পিছনে ফেলেছে ইসরাইল, কানাডা, ইরান ও ইন্দোনেশিয়াকে।

র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি করা দ্বিতীয় মুসলিম দেশ আলজেরিয়া। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটি গত বছর ছিলো তালিকার ২৮ নম্বরে, এবার তারা একধাপ এগিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ২৭ নম্বরে। সামরিক শক্তির বিচারে আফ্রিকা অঞ্চলের দ্বিতীয় শক্তিধর দেশ আলজেরিয়া।

আলজেরিয়ার বর্তমান প্রতিরক্ষা বাজেট ১ হাজার ৪০ কোটি মার্কিন ডলার। দেশটির সেনাবাহিনীর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার। এছাড়া প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আলজেরিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে রাশিয়ার সাথে। যে কারণে দেশটির অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সামগ্রীর প্রধান সরবরাহকারীও মস্কো। আলজেরিয়ার অস্ত্র ভান্ডারের ৯৫ শতাংশই রাশিয়ার তৈরি।

বর্তমানে আলজেরিয়ার বিমানবাহিনীর ফাইটার বহরের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়ার তৈরি সুখোই সু-থার্র্টি ও মিগ টুয়েন্টি নাইন ফাইটার। দেশটির বহরে মোট ফাইটার রয়েছে ১০২ টি। এছাড়া রাশিয়ার তৈরি সু-ফিফটি সেভেন বিমানের ১৪টি কেনার আলোচনা চালাচ্ছে আলজেরিয়া। সেটি হলে তারাই হবে রাশিয়ার তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ ফাইটারটির প্রথম ক্রেতা।

এছাড়া আরো কিছু সু-থার্টি ফোর বোম্বার কেনার চুক্তিও ইতোমধ্যে করে ফেলেছে আলজেরিয়া। এছাড়া চীন থেকে চতুর্থ প্রজন্মের জেএফ-সেভেনটি থান্ডার ফাইটার কিনবে আলজেরিয়া এমন কথা শোনা যাচ্ছে।

সামরিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বড় উন্নতি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৪৫ নম্বর থেকে এক লাফে ৩৬ এ উঠে এসেছে উপসাগরীয় আরব দেশটি। গত এক দশক ধরেই আরব আমিরাত চেষ্টা করছে তাদের সামরিক শক্তি বৃৃৃৃৃদ্ধির। সেই চেষ্টারই ফল পেয়েছে দেশটি। আসুন জেনে নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক শক্তি সর্ম্পকে কিছু তথ্য

ইরানের সাথে বৈরিতা আর সামরিক পদক্ষেপের কারণে আরব আমিরাত শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। আমিরাতের বিমান বাহিনীতে ফাইটার জেট আছে ৯৮। এর মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-সিক্সটিন ও ফ্রান্সের তৈরি মিরেজ মাল্টিরোল ফাইটার। প্রশিক্ষণ বিমান ১৪৫টি, স্পেশাল মিশন পরিচালনার বিমান ১৭টি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩০টি।

১৯৮৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত তার অস্ত্র ভাণ্ডারে যুক্ত করেছে উত্তর কোরিয়া থেকে কেনা স্কুড-বি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তাদের আছে ফ্রান্সের লেকলার্ক ট্যাঙ্ক ও রাশিয়ার বিএমপি-থ্রি সাঁজোয়া যান। অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে এক দেশের ওপর নির্ভরতা ইরানকে যে বিপদে ফেলেছিল তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ৯০এর দশকে আমিরাত একাধিক দেশের থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে। রুশ নির্ভরতা থেকে বেড়িয়ে আসতে তারা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউক্রেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানি থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে। আবার কেনা অস্ত্রগুলোকে আধুনিকায়ন করতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে দেশটি।

সামরিক খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে আমিরাতের আরেকটি প্রকল্প ছিলো এমিরাটাইজেশন। এক সময় দেশটির বিমান বাহিনীতে বিদেশী দক্ষ পাইলটদের নিয়োগ দেয়া হলেও এই কর্মসূচির আওতায় দেশী পাইলট ও মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। এখন আমিরাতের নাগরিক ছাড়া কেউ নেই এসব পদে। ২০০৮ সালে তাদের হাতে আসে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের এমআইএম-ওয়ান জিরো ফোর ভার্সন। একই সাথে এর রাডার সিস্টেমসহ প্যাট্রিয়টের সাপোর্টিভ সব সিস্টেমই আসে আবুধাবিতে। এছাড়া প্যাট্রিয়টের পূর্বসূরী হিসেবে পরিচিত হক মিসাইল সিস্টেমও আছে তাদের ভাণ্ডারে।

২০১১ সালে হরমুজ প্রণালীতে ইরানের সাথে উত্তেজনার পর আমিরাত ক্ষেপণাস্ত্র খাতে সাড়ে তিনশ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পদক্ষেপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত থাড ক্ষেপণাস্ত্র সবার আগে হাতে পেতে যাচ্ছে আমিরাত। এই থাড এতটাই শক্তিশালী যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় এটি মোতায়েন করতে চাইলে বাধা দিয়েছিল চীন। টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম বা থাড পেতে আমিরাতকে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় দুইশো কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া আছে নিজস্ব তৈরি জোবাইর মাল্টিপল রকেট লঞ্চার।

আরব আমিরাতের সামরিক শক্তি বাড়ানোর সবচেয়ে বড় খবরটি এসেছে ২০২০ সালের শেষ দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের এফ-থার্টিফাইভ ফাইটার আমিরাতের কাছে বিক্রির অনুমতি দিয়ে গেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। যদিও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পুরস্কার হিসেবে আমিরাত এফ-থার্টিফাইভ পাচ্ছে, তবুও দেশটির সামরিক শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় একটি মাইল ফলক।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেশে তৈরিতেও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে আমিরাত। দেশের মাটিতেই তারা নৌ বাহিনীর জন্য ৫-৬টি করভেটস বানানো শুরু করেছে। এছাড়া ড্রোন, অ্যামিউনিশন ও সমারিক যান শিল্প গড়ে তুলছে তারা। আর এ সব কিছুর পুরস্কার হিসেবেই দেশটি সামরিক শক্তির র‌্যাঙ্কিংয়ে বড় ধরনের লাফ দিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ মরক্কো ৫৭ থেকে উঠে এসেছে ৫৩ নম্বরে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনীবেশ করেছে।

২০২০ সালের জুনে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের সাথে ৯ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী মরক্কোকে ২৫টি এফ-সিক্সটিন ফাইটার জেট ও ৩৬টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার সরবরাহ করবে লকহিড মার্টিন।

এখানেই শেষ নয়, মরক্কো চাইছে ২০২৮ সাল নাগাদ ৪৮টি এফ-সিক্সটিন ফাইটারের বহর গড়তে। এসব বিমানে থাকবে পঞ্চম প্রজন্মের রাডারসহ উন্নত ইলেকট্রনিক সিস্টেম। এছাড়া এন্টি এয়ারক্রাফট কামান, স্থল যুদ্ধের জন্য আধুনিক ট্যাঙ্ক এবং সমুদ্র সীমায় দাপট বাড়াতে নৌ বাহিনীকে আধুনিকায়ন করছে মরক্কো।

আফ্রিকার আরেক দেশ লিবিয়াও এগিয়ে যাচ্ছে সামরিক শক্তিতে। দেশটিতে অনেক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চললেও ত্রিপোলি ভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃত উন্নতি করেছে সামরিক শক্তিতে। এজন্য অবশ্য দেশটি ঋণী তুরস্কের কাছে। তুরস্ক লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি সরকারি বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন রকম সহযোগীতা করেছে।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারে র‌্যাঙ্কিংয়ে লিবিয়া ৮০ থেকে এক লাফে উঠে এসেছে ৭০ নম্বরে। বড় ধরণের অগ্রগতি হয়েছে কুয়েতেরও। গত বছর দেশটি ছিলো ৮৫ নম্বরে, ২০২১ সালে তারা জায়গা করে নিয়েছে ৭১ নম্বরে। এছাড়া উন্নতি করেছে ওমান, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, কাতার, নাইজেরিয়া, কিরগিজিস্তান, আলবেনিয়া, বসনিয়া এন্ড হার্জেগোবিনা। এই দেশগুলো প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানের উন্নতি করেছে নতুন বছরে। নিজেদের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়, প্রতিরক্ষা শিল্প জোরদার কিবা বিদেশ থেকে উন্নত সমরাস্ত্র আমদানির ফলে দেশগুলোর এই উন্নতি।

তবে ভিন্ন চিত্রও আছে কয়েকটি মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে। যেমন উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসর আগের থেকে পিছিয়ে গেছে। ৯ থেকে চারধাপ পিছিয়ে ১৩ নম্বরে নেমে গেছে। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে রাখলেও দেশটির এই পিছিয়ে যাওয়ার কারণ অনিয়ম আর অদূরদর্শিতা বলেই মনে করা হচ্ছে। এছাড়া সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে গেছে ইরাক, সিরিয়া ও বাহরাইন। এর মধ্যে ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।