কোন অঞ্চল দিয়ে যুদ্ধ শুরু করবে চীন?

-

  • মোতালেব জামালী
  • ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২৬

সীমান্তে চীনা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিকিমের নাথুলা সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে। একই সময়ে চীন ঘোষণা দিয়েছে, তারা দ্রুতই তাদের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী সাগরে নামাবে। এমন প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে যে, চীন কি বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে? দেশটি কি তার প্রতিবেশীদের সাথে সামরিক সংঘাতে জড়াতে চাইছে? যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয়েই পড়ে, তাহলে সেটা কোথায় শুরু হবে?

চীনের যুদ্ধবিমান ও সাবমেরিনগুলো তাইওয়ানের আকাশ ও নৌসীমা লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে পাঠিয়েছে রণতরী। চীন কি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে? চীনের ভেতরেও কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ভৌগলিকভাবে দেখতে গেলে চীনকে ঘিরে আছে প্রায় ২০টি দেশ ও ভূখণ্ড। চীনের চারপাশে ঘিরে আছে তাইওয়ান, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু দেশ। আছে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা। এই পরিস্থিতির মধ্যেই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি চীনের নিরাপত্তার জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

কারণ যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এসব দেশ ও ভূখণ্ডকে নানাভাবে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে চীনের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ভারত ও তাইওয়ানের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও সীমান্ত নিয়ে যে কোন সময় তা বিরোধে রুপ নিতে পারে।

চীন তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি মিত্রের সন্ধানেও মাঠে নেমেছে। ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই নামে একটি কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ বেশ কিছু দেশকে এতে যুক্ত করেছে। প্রতিবেশি দেশগুলোকে এই উদ্যোগে যুক্ত করে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে চীন। এমনকি বিআরআই এর মাধ্যমে দেশটি ইউরোপেও পৌছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

চীন তার রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার পরও তাইওয়ান কিংবা ভারতের সাথে চীনের যে কোন সময় বড় ধরণের যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

যদি যুদ্ধ করতেই হয় তবে চীন তা করবে তার সুবিধাজনক সময়ে। তবে চীনের জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল হবে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া। কেননা, যুদ্ধে জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন তা চীনের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। কারণ, চীন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে তা দেশটিতে গত ৪০ বছর ধরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান থাকার জন্যই সম্ভব হয়েছে। এখন বড় ধরণের কোন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে তা চীনের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা সবারই অজানা।

চীনের সাথে তাইওয়ানের যুদ্ধের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ, গত কয়েক মাস ধরে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। চীন তাইওয়ানকে তার দেশের অংশ দাবি করেে থাকে। অন্যদিকে তাইওয়ান স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা চীনের একত্রী করণের দাবি থেকে সরে এসে সামরিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি বহির্বিশে^ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

চীনের কৌশল হচ্ছে তাইওয়ানকে হুমকি দিয়ে চাপের মধ্যে রাখা যাতে তারা চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে একত্রিত হতে বাধ্য হয়। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, চীনের এই কৌশল না কাজ করলে শেষ পর্যন্ত দেশটি তাইওয়ান আক্রমন করতে পারে। যদি চীন তা করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য দেশ এতে জড়িত হয়ে যেতে পারে। কারণ চীন তাইওয়ান দখল করতে পারলে তারা তাইওয়ান প্রণালীরও নিয়ন্ত্রণ নেবে। এর ফলে এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যেও নাটকীয় পরিবর্তন আসবে।

যুদ্ধের আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে সেনকাকু দ্বীপ। চীন ও জাপান দুই দেশই এই দ্বীপের মালিকানা দাবি করে থাকে। গত দুই দশক ধরেই এই দ্বীপমালা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছে। এখানে চীনা বা জাপানী সেনাদের সামান্য ভুলের কারণে দুই দেশ বড় ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়েও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখানকার জলসীমার মালিকানা নিয়ে প্রতিবেশি ৬টি দেশ ও ভূখণ্ডের সাথে চীনের বিরোধ চলছে। দক্ষিণ চীন সাগর বিশে^র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌবাণিজ্য রুট হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশও এখানে তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে।

বিশে^র মোট বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই এই নৌপথ দিয়ে হয়ে থাকে। এছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আমদানী রফতানীর বড় অংশই দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে হয়। অন্যদিকে চীনের জন্য দক্ষিণ চীন সাগর হচ্ছে তাদের মুখ রক্ষা করার একটি ইস্যু। কারণ এটির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে গেলে এর দেখাদেখি তখন আরও এলাকা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাইওয়ান ছেড়ে দেয়া কিংবা সেনকাকু দ্বীপ জাপানের কাছে চলে গেলে সেখানে পশ্চিমা বিশে^র বিমান ও নৌবাহিনীর বড় ঘাটি হয়ে উঠবে। এ পরিস্থিতিও চীনের সাথে বড় ধরণের যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।

যুদ্ধের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে চীন-ভারত সীমান্ত। ভারত গত ৬০ বছর ধরেই চীনের সথে যুদ্ধে পরাজয়ের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। সাম্পতিক বছর গুলোতে সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। উভয়পক্ষই সীমান্তেতাদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। চীন তার সীমান্তে রেলপথ ও মহাসড়ক নির্মান করেছে যেটা চীনের একদম ভিতরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ভারতও সীমান্তে তাদের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক জোরদার করেছে। এছাড়া দেশটি বাইরের শক্তিরও সমর্থন পাচ্ছে চীনের সাথে দ্বন্দ্বের মোকাবেলায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভিয়েতনাম ভারতকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে এখানে একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ শুরু হলে এই সুযোগে পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানও ভারতকে আক্রমন করতে পারে।

অন্যদিকে ভারত তার সামরিক সক্ষমতা দেখাতে এবং চীন ও জাপানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্যও চীন আক্রমন করে বসতে পারে। যেভাবে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম আক্রমন করেছিল চীন। যদিও সেখানে চীনের সামরিক ব্যর্থতা ছিলো। কিন্তু এর বিনিময়ে চীণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকে প্রচুর সুবিধা আদায় করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহযেগিতায় চীনের শিল্প বিপ্লব ও উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছিল। আজকে চীনের যে অবস্থান তা ঐ সময় থেকেই শুরু হয়েছিল।

ভারতও একই ভাবে চীন আক্রমন করে জিতুক বা হারুক, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশে^র কাছে এর জন্য অনেক বড় পুরস্কার চাইবে। বিশেষ করে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত পণ্য সরবরাহ করার সুবিধা চাইবে ভারত।

চীনের সাথে যুদ্ধের আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে মঙ্গোলিয়া কিংবা কাজাখস্তান। কারণ দুটি দেশেরই চীনের ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। এই ফ্রন্টে যুদ্ধের কারণে চীন লাভবান হবে বলে ধারণা করা হয়। যুদ্ধে হার-জিত যাই হোক, এই যুদ্ধের মাধ্যমে চীন প্রতিবেশি অন্য দেশগুলোকেও ভয়-ভীতি দেখাতে সক্ষম হবে।

এছাড়া কোরীয় উপদ্বীপে উত্তর কোরিয়াকে দিয়ে দক্ষিন কোরিয়া ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টাও চীন করতে পারে। এসব সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটি দৃশ্যপটেই চীন সরাসরি জড়িত। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে চীনের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে পারবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সরাসরি তার বাহিনী পাঠাতে পারবেনা ভারতের পক্ষে।

এখন চীনের কৌশল নির্ধারণকারিরাই ঠিক করবেন যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে কিনা। তবে চীনের জন্য ভালো হবে কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ শুরু করানো। কেননা সেখানে চীনা বাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে হবেনা। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কেমন করে সেটা দেখেই চীন সরাসরি জড়িত হবে কিনা তা নির্ধরণ করতে পারবে। এছাড়া তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি প্রক্সি যুদ্ধের মহড়াও দিতে পারবে। এমন হলে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্নায়ুযুদ্ধ সারা বিশে^ই ছড়িয়ে পড়বে।