পঞ্চম প্রজন্মের বিমান নির্মাণে তুরস্কের পাশে ব্রিটেন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৩৩

তুরস্ক অনেকদিন ধরেই পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক টিএফ-এক্স যুদ্ধবিমান নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। নতুন প্রযুক্তির তুরস্কের এ বিমান নিয়ে প্রতিবেশী গ্রিসসহ ইউরোপের অনেক দেশই বেশ উদ্বিগ্ন। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের এ উন্নত বিমান নির্মাণ প্রকল্পকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে।

ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস প্রতিষ্ঠান বিএই সিস্টেম তুরস্কের পঞ্চম প্রজন্মের বিমান নির্মাণ প্রকল্পের সাথে এরই মাঝে সম্পৃক্ত হয়েছে। ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেন এখন নতুন করে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে। এরই অংশ হিসেবে আঙ্কারাকে টিএফ-এক্স যুদ্ধবিমান নির্মাণে সহায়তা করছে। তুরস্কের প্রতিবেশী রাষ্ট্র গ্রিস এ বিমানটিকে নিজের নিরাপত্তার জন্য বড় আকারের হুমকি বলেই বিবেচনা করছে।

বিগত কয়েক মাসে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে গেছে। জ্বালানী অনুসন্ধান এবং সমুদ্রসীমা নিয়ে বাদানুবাদকে কেন্দ্র করে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস দুই দেশই ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র কিন্তু সামরিক বিষয়াদি নিয়েও দুই দেশের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ন্যাটো খুব সফলভাবে দুই দেশের পরিস্থিতি সমাল দিতে পারছে না।

সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে গ্রিস এরই মধ্যে তার মিত্র দেশ ফ্রান্সের রাফালে যুদ্ধবিমান সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। একইসঙ্গে গ্রিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সি হক হেলিকপ্টারও কেনার চুক্তি করেছে। গ্রিস যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-থার্টি ফাইভ স্টেলথ বিমানগুলো সংগ্রহের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে তথ্য অনুসন্ধান করছে।

গ্রিস মূলত তুরস্কের সাথে প্রতিযোগিতা থেকে এমন বিমান নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কেননা, রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্ক এস ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনায় ক্রুদ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ থার্টি ফাইভ স্টেলথ বিমান প্রকল্প থেকে এরই মধ্যে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর গ্রিস এখন সেই সুযোগ নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

তুরস্ক এফ থার্টি ফাইভ স্টেলথ বিমানের মোহতে না ভুগে ওয়াইএস এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে। তুরস্কে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার ডমিনিক চিলকট জানিয়েছেন, বিএই সিস্টেমের সাথে মিলে তুরস্ক যেভাবে এ যুদ্ধবিমান নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে তাতে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সামরিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর অবরোধ আরোপ করায় তুরস্ক বিমানের ইঞ্জিন আমদানি নিয়ে শংকায় ছিল। সে আশঙ্কাকে গুড়িয়ে দিয়ে চিলকট জানিয়েছেন, রোলস রয়েস কোম্পানী তুরস্কের নির্মিতব্য পঞ্চম প্রজন্মের বিমানেও ইঞ্জিন সরবরাহ করবে।

রোলস রয়েস এরই মধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের জন্য নতুন করে ইঞ্জিনের নকশা প্রনয়ণ শুরু করে দিয়েছে। খুব শীঘ্রই তারা এই ইঞ্জিনটি তৈরি করে তুরস্ককে দিতে পারবে বলেও চিলকট আশা ব্যক্ত করেন। ব্রিটেন ও তুরস্ক শুধু এই টিএফ-এক্স এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটি যৌথ প্রকল্পও খুব শীঘ্রই শুরু করতে যাচ্ছে। যেখানে নতুন করে অনেকগুলো প্রোটোটাইপ বিমান নির্মাণ করা হবে। ব্রিটেন ও তুরস্ক এরই মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তিও সাক্ষর করেছে।

পঞ্চম প্রজন্মের টিএফ-এক্স যুদ্ধবিমান হলো এক ধরনের সামরিক বিমান। তুরস্কের এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিএআই নিজেদের উদ্যেগেই তুরস্কের বিমান বাহিনীর জন্য নির্মাণ করছে। এই বিমান নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে তুরস্ক অন্য আরও অনেক দেশেও এটি রফতানি করার পরিকল্পনা করছে। টিএফ-এক্স যুদ্ধবিমানটি স্টেলথ বিমান, যাতে দুটো ইঞ্জিন সক্রিয় থাকে। যেকোনো আবহাওয়াতেই বিমানটি সক্রিয় থাকে। ব্রিটেনের বিএই সিস্টেমের সাথে মিলে তুরস্ক এ বিমানটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্যারিসের এয়ারশোতে তুরস্ক প্রথমবারের মতো বিমানটির নকশা প্রদর্শন করে।

নতুন এ যুদ্ধবিমানটি লম্বায় হবে ১৯ মিটার। আর প্রশস্ত হবে ১২ মিটারের বেশি। সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার ফিট ওপর দিয়ে বিমানটি উড়ে যাবে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় দাবি করছে, ২০২৩ সালেই এ বিমানটি প্রথমবারের মতো আকাশে দেখা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটিতে দুটো জিই এফ হান্ড্রেড টেন ধরনের ইঞ্জিন স্থাপন করা হবে। তুরস্ক বিমান বাহিনী বর্তমানে যে এফ-সিক্সটিন ফ্যালকন বিমান ব্যবহার করছে, নতুন বিমানটি সেই জায়গাটা নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। তুরস্ক প্রত্যাশা করছে, টিএফ-এক্স এবং ওয়াইএস এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমানের মতো নতুন সব বিমানগুলো দিয়ে ২০৭০ সাল অবধি আকাশপথে সামরিক আগ্রাসন ও যুদ্ধ মোকাবেলা করা যাবে।

তুর্কী সূত্রগুলো বলছে, নতুনভাবে নির্মিতব্য এ বিমানগুলোতে উন্নতমানের প্রযুক্তি থাকবে। বিমানটিতে স্টেলথ প্রযুক্তি থাকায় শত্রুপক্ষের রাডারেও এর গতিবিধি নির্নয় করা কঠিন হবে। একই সাথে এ বিমানগুলোতে নতুন যেসব প্রযুক্তি থাকবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সেন্সর ফিউশন, উন্নত সিচুয়েশনাল এওয়ারনেস, ইন্টারনাল উইপন বে এবং উন্নত পারদর্শিতা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং কাজাখস্তান টিএফ-এক্স বিমানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বৃটেন কেন এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত হলো। আসুন জেনে নেই সে সর্ম্পকে কিছু তথ্য

ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেন নিজেদের সামরিক ও বৈশ্বিক প্রভাব শক্তিশালী করতে চাইছে। শুধু তুরস্কের বিমান বাহিনীকেই সহায়তা নয় বরং নিজস্ব সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি করার জন্য ব্রিটেন উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার পরবর্তী চার বছরের জন্য দেশটির সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে। কোল্ড ওয়ারের পর থেকে এত বেশি অর্থ ব্রিটেন কখনোই সামরিক খাতের জন্য বরাদ্দ করেনি। চলতি বছরের বাজেটের সাথে ব্রিটিশ সরকার বাড়তি বরাদ্দ হিসেবে আরও ২১দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, যদিও তার দেশ বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে বেশ নাজুক অবস্থানে আছে তারপরও তাকে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। কারণ ব্রিটেনের জন্য সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন বেশি জরুরি। জনসনের মতে, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি এখন যে পরিমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, কোল্ড ওয়ারের পর কখনোই এমন সময় আসেনি।

যে বিপুল পরিমান অর্থ সংশোধিত সামরিক বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে তার বড়ো একটি অংশ ব্যয় হবে ন্যাশনাল সাইবার ফোর্স গঠনের জন্য। এ ফোর্সটি শত্রুদেশ এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে মোকাবেলা করবে। বরিস জনসনের এ ঘোষণা একেবারে অপ্রত্যাশিতও নয়। কনজারভেটিভ পার্টির নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আগে থেকেই মহাকাশে কার্যক্রম বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। বিশ্বের বড়ো বড়ো সামরিক পরাশক্তিগুলোর সবাই এখন মহাকাশ কেন্দ্রিক কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে।

স্যাটেলাইটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে। শুধু স্যাটেলাইট নয়, যেসকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের অবস্থানকে নির্নয় করা যায় এখন এ জাতীয় সকল প্রযুক্তির নির্মাণ ও উন্নত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।

বরিস জনসন জানিয়েছেন, ২০২২ সালে ব্রিটেনের রয়াল এয়ারফোর্স স্পেস কমান্ড ব্রিটিশ স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করবে এবং একইসাথে স্কটল্যান্ড থেকে প্রথম রকেটও উৎক্ষেপন করবে। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির অংশ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীও প্রতিষ্ঠা করা হবে। শুধু বিমান বা মহাকাশের পেছনেই নয়, ব্রিটেনের বিশাল সামরিক বাজেটের একটি বড়ো অংশ রয়াল নেভি ফোর্সের উন্নয়নেও ব্যয় করা হবে।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৩২টি যুদ্ধজাহাজ ক্রয় এবং ৮টি টাইট টুয়েন্টি সিক্স নৌযান এবং ৫টি টাইপ থার্টি ওয়ান ফ্রিগেট নির্মাণেরও পরিকল্পনা করেছে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্রিটেন সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী বিশ্বের সর্বাধিক ব্যয়বহুল বাহিনীর একটিতে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই ব্রিটেনের অবস্থান চলে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি খবরে জানা গেছে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো এএইচ-সিক্সটি ফোর-ই এপাচে গার্ডিয়ার হেলিকপ্টার সংগ্রহ করেছে। এই নতুন হেলিকপ্টারগুলো বহুদিন ধরে ব্যবহৃত এ্যাপাচে এয়ারফ্রেমের স্থলাভিষিক্ত হবে। ব্রিটেনের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য যেসব উদ্যেগ নেয়া হয়েছে নতুন এ হেলিকপ্টারগুলো এরই অংশ হিসেবে বহরে যুক্ত হচ্ছে। ব্রিটিশ আর্মির এভিয়েশন কর্পোরেশন এ হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহার করবে। এরকম আরও ৫০টি হেলিকপ্টারও আগামী দুই বছরের মধ্যে এভিয়েশনের হাতে চলে আসবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

বর্তমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী লাইসেন্স বিল্ট মোডিফাইড ধরনের এএইচ সিক্সটি ফোর ডি এ্যাপাচে লংবো হেলিকপ্টার গানশিপগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে। ২০০৫ সালে এ হেলিকপ্টারগুলো প্রথম রেজিমেন্টেড হয়। আকাশপথের যুদ্ধে আরও বেশ কিছুদিন এ হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে, এই হেলিকপ্টারগুলোকে প্রাইমারি ট্যাকটিকাল এ্যাটাক হেলিকপ্টার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

ব্রিটিশ বাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরেই এ্যাপাচে হেলিকপ্টারের প্রয়োগ হয়ে আসছে। আফগানিস্তান ও লিবিয়ার যুদ্ধে এই হেলিকপ্টারগুলো দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনী বেশ সফলতাও পেয়েছে। তাই আবারো এ্যাপাচের ওপরই আস্থা রাখলো ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষ।