পাকিস্তান সামরিক সক্ষমতার জন্য ড্রোন পলিসি তৈরি করছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রথমবারের মতো দেশটির জন্য একটি ড্রোন পলিসি প্রণয়নে সম্মতি দিয়েছেন। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের স্থানীয় শিল্প জোরদার হবে এবং অটোমেশন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। পাকিস্তান এরই মধ্যে এ শিল্পের উন্নয়নে মিত্র দেশ তুরস্ক ও চীনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে।
ইসলামাবাদ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন খাতে ড্রোনের সফল ব্যবহারকে বিবেচনায় নিয়েই ড্রোন প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে বেসামরিক নানা খাতে ড্রোনের উপযোগিতা থাকলেও সার্বিকভাবে দেশটির প্রতিরক্ষা সেক্টরই ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে বেশি সুবিধা পাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এ নিয়ে ইমরান খান দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। একটি আইনগত এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো গঠন করে বিভিন্ন সেক্টরে মনুষ্যবিহীন আকাশযানের প্রয়োগ করা হবে। ইমরান খাতের মতে, শুধু প্রতিরক্ষা খাতই নয়, বরং দেশটির কৃষিখাতও ড্রোন শিল্পের মাধ্যমে উপকৃত হবে। তাছাড়া ড্রোন দিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বেশ কিছু সুবিধা পাবে বলে তিনি দাবি করেন।
বিশ্বজুড়ে অটোমেশন প্রযুক্তির যে জাগরণ ঘটছে, তাতে পাকিস্তান অগ্রাধিকার দিতে চায়। পাকিস্তান নতুন এ নীতিমালার মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেরাই ড্রোন তৈরি করবে না, বরং মিত্র দেশগুলো থেকে উন্নতমানের ড্রোনও সহজে আমদানি করতে পারবে। ড্রোন চালু হলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ও বানিজ্য কার্যক্রম যেমন গতি পাবে ঠিক তেমনি প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে পাকিস্তানের সীমান্তও অনেকটা সুরক্ষিত হবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি বেশ স্পর্শকাতর হওয়ায় দেশটি ড্রোনের আমদানি ও অপারেশনকে অনুমোদন দেয় না। তবে নতুন প্রনীত এ নীতিমালা এ দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনবে। একইসাথে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে এবং বিভিন্ন বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে যৌথভাবে অটোমেশন প্রযুক্তি চালু করার বিষয়ে উৎসাহ দেবে।
পাকিস্তান সরকার একটি ড্রোন রেগুলেশন অথোরিটি বা ডিআরএ গঠনের মাধ্যমেও বিভিন্ন খাতে রিমোট কন্ট্রোল চালিত নজরদারি প্রযুক্তি চালু করার কথা ভাবছে। যার অন্যতম লক্স্য হবে বানিজ্যিকভাবে ড্রোন মার্কেটে জায়গা করে নেয়া। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এ খাত থেকে পাকিস্তান ৪৩ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্রোন শিল্প নিয়ে একটি মানসম্মত জায়গায় যাওয়ার জন্য পাকিস্তান এরই মাঝে চীন ও তুরস্কের সাথে মিলেও বেশ কিছু যৌথ উদ্যেগ হাতে নিয়েছে। যদিও কৃষিখাতে উন্নয়ন এবং আইন শৃংখলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রনসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্যে নতুন এই আইন ও নীতিমালা প্রনীত হচ্ছে, এরপরও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শিল্প অনেক বেশি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
করাচিসহ বিভিন্ন শহরে রাস্তাঘাটে প্রকাশ্য অপরাধ দমনেও স্পেশাল ড্রোন ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ যেখানে ড্রোনের সহযোগিতায় অপরাধ দমন করছে সেখানে পাকিস্তানী পুলিশ ড্রোনের ব্যবহারে অনেকটা পিছিয়ে আছে। পাকিস্তান সরকার পুলিশ বিভাগকেও ড্রোন প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করার কথা ভাবছে।
ড্রোন শিল্প উন্নয়নের পথে বড়ো যে প্রতিবন্ধকতা আছে তাহলো ড্রোনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিশেষত ইঞ্জিন, ক্যামেরা এবং সেন্সরগুলোকে এখনও পাকিস্তানের আমদানি করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে এর ব্যবহার ও অনুশীলনে বাঁধা থাকায় এসব যন্ত্রাংশের অনেকটুকুই অবৈধভাবে পাচার করে আনা হয়। পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বানিজ্যিকভাবে ড্রোন সেক্টরকে উৎসাহিত এবং সমর্থন করা না হলে দেশটি এখাতে এগুতে পারবে না।
প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তানের হাতে এখনো পর্যন্ত যে কয়টি ড্রোন আছে, তার সবগুলোই তুরস্ক ও চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তান চীন থেকে ৫০টি উইং লুং নামক সশস্ত্র ড্রোন আমদানি করেছে যা পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দী ভারতের ভূমিতে কার্যকর সামরিক কাঠামোর জন্য রীতিমতো দু:স্বপ্নের কারণ হতে পারে। কারণ এখনো পর্যন্ত উন্নত এ ড্রোনগুলোকে মোকাবেলা করার মতো প্রযুক্তি ভারতের হাতে নেই।
এর আগে অবশ্য পাকিস্তান চীনের সাথে ৪৮টি সশস্ত্র ড্রোন যৌথভাবে নির্মানের বিষয়ে একটি চুক্তি করেছিল বলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে দাবি করা হয়েছিল। তবে, যৌথ নির্মাণের এ প্রক্রিয়াটি অন্য কোনো কারণে হয়তো ততটা অগ্রসর হয়নি আর সে কারণেই পাকিস্তান সরাসরি ড্রোন কেনার পথ বেছে নিয়েছে।
চীনের এ অত্যাধুনিক ড্রোনগুলো আমেরিকার এমকিউ ওয়ান প্রিডেটরের সাথে তুলনা করা হয়। এ ড্রোনগুলো হাতে পাওয়ায় পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেছে। শুধু চীন নয়, পাকিস্তান তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অনেকগুলো যৌথ প্রযুক্তি প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে।
তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উষ্ণ সম্পর্ক পাকিস্তানকে তুরস্কের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে। তাছাড়া সম্প্রতি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধে আজারবাইজান নিরংকুশ জয় পেয়েছিল তুরস্কের ড্রোনের ওপর ভর করেই। এ কারণে পাকিস্তান তুরস্ক থেকেও উন্নত ড্রোন ক্রয় করা এবং তুরস্কের সাথে মিলে যৌথভাবে ড্রোন নির্মান করার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এ ব্যাপারে একটি চুক্তি করা সম্ভব হবে বলেও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আশা করছে।
চীনও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ড্রোন প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছে। কয়েক বছর আগেও চীন ড্রোনের আমদানিকারক দেশ হলেও এবার তারা বিশ্বজুড়ে ড্রোনসহ অন্যন্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের তালিকায় শীর্ষ দেশের তালিকায় চলে এসেছে। চীনের নির্মিত ড্রোন এখন পাকিস্তান ছাড়াও আরো অনেক দেশেই নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি, চীন এসল্ট রাইফেল, এমুনিশন, যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিনও রফতানি করছে।
চীনের ড্রোন রফতানির ওপর এক সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৮টি দেশ চীন থেকে ড্রোন কিনেছে। অথচ ২০১১ সালের আগে মাত্র তিনটি দেশে চীন নির্মিত ড্রোন ছিল তাও অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। এ তিনটি দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইসরাইল।
হঠাৎ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চীনা ড্রোনের ওপর নির্ভরতা প্রমাণ করে এখাতে চীন একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। ২০১১ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে চীন ড্রোন রফতানি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করে। এরপর থেকে চীন মনুষ্যবিহীন আকাশ যানের বাজারে ক্রমাগত নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এখন যে ১৮টি দেশের কাছে চীনা ড্রোন আছে তার মধ্যে ১১টি দেশই সরাসরি চীন থেকে ড্রোন ক্রয় করেছে এবং তারা চীনা ড্রোনের নিয়মিত ক্রেতা। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, মিশর এবং উজবেকিস্তান।
সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে প্রথম ১০টিতেই চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান ঠাই করে নিয়েছে। শীর্ষ ২৫ এই নির্মাতা প্রতিষ্টানে চীনের আরো কয়েকটি অস্ত্র নির্মাতা ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাতা দেশ। চীনের আগে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আছে।
যেভাবে দেশটি এখাতে অগ্রসর হচ্ছে এবং বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করছে তাতে আগামীতে চীন আরো শক্তভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেবে। যুক্তরাষ্ট্র বিগত দুই যুগ ধরে একাই এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করলেও এবার চীন অনেকটা এগিয়ে এসেছে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্ত্র ব্যবসা শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৫ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের পিপলস লিবারেশন আর্মির সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সাল থেকে ব্যাপক উদ্যেগ নেয়ার পর বিশ্ব অস্ত্র বানিজ্যে তাদের বিনিয়োগ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।
চীন ২০১০ সালে ৪০টি দেশে অস্ত্র রফতানি করলেও ২০১৫ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫৩। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীন যত যুদ্ধাস্ত্র রফতানি করেছে তার ৩৫ শতাংশই কিনেছে পাকিস্তান। আগামীতে অন্যন্য দেশেও চীনের সমরাস্ত্র রফতানির হার একইভাবে বাড়বে বলেই বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।