কোন দেশের কমান্ডোরা বেশি শক্তিশালী?

চীনের নারী কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:১৪

যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডোদের বিভিন্ন দুর্ধর্ষ অভিযানের কথা কে না জানে? এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে মার্কিন কমান্ডোরা হত্যা করেছিল আলকায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে। মার্কিন কমান্ডোরা এ-রকম আরও বহু অভিযান চালাচ্ছে। চীনও এখন তাদের স্পেশাল ফোর্স বা কমান্ডো বাহিনীকে শক্তিশালী করতে মনযোগ দিয়েছে।

যে বাহিনী বিশেষ অভিযান বা অপারেশন পরিচালনা করে থাকে তারা বিশেষ বাহিনী বা স্পেশাল ফোর্স নামে পরিচিত । মূলত জল, স্থল বা নৌবাহিনীর চৌকস সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ বাহিনী । যেসব সামরিক কার্যক্রম বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সৈন্যদের দ্বারা অপ্রচলিত কৌশলের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়, তাকেই বিশেষ অভিযান বলে অভিহিত করা হয়।

মূলত বিশেষ বাহিনী গঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন বেশিরভাগ বৃহৎ সেনাবাহিনী যুদ্ধরত ছিল। এসময় শত্রুদের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে এ ধরনের বিশেষ বাহিনী সৃষ্টি করা হয় । যেমন - আকাশ থেকে আক্রমণ , বিদ্রোহ দমন, সন্ত্রাস দমন, গোপন অভিযান, সরাসরি আক্রমণ, বন্দী উদ্ধার, অপরাধী শিকার, অপ্রচলিত অভিযান বিশেষ বাহিনীর কাজের অংশ। যুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাসজুড়ে বিশেষ বাহিনী গুররুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রচলিত লড়াইয়ের বদলে এদের মূলনীতি ছিল আঘাত করেই পলায়ন।

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের নীতি নির্ধারক ও সামরিক নেতাদের কাছে স্পেশাল ফোর্স বা বিশেষ বাহিনীর অভিযান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র জোটের বিশেষ অভিযান এবং সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সাফল্য উচ্চ প্রশিক্ষিত ছোট টিমের গুরুত্বই তুলে ধরেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে স্পেশাল ফোর্সকে ব্যবহার করছে। সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখছে চীনের সামরিক বাহিনী। বিশেষ কওে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্সের দিকে চীনের বেশি নজর। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএর স্পেশাল ফোর্সকে শক্তিশালী করতে বিনিয়োগ করে চলেছে বেইজিং।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এখন সামরিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বে বৃহত্তম শক্তি। সেটা সামরিক দিক থেকে যেমন, অর্থনৈতিকভাবেও তেমনই।

তবে চীনের যেভাবে উত্থান হচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত। চীনের কাছেই এক সময় যুকরাষ্ট্রকে বিশ্বের একক পরাশক্তির মর্যাদা হারাতে হবে বলে অনেকেই মনে করেন। সেজন্য চীনকে প্রতিহত করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীন নানা দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল ফোর্সকে শক্তিশালী করার দিকেও চীনের নজর বহুদিনের।

যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্সের অভিযান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে ডেল্টা ফোর্স ও সিল টিম সিক্স। এরপরের ধাপে রয়েছে ৭৫ রেঞ্জার রেজিমেন্ট, নাইট স্টকার, মারসক এবং সিল ও বোট টিম।

সর্বশেষ ধাপে রয়েছে স্পেশাল ফোর্স গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার কমান্ডোদের কোনো বিশেষ গ্রুপে ফেলা যায় না। কারণ তারা প্রায়শই অন্য দলের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। নিজেরা পৃথক টিম হিসেবে অভিযানে অংশ নেয় না। তবে বলে নেওয়া ভালো যে এসব শ্রেণিবিভাগ মানের ওপর নির্ভর করে করা হয়নি। এগুলো মূলত তহবিলের ওপর ভিত্তি করা নির্ধারণ করা হয়েছে।

যেমন সিল টিম সিক্স ন্যাশনাল মিশন ফোর্সের অংশ তবে পেন্টাগনের ডাকে প্রথমেই সাড়া দেয়া তারা। ভ্যানিলা সিল টিমের চেয়ে তারা বেশি অর্থ ব্যবহার করতে পারে এবং বেশি সম্পদ কাজে লাগাতে পারে। তবে উভয়ই কিন্তু সিল টিম নামে পরিচিত।

সান জুর সময় থেকেই চীনা সামরিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ায় অনিয়মিত যুদ্ধ এবং বিশেষ অভিযান। সান জু তার লেখালেখিতে যুদ্ধে বিশেষায়িত ব্যক্তি ও ইউনিটের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে চীনের আধুনিক বিশেষ অভিযানগুলো অনেকটাই নতুন। আসুন জেনে নেই চীনের স্পেশাল ফোর্স সম্পর্কে।

চীনে এ ধরনের প্রথম ইউনিট ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর নাম স্পেশাল রেনেসা গ্রুপ। নব্বইয়ের দশকে পিএলএর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে এক হাজার থেকে দুই হাজার সদস্যের সমন্বয়ে সাতটি স্পেশাল অপারেশন্স গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন দেশটিতে একটি স্পেশাল অপারেশন্স ব্রিগেড সাইজের ইউনিট রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটা কম্বাট্যান্ড কমান্ডের সমান।

চীনের সামরিক বাহিনীতে আরও অনেক ছোট ছোট স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট রয়েছে। দেশটির নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও দেশটির পরমাণু অস্ত্র রক্ষায় নিয়োজিত রকেট ফোর্সেরও বিশেষায়িত স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট রয়েছে।

নৌবাহিনীর জিয়ালং বা সি ড্রাগনই খুব সম্ভবত চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট। এটি এডেন উপসাগরে জলদস্যুদের হাত থেকে একটি জাহাজ পুনরুদ্ধার করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে নিয়োজিত চীনের বেসামরিক লোকদেও উদ্ধারেও সহায়তা করে এ দলটি। এঘটনা নিয়ে চীনে পরে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়।

চীনে সব মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বিশেষ অভিযানের সৈন্য রয়েছে। চীনে স্পেশাল ফোর্সের সংখ্যা গত দুই দশকে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে চীনের নেতারা এ বিষয়ে অত্যন্ত মনযোগ দিয়েছেন।

২০০০ সালের শুরু থেকে পিএলএতে নাটকীয় আধুনিকায়ন হয়েছে। এখানে পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটেছে। নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের বদলে এখানে স্বেচ্ছায় সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ভিত্তিতে ছোট বাহিনী গঠন করা হয়েছে। তবে নীতিগতভাবে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এখনো বহাল আছে।

নতুন বাহিনীর উদ্দেশ্য আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা অর্জন। চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট এবং সমগ্র পিএলএ গত ৬০ বছর ধরে পাশ্চাত্যের স্পেশাল ফোর্সের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তবে রণাঙ্গনে চীনের স্পেশাল ফোর্সের শক্তিমত্তা এখনো পরীক্ষিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অপারেশন্স ইউনিটগুলো গত দুই দশকে যুদ্ধেওর অভিজ্ঞতায় ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ। তারা এখন একযোগে শতশত অভিযানে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটগুলোর লক্ষ্য আঞ্চলিক। এতে তাদের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটগুলো ইউএস স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের মত কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে চলে।

চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটগুলোর বিমান ও সমুদ্র সম্পদও সীমিত। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটগুলোর রয়েছে বিশেষায়িত বিমান ও সামুদ্রিক সম্পদ। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডোদের রয়েছে বিশেষ বিমান রেজিমেন্ট, স্পেশাল বোট টিম, সিল ডেলিভারি ভেহিক্যল টিম। বিমান বাহিনীরও রয়েছে স্পেশাল অপারেশন্স স্কোয়াড্রন।

চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটগুলো অঞ্চলভিত্তিক লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর গবেষণায় বলা হয়েছে, পিএলএ এভিয়েশন ব্রিগেড তৈরির মাধ্যমে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

দুই দেশের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটের উদ্দেশ্যও এক নয়। চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটগুলো ডাইরেক্ট অ্যাকশন,বিশেষ নজরদারি এবং সন্ত্রাসবাদের ওপর জোর দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রথাবিরোধী যুদ্ধ, অন্য দেশের প্রতিরক্ষা, বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন, জিম্মি উদ্ধার ও মনসতাত্ত্বিক যুদ্ধে জড়িত নয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে চীনা কমান্ডোদের মিশন এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশেষ অভিযানের মতই। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশেষ অভিযানে জড়িত নয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট এসব কাজে দক্ষ নয়। কিন্তু তাদের সুযোগ সীমিত। কারণ চীন যুক্তরাষ্ট্রের মত সারা বিশ্বে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে না। চীনের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটের কৌশলগত অগ্রাধিকার নিজ জনগণ।

যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটগুলোর চালিকাশক্তি হচ্ছে ননকমিশন্ড জনশক্তি। কিন্তু চীনে এ রকম ব্যবস্থা নেই । সেটাও এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া সব ব্যাপারে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নাক গলানোও একটা বড় সমস্যা কমান্ডোদেও কাজে। চীন অন্য দেশের সামরিক প্রযুক্তি ও ধারণা চুরি করে জঙ্গিবিমান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করছে বলে ধারণা করা হয়। তবে স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিটর কার্যক্রমণ অনুকরণ করা ততটা সহজ কাজ নয়।